সফলতা কেউ কাউকে দেয় না

, যুক্তিতর্ক

ড. হাসিন মাহবুব চেরী | 2023-09-01 10:01:44

সফলতা কে না চায়! সফলতার আকাঙ্ক্ষা মানুষের সার্বজনীন প্রত্যাশার একটি। এজন্য সফল মানুষের জীবনকথা সবাইকে আকৃষ্ট করে। চরম রোমাঞ্চ ও নাটকীয়তায় ভরা সেসব ইতিবৃত্ত মানুষকে চুম্বকের মতো টানে। শূন্য থেকে কোটিপতি হওয়া এমন সফল মানুষের আখ্যান রূপকথার মতো কোটি কোটি মানুষকে আকৃষ্ট করে।

তবে সফলতার গল্পটা পড়তে আগ্রহী হলেও এর পেছনের দুঃসহ পরিশ্রম, কষ্টকর অধ্যাবসায়, কঠোর ধৈর্য ও সুনিপুণ পরিকল্পনার বিষয়গুলো অনেকেই এড়িয়ে যায়। সফলতার পেছনে কষ্ট, পরিকল্পনা ও অধ্যাবসায়ের দীর্ঘ দিবস ও রজনীর কথাগুলো মনে রাখা বা অনুসরণ করাও অসংবেদনশীল অনেক মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয় না।

অথচ, বড় বা ছোট, কোনও সফলতাই প্রাকৃতিকভাবে আপনা আপনি হাতে চলে এসে ধরা দেয় না। পৃথিবীর বিখ্যাত সফলতম মানুষ থেকে শুরু করে আমাদের চারপাশের প্রাত্যহিক জীবনের সফল মানুষদের দিকে গভীরভাবে তাকালে তাদের সংগ্রামের সেসব বহুমাত্রিক চিত্র উদ্ভাসিত হয়। এজন্যই বলা হয়, ধাপ্পাবাজি, শর্টকাট কিংবা অসততার মাধ্যমে প্রকৃত সফলতা অর্জন করা যায় না। করলেও সেটা স্থায়ী ও টেকসই হয় না। কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় ও সততার মাধ্যমে অর্জিত সফলতাই প্রকৃত সফলতা এবং সেটাই জীবনে স্থায়ীভাবে বিরাজ করে।

অতএব, কারো জীবনের সফলতা দেখেই ‘তার জীবনে সব কিছু কেউ করে দিয়েছে’ এইরকম ভেবে হাল্কাভাবে বিচার করতে যাবেন না! বাইরে থেকে আপনি তার হাসি মাখা মুখটাই শুধু দেখছেন কিন্তু তার সফলতার পেছনের নির্ঘুম রাতগুলো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রমগুলো, অভুক্ত দূপুরগুলো, ত্যাগ ও কৃচ্ছ্রব্রত আপনি দেখেন নি এবং সে-ও আপনাকে সেসব দেখায় নি! আসলে দেখানোর মতো আপন ও নির্ভরযোগ্য আপনাকে সে মনেই করে নি কিংবা আপনিও গভীর অনুভূতিপ্রবণ মনের চোখে সেসব দেখতে পারেন নি। কারণ, মানুষের সংগ্রাম ও অর্জন, সফলতা ও অধ্যাবসায়ের সুদীর্ঘ ও সুগভীর অধ্যায়গুলো দেখার ও অনুভব করার মতো উচ্চতর মানসিক যোগ্যতা আর স্পর্শকাতর অনুভূতি সবার থাকে না।

আরেকটি বিষয় খুবই নিকৃষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাহলো, কারো সফলতা পরিমাপ করার অযোগ্যতা। অমুকের ছেলে/মেয়ে, তমুকের ভাই/বোন ইত্যাদি বলে অনেক সময় সফলতাকে তুচ্ছ ও হেয় করা হয়। আসলে এটা অযোগ্যদের হীন মনোবৃত্তি। মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই কারো ছেলে/মেয়ে বা ভাই/বোন হবেই। তবে নিজের যোগ্যতা না থাকলে কেউই কখনো সফল হয় না, নিজের কিছু যোগ্যতা থাকতেই হয় এবং উপযুক্ত পরিশ্রমও করতেই হয়। নইলে সব সফল লোকের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন এমনিতেই সফল হয়ে যেতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।

ফলে কাউকে নিয়ে আপনি সমালোচনা করে একইসাথে নিজের নীচুমনের পরিচয় দিচ্ছেন এবং নিজের অমূল্য সময় নষ্ট করছেন। আবার নিজের জীবনে কিছুই করতে পারেন নি বলে হা-হুতাশ করে নিজেকে হতাশ করে নিজের বারোটা বাজাচ্ছেন ও অন্যের সফলতার প্রতি হিংসা করে নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করছেন। অন্যদিকে, সফল মানুষটি কিন্তু আপনার মতো অন্যের সমালোচনা না করে তার স্বপ্নের পেছনে নিজের সময়টুকু ব্যয় করেছে আর এজন্যেই সে সফল হয়েছে।

এসব কথা বলার কারণ হলো, প্রায়ই আমাকে মটিভেশনাল ডিসকাশনে বা ভার্চুয়াল ফোরামে সফলতা নিয়ে কথা বলতে হয়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণেও এসব বিষয় আলোচনায় চলে আসে। ফলে মানবসম্পদ তথা ব্যক্তিমানুষকে নেতিবাচকতা থেকে ইতিবাচকতায় আনতে এসব জরুরি কথাগুলো বলতে হয়। আসলে এসব কথাগুলো হলো সফলতার পূর্বশর্তের মতো।

বস্তুতপক্ষে, সমালোচনা ও ছিদ্রানুসন্ধানের অন্ধকার চক্করে কানামাছি খেলতে খেলতে যারা জীবন শেষ করে, তারা নিজেরা সফল হবে কখন? আসলে, পৃথিবীতে কেউ কাউকে কিছু করে দেয় না, নিজেরটা নিজেকেই করে নিতে হয়। আর সেজন্যে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও পরিশ্রমটুকুও নিজেকেই করতে হয় ! তাই অন্যকে নিয়ে সমালোচনা না করে সেই সময়টুকু নিজের কাজে ইতিবাচক ও সুপরিকল্পিতভাবে ব্যয় করুন, পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় ধরে রাখুন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিকল্পনাকে পরিচালিত করতে থাকুন, দেখবেন সফলতা আপনারও আসবে নিশ্চয় !

Paulo Coelho- এর কথাগুলো মনে রাখবেন। By the River Piedra গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘‘We can never judge the lives of others, because each person knows only their own pain and renunciation.’’ পরিশেষে, অন্যের ব্যাকবাইটিং ছেড়ে পরিচ্ছন্ন মনে নিজের দিকে তাকান, নিজের কথা ভাবুন, নিজের সফলতার পথ নিজেই রচনা করুন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর