সহিংস গণক্ষোভে পুড়ছে শ্রীলঙ্কা

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 05:07:40

উপাখ্যানে লঙ্কা পুড়েছিল। এবার বাস্তবে পুড়েছে শ্রীলঙ্কা। অভাবনীয় গণক্ষোভের আগুনে জ্বলছে পুরো দেশ, যে দ্বীপদেশকে বলা হয় 'পার্ল অব ইন্ডিয়ান ওশান' বা 'ভারত মহাসাগরের মুক্তা'।

আফ্রিকার কোনও কোনও দেশে, কমিউনিস্ট সশস্ত্র বিপ্লবের পরে, স্বৈরশাসনের অবসানের মুহূর্তে এমন সহিংস জনপ্লাবন অতীতে দেখেছে পৃথিবী। যেন তারই পুনরাবৃত্তি হলো শ্রীলঙ্কায়। শুধু পুনরাবৃত্তি নয়, বরং জনপ্রতাপের অগ্নিগিরি তুল্য লাভাস্রোতে স্বৈরতন্ত্র ভাসিয়ে দেওয়ার অকল্পনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো দক্ষিণ এশিয়ার নাজুক, ভঙ্গুর ও প্রায়-দেউলিয়া দেশটিতে।

দাবানলের মতো সঞ্চারিত গণবিক্ষোভের সহিংস অভিব্যক্তিতে জ্বলন্ত শ্রীলঙ্কায় প্রজ্জ্বলিত হয়েছে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসের বাড়ি। জ্বলছে মন্ত্রী, এমপিদের বাড়ি। প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া ও মাহিন্দ রাজাপাকসের পৈতৃক বাড়িতে আগুন দিয়েছে জনতা। রাজাপাকসেরা ও এমপিরা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সেজন্য বিমানবন্দর ঘেরাও করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। ফলে তাদের জন্য এখন দেশ ছেড়ে পালানোর পথও বন্ধ।

অন্যদিকে সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে সরকার। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাদেরকে কারফিউয়ের সময় দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা সরকারি সম্পত্তি বা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তাদেরকে গুলি করতে হবে। কিন্তু তাতে জনসমুদ্র দমানো আদৌ সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস করছেন না বিশ্লেষকরা। বরং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে হামলার উস্কানি দেয়ার অভিযোগে মাহিন্দ রাজাপাকসের গ্রেপ্তার দাবি করেছে বিরোধীরা। এরই মধ্যে সহিংসতায় কমপক্ষে ৮টি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। আহত হয়েছে অসংখ্য। লাঞ্ছিত সরকারপক্ষের বহুজন এবং ভস্মিভূত হয়েছে বিপুল সহায়-সম্পত্তি।

স্বৈরশাসকের চিরায়ত দম্ভে একদিন আগেও জোর গলায় যে মাহিন্দ রাজাপাকসে বলেছেন, তিনি কিছুতেই পদত্যাগ করবেন না, তিনিই অবশেষে তার দম্ভের ইতি ঘটিয়ে জনরোষে নিজের সরকারি বাসভবন থেকে পালিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ভাষ্যমতে, বাসভবনের পেছনের দরজা দিয়ে তাকে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। ত্রিনকোমালি নৌঘাঁটিতে তিনি অবস্থান করছেন। এমন খবর পেয়ে বিক্ষোভকারীরা সেখানেও প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছিলেন। বস্তুতপক্ষে, জনতা পুরো সরকারকেই আক্ষরিক অর্থে ঘিরে ফেলেছে। একদা যারা দোর্দণ্ডশাসনে প্রকম্পিত করেছিল দেশ, তারাই এখন ভয়ে কম্পমান ও পলায়নপর।

সর্বসাম্প্রতিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণে রাজনৈতিক ভাষ্যকরাগণ বলছেন, "শ্রীলঙ্কায় ইতি ঘটতে চলেছে রাজাপাকসে যুগের। শুধু ইতি নয়, কবর রচিত হবে এই শাসকের, যার পরিবার কয়েক দশক ধরে দেশটিকে জিম্মি করে ফেলেছে ও শুষে শেষ করে দিয়েছে দেশটির সমুদয় অর্থনীতি।"

শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসের কঠোর শাসনে গণতন্ত্রের লেশমাত্র ছিল না। বিরোধী কোনও পক্ষের বা জনমতের তোয়াক্কা করা হয় নি। যখন যেটা মনে করেছেন, তা-ই করেছেন রাজাপাকসে ও তার পরিবার আর বশংবদ গণ। পুরো দেশকে এই চক্র পরিণত করেন বিদেশের ঋণের ওপর নির্ভরশীল। তা করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো চীনের নিয়ন্ত্রণে তুলে দেওয়া হয়। দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হয়। প্রভূত সম্পদ বিদেশে পাচার করা হয় এবং সর্বশেষে আস্ত দেশটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করে লুটেরা শাসকচক্র।

এহেন কুশাসন ও সামগ্রিক অবনতির মুখে শ্রীলঙ্কার অসহায় দেশবাসী দীর্ঘদিন সরকারি অব্যবস্থার প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছিলেন। এরই মধ্যে গত সোমবার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মাহিন্দ রাজাপাকসের সমর্থকরা সহিংস হামলা চালায়। ফলে এ থেকেই ভয়াবহ সহিংসতা শুরু হয় সেখানে। শান্তিপ্রিয় বিক্ষোভকারীরা সহিংস হয়ে ওঠে। তাদের হামলা-পাল্টা হামলায় হটে যায় সরকারের দালালরা।

ঘটনার এখানেই তীব্রতরভাবে জনসহিংসতার শুরু। তারপর নাটকীয়ভাবে মাহিন্দ রাজাপাকসে টুইটারে জানান, "প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের কাছে তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।" তার এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায় মন্ত্রিপরিষদ আর বর্তমানে দেশ চালাতে থাকেন তারই ছোট ভাই, প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে। ফলে জনতার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, রাজাপাকসে ও তার পরিবারতন্ত্র পুরো দেশকে গিলে খেতে উদ্যত। সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভরত জনগণ পাল্টা জবাবে শাসক দলের এমপিদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিতে শুরু করে। ক্ষমতাসীন পার্টি অফিসগুলো ধ্বংস করে দেয়। ক্ষুব্ধ জনতা পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসে এবং সরকারদলীয় কয়েকজন এমপি’র বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। মঙ্গলবার হাজার হাজার বিক্ষোভকারী মাহিন্দ রাজাপাকসের সরকারি বাসভবন টেম্পল ট্রিজের প্রধান গেট ভাঙার চেষ্টা করে। তখন রাজাপাকসেকে বাঁচাতে ভারী অস্ত্রসজ্জিত সেনা মোতায়েন করা হয়। ওই সেনারাই বাড়ির ভেতরের সবাইকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা বাড়িতে আগুনও লাগিয়ে দেয়। বাড়িটিতে কমপক্ষে ১০টি পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়।

যদিও মাহিন্দ রাজাপাকসে ও তার পরিবার নিরাপদে আছে, তথাপি জনতা বিমানবন্দর ঘেরাও করে রাখার ফলে তাদের দেশ ছেড়ে পালানোর পথ বন্ধ। সর্বশেষ জানা গেছে, তারা অবস্থান করছেন ত্রিনকোমালি নৌঘাঁটিতে। সে খবর পেয়ে বিক্ষোভকারীরা ধাওয়া করে সেখানেও পৌঁছে গেছে। ওই ঘাঁটির বাইরে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ চলছে।

দৃশ্যত শ্রীলঙ্কায় সরকার আর জনতা মুখোমুখি। তবে, ইতিহাসের শিক্ষানুযায়ী, সরকার বনাম জনতার মুখোমুখি লড়াইয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে জনতার বিজয় হবে, এটাই সুনিশ্চিত। পৃথিবীর ইতিহাসে তেমনটিই লিপিবদ্ধ রয়েছে। স্বৈরতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র কখনোই জনতার শক্তি ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারে না, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

শ্রীলঙ্কায় ইতিহাসের সেই শাশ্বত শিক্ষাই অগ্নিগর্ভ আবহে মঞ্চস্থ হচ্ছে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।

 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর