উত্তেজনা লঙ্কায়, বধেচ্ছা বাংলায়!

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-30 05:07:22

একদিকে বাণিজ্য ঘাটতি, অন্যদিকে আর্থিক ঘাটতি; তার ওপর ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারের স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কা যখন দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল তখন দেশটির আর্থিক দুর্দশা নিয়ে বাংলাদেশে রব ওঠেছিল বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে। অর্থনৈতিক সেই রব চলছে যদিও তবে এর সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মাহেন্দ্র রাজাপাকসের পদত্যাগ ও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার সাথে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিত করে নতুন আরেক আলোচনা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সাংসদ-নেতাদের পরিণতি নাকি এমনই হবে। এ আলোচনা যে স্রেফ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

শ্রীলঙ্কা-পরিস্থিতি আর বাংলাদেশ-পরিস্থিতি এক নয়—এমনটা বলে আসছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তবু আলোচনা থামে না। অর্থনীতিবিদেরা নানা সূচক ধরে দেখাতে চাইছেন কেন শ্রীলঙ্কার চাইতে কম ঝুঁকিতে দেশ, কিন্তু সবকিছুর মূলে যেখানে রাজনীতি সেখানে এমন কথা কানে তোলবার লোকের সংখ্যা কম, আবার কিছু লোক এমনিতেই যেখানে সন্দেহপ্রবণ সেখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল বর্তমান। সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি, রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক ঋণ, মেগা প্রকল্পের ব্যয় ও সেখান থেকে রিটার্নের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বলা হচ্ছে এগুলো শ্রীলঙ্কার অনুরূপ নয়। বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলো থেকে যেখানে ইতিবাচক রিটার্ন আসার সম্ভাবনা সেখানে ব্যর্থ হয়েছে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি। করোনাকালীন বিধিনিষেধে পর্যটন খাতে ধস, রপ্তানি আয়ে নিম্নমুখীনতা, রেমিট্যান্স ও রিজার্ভের স্বল্পতার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতা তাদের এমন পরিণতির জন্যে দায়ী বলছেন বিশ্লেষকেরা।

গত সোমবার বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে মাহেন্দ্র রাজাপাকসের পদত্যাগের আগে-পরে যে বিক্ষোভ ও সহিংসতা হয়েছে শ্রীলঙ্কায় এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও, বিশেষত সামাজিক মাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের ভাষায়-আশায়। সহিংসতার একটা পর্যায়ে দেশটির একজন সাংসদও মারা যান। একজনকে দিগম্বর করার দৃশ্যও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। মন্ত্রী-সাংসদ-নেতা কিংবা সাধারণ মানুষ যে-ই হোক না কেন দিগম্বর করে তার ওপর চালানো নির্যাতন অমানবিক ও বর্বরতা নিঃসন্দেহে, কিন্তু তবু এটা আমাদের সামাজিক মাধ্যমের অনেকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রকাশের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের মিলিয়ে নেওয়ার যে ইঙ্গিত কিংবা হুমকি এসেছে তা সাধারণভাবে দেখা হলেও এটা রীতিমতো উদ্বেগের।

কেবল সামাজিক মাধ্যমই নয় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের পরিণতি দেখছেন। তিনি বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি থেকে এই সরকারের শিক্ষা নিয়ে লাভ হবে না। কারণ, তারা শিক্ষা নিতে জানে না। শিক্ষা নিলে এই ১০ বছরে নিতে পারত। কিন্তু তারা কোনো শিক্ষা নেয়নি। এদের (সরকার) অবস্থা শ্রীলঙ্কা চেয়েও খারাপ হবে। শ্রীলঙ্কাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে না সব, এরা বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ জনসমর্থনের দিক থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের এমন মন্তব্য সুবিবেচনার ও দায়িত্বশীল কি-না তার কাছেই প্রশ্ন রাখতে চাই। কারণ কোন দেশ খাঁদে পড়লে সবাইকে নিয়েই পড়ে, কেউ রক্ষা পায় না। একটা দায়িত্বশীল দলের দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে দেশ ও সরকারের পরিণতি নিয়ে এমন মন্তব্য আমাদেরকে হতাশ করেছে। এখানে সরকারের পরিণতি নিয়ে আগ্রহের চাইতে তিনি দায়িত্বশীল মন্তব্য করতে পারতেন!

কে-না জানে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও দেশের মানুষ। আবার ওদিকে আরেক দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে না শুনলে মন খারাপ করছে দেশের মানুষই। কী অদ্ভুত বৈপরিত্য, কী অদ্ভুত স্বভাব মানুষের! স্রেফ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হোক এমনটা চায় অনেকেই। এর পেছনে কাজ করছে মূলত বধেচ্ছা! জিঘাংসার লক্ষ্যবস্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী-মন্ত্রী-সাংসদ। বধাভিলাষী লোকজন ভিনদেশ পরিস্থিতিতে দেশকে ডুবিয়ে হলেও জিঘাংসা চরিতার্থ করতে চায়!

এই চরিত্র কি নতুন আমাদের? নিকট অতীতে আমরা দেখেছি আফগানিস্তানে সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলের পর একশ্রেণির লোক উৎফুল্ল হয়েছিল। অনাস্থা ভোটে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর পর উপমহাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হতে যাচ্ছে বলে আরেকশ্রেণির লোক আশাবাদী হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা-পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের দুর্দশা দেখে একটা শ্রেণির লোকজন ফের আশাবাদী হওয়ার পাশাপাশি জিঘাংসাবৃত্তি জেগেছে তাদের। এগুলো অনুচিত, দায়িত্বশীলতা নয়; সুনাগরিকের লক্ষণও নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য এই দেশের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা, এই দেশের পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকা একদল লোক নিজ দেশের সেই করুণ পরিণতির অপেক্ষায় বসে আছে; স্বপ্নও দেখছে কেউ কেউ।

বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো হবে না—এ বিশ্বাস আমাদের। তবে হ্যাঁ, শ্রীলঙ্কা-পরিস্থিতি শিক্ষণীয় নিশ্চিত, তবে এমন পরিণতির অপেক্ষা করা উচিত নয়; বরং অসচেতনতায় হলেও এটা দেশবিরোধিতার অন্যতম এককও!

এ সম্পর্কিত আরও খবর