একজন প্রণামখ্যাত নেতা, অনামখ্যাত কবি

, যুক্তিতর্ক

মনোয়ার রুবেল | 2023-09-01 05:42:25

একজন কবি রাজনীতিবিদ হতে পারবেন, একজন রাজনীতিবিদ কবি হতে পারবেন না, এমন অলিখিত একটি ফতোয়া বাঙালি কবি সমাজ তৈরি করে রেখেছেন। কোন নেতা যদি কবিতা লিখেন তা নিয়ে বাঙালি সাহিত্য সমাজের প্রথম কাজ তার জাতপাত উদ্ধার করে বুঝিয়ে দেয়া, তুমি রাজনীতি করো, তুমি নিম্নবর্গীয় মস্তকের মানব। কবিতার মতো উচ্চবর্ণের কর্মজগতে প্রবেশ করে তুমি অপরাধ করেছ। তুমি বেড়া ডিঙিয়েছ।

একজন কবির লেখা কখনো সখনো আদৌ কবিতা হয়ে উঠলো কিনা তা নিয়ে কারো চিন্তা কস্মিনকালেও করতে দেখা যায় কি? বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান 'কর্তার পাদে গন্ধ নাই' শিরোনামে যখন কবিতা লিখে ঢাকার প্রথম আলোতে তুমুল ভক্তি ভরে তা ছাপা হয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ  যখন লিখেন "তোমার নয়নে নয়ন রাখিয়া/ বলেছিনু এসো প্রিয়া/ তাপিত হৃদয়ে ঝরনা ঝরাও/ প্রেমের অঞ্জলি দিয়া", তা ছাপা হয় না। কবিতা লেখার বিপরীতে এরশাদকে স্বৈরাচার, লুটেরা, চরিত্রহীন এগুলোই শুনতে হয় বেশি। এরশাদ, নিযুক্তিয় কবির কবিতা নিজ নাম চালাচ্ছেন এমন প্রচার এন্তার। কখনো, সুনিল শুভ রায় কখনো কবি আবু বকর সিদ্দিক তার কবিতার মালিক নাম হয়। এত প্রচার কখনোই হতো না যদি তিনি রাজনীতি করতেন।

এবার তালিকায় যুক্ত হলেন মমতা ব্যানার্জি। তাঁকে কলকাতায় 'অ্যাকাদেমি পুরস্কার' দেয়া হয়েছে, সাহিত্যে অবদানের জন্য।

কি আশ্চর্য ব্যাপার! মমতা কে? রাজনীতির লোক লিখবে কবিতা? তাকেও পুরস্কার দেয়া হয়েছে! ঘোর কলিকাল চলছে। তার বইয়ের সংখ্যা একশরও অধিক!  কী লিখে? অপাং সপাং ঝপাং? এসবই আলোচনা হচ্ছে৷

রাজনীতির লোক কবিতায় অনুপ্রবেশ, অনেক সুধীজন কেন যেন মেনে নিতে পারেনা। পাবলো নেরুদার কথা বাদই দিলাম। বাংলাদেশে কবি নজরুল বা নির্মলেন্দু গুণ যখন জাতীয় নির্বাচনে নেতা নির্বাচিত হতে প্রার্থী হন তখন রাজনীতিবিদরা এসে বলেননা আপনার রাজনীতি রাজনীতি হয়ে উঠে না বা আপনি অমুকের রাজনীতি চুরি করেছেন।

রাজনীতিই পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষনীয় পেশা, রাজনীতিবিদই হচ্ছে চরম অনিরাপদ পেশাজীবী। যে কেউ তাদের পেশায় ঢুকে যেতে পারে, যে কেউ তাদের গালি দিতে পারে। দেখুননা, কবিদের ফোরাম, লেখকদের ফোরাম, নাট্যকারদের কত কত ফোরাম হয়, কিন্তু রাজনীতিবিদদের কোন পেশাজীবী ফোরাম হয় না। তাদের অপদস্থ হওয়ার জন্য কোন সংগঠন, কোন ফোরাম কখনো প্রতিবাদ করেনা, কোন প্রতিবাদলিপি দেয় না। একরাজনীতিবিদের পুরস্কারপ্রাপ্তিতে অন্য রাজনীতিবিদরা আনন্দিত হয় না৷ রাজনীতিবিদ হওয়া যেন বাংলায় আজন্ম পাপ। এটা বাংলাতেই শুধু পাপ। তাদের নিজেদের মধ্যেই অন্তমিল নেই, তাদের অন্তমিল খোজা তাই সার। মমতার কবিতা নিয়ে কবি সমাজে যা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি তাচ্ছিল্য হচ্ছে তার স্ব রাজনৈতিক সমাজে। তার জ্ঞাতিগোষ্ঠী দ্বারা তাকে কবি স্বীকৃতি না দিতে কবিসমাজকে উশকে দেয়া হচ্ছে। তার হাম্বা,  থ্যাংকিউ এসব ছড়া আবৃতি হচ্ছে।

রাজনীতি লেখা পাশাপাশি কোনকালে চলেনি, তাতো নয়। চার্চিল লেখালেখি করতেন, বেঞ্জামিন ডিজরেইলি করতেন, আব্রাহাম লিঙ্কনও করতেন। লেখালেখি করতেন বলতে, তারা যৌবনে নাটক গল্প লিখে অত:পর ক্ষান্ত হয়ে রাজনীতিতে নামেন। লেখালেখি তাদের প্রথম পেশা ছিল, কারো শখ ছিল।

মমতা ব্যানার্জি সম্পর্কে জেনেছি তিনি ছবি আঁকেন, কবিতা লিখেন, কীর্তনও লিখেন। একজন মানুষ রাজনীতি করলে মন্দ কবিতা লিখবে তাতো না। তাকে যে বইটির জন্য আকাদেমি পুরস্কার দিয়েছে তাতে ৯৪৬ টি কবিতা আছে! ভাবা যায়? বাংলাদেশের হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মতো তার বেলায় অন্তত কেউ এটা বলেননি এগুলা অন্য কেউ লিখেছেন! এগুলো তিনিই লিখেছেন৷ কিছু অপাং সপাং ঝপাং হয়েছে, কিছু ভালো কবিতাওতো হয়েছে। অনলাইনে অনেক ভালো কিছু কবিতাও পড়ছি। একটি ছোট কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। কবিতাটির মমতার লিখা।

ছোট্ট একটা সংবাদ

সে আর নেই!

তান্ডব আজ লজ্জিত

জীবন জীবনে নেই।

সভাতার প্রদীপ নিভে গেছে

তেল আর নেই,

মোমবাতির সলতে জ্বলছে

আলো তাতে নেই।

এক গোছা সাদা ফুল

আনন্দধারা নেই।

পড়ে আছে খালি কফিন

সে? আর নেই..

কি চমৎকার বিষয় আর বলার ঢং৷

এদেশে এখনো হুমায়ুন আহমেদকে সাহিত্যিক স্বীকৃতি দিতে অনেকে তেড়ে আসেন। স্বয়ং রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্রসমাজপতি এরা একটা গোষ্ঠী ছিল, রবি ঠাকুরকে লেখা চোরও বলেছেন৷ 'সাহিত্য পত্রিকা'তেই চোখের বালিকে লেখা হয়েছিল চোরের বালি। সোনার তরীর প্যারোডিও হয়েছে। নজরুলের বিদ্রোহীর বেলায়ও হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে রথিমহারথীর এই অবস্থা! ভাবুন তো!

ধরি, কবিতা বিতানে মমতার ৯৪৬ কবিতার মধ্যে ৯৪০টিই কবিতা হয়নি৷ তাতে কি।, ৬টি তো হয়েছে৷ কবি হওয়ার জন্য ৬টিই কম গুরুত্বপূর্ণ?  কবি হেলাল হাফিজের একটি কবিতা লিখেই বিখ্যাত। তার একটি কবিতা (নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়) পড়েই  আহসান হাবিব বলেছিলেন, হেলালের আর কোনো কবিতা না লিখলেও চলবে, অমরত্ব ওর করায়ত্ত হয়ে গেছে। হয়েছেও তাই, হেলাল হাফিজকে 'যে জলে আগুন জ্বলে'র পরে আর কোন বই লিখতে হয় নি৷ কবি হওয়ার জন্য একটি কবিতাই যথেষ্ট।

কবিতা হওয়া না হওয়ার চেয়েও বড় কথা কবিতার প্রতি মমতার প্রবল অনুরাগ। প্রবল অনুরাগ আছে বলেই তিনি লেখার চেষ্টা করেন, শতাধিক বই লিখেছেন। তিনি রাজনীতির মানুষ না হলে অবশ্যই তার চেষ্টাকে মহত্তোম অভিধায় তুলে ধরে তালি দিতো। এদেশে সিনেমার প্রতি গার্মেন্টস ব্যাবসায়ি আব্দুল জলিলের ও হিরো আলম নামে তরুণের প্রবল অনুরাগকে বাঙালি সম্মানের সাথেই দেখেছে, মমতাও রাজনীতিতে যুক্ত না হলে তাই হতো, আমার ধারণা। তার পুরস্কার প্রাপ্তিও সম্মানিত হতো। কাব্যের প্রতি সময়োৎসর্গেরও মূল্যও পেতেন।

মমতার আকাদেমি পুরস্কারের ব্রাত্যবসুকে নিন্দা না করে, বরং কৃতজ্ঞতায় বাঁধা উচিত। আকাদেমি পুরস্কার না পেলে আমরা জানতামই না কবিতার প্রতি মমতার এই আত্মনিবেদন। আকাদেমির কাজ শুধু খ্যাতিমানদের পুরস্কার দিয়ে আরো খ্যাত করা নয়। নিভৃতচারী অখ্যাত সাধকদের পাদ প্রদীপের আলোয় তুলে আনাও এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিন, কবি হিসেবে মমতার পরিচয় অখ্যাত, আত্মনিবেদক, নিভৃত সাধকও বটে। তাঁকে কবি হিসেবে মানুষের সামনে তুলে আনা হয়েছে। এটা আকাদেমির সাফল্য।

আকাদেমির এ পুরস্কার প্রতিবছর এমন মানুষদের খোঁজেই হোক।

মনোয়ার রুবেল, ফ্রিল্যান্স রাইটার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর