গণকমিশনের শ্বেতপত্র ও আলোচিত ১১৬!

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-31 06:33:05

সরকারের নানা উদ্যোগে মাঠপর্যায়ের জঙ্গি দমনে সাফল্য এসেছে। তবে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে এই মোকাবিলা করার কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে আইনশৃঙ্খলাকারী বাহিনীগুলোর নিয়মিত নজরদারি ও অভিযানগুলো বন্ধ হয়ে গেলে কী পরিণতি হবে সেটা নিয়ে আমরা এখনও নিঃসন্দেহ হতে পারছি না। কারণ ধর্মীয় জঙ্গিবাদ মূলত ধর্মের মোড়কে, ধর্মের নামে পরিচালিত হয়ে থাকে। দেশ-দেশে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের মধ্যকার নির্দিষ্ট এবং গোপন গোষ্ঠীগুলো বেশিরভাগ মানুষের মগজধোলাই করে জঙ্গিবাদে উদ্বুব্ধ করে থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

সম্প্রতি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ‘শ্বেতপত্র: বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ নামের একটা প্রকাশনা উন্মোচন করেছে। গত মার্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান কামাল এই শ্বেতপত্র প্রকাশনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনকে বিরোধিতা করে এবং তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের বাড়িঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গঠিত মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন তদন্ত শুরু করে। দীর্ঘ নয়মাস তদন্ত করে এর ফলাফল ও কমিশনের সুপারিশ শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করেছে।’

দুইমাস আগে এই শ্বেতপত্র প্রকাশিত হলেও সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে মূলত ১১৬ ‘ধর্মব্যবসায়ীর’ নাম গণমাধ্যমে প্রকাশের পর। এই শ্বেতপত্র তারা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও জমা দিয়েছে, এবং শ্বেতপত্রে তাদের দেওয়া সুপারিশগুলো বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে। দুদকের এই তালিকা দেওয়ার পর দুদক আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য না দিলেও জঙ্গি অর্থায়নে যুক্ত নামগুলো এবং তাদের কার্যক্রম নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসার কথা জানা যাচ্ছে। দুদক এই ধর্মীয় নেতাদের সম্পদের হিসাব চাইতে পারে এমন এক আলোচনা সামাজিক মাধ্যমে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার আগেভাগে প্রশ্নও তোলে রেখেছেন ধর্মীয় নেতাদের হিসাব চাইবে কেন দুদক? হেফাজতে ইসলাম স্বাভাবিকভাবেই এই শ্বেতপত্রের বিরোধিতা করে নির্মূল কমিটিকে ‘ভুঁইফোড়’ সংগঠন দাবি করে একে ‘ধৃষ্টতা’ বলেও আখ্যা দিয়েছে। নির্মূল কমিটি হেফাজতের এই প্রতিক্রিয়াকে আমলে নেওয়ার দাবিও জানিয়েছে। অর্থাৎ শ্বেতপত্র প্রকাশের দুইমাস পর কথিত আলেম-ওলামাদের তালিকা যখন দুদকে গেল তখনই সবাই নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে। 

হেফাজতের প্রতিক্রিয়া ও তালিকার ১১৬ আলেমের শুভাকাঙ্ক্ষীরা চাইছেন না উল্লিখিতজনেরা তাদের সম্পদের হিসাব দিক, অথবা দুদককে এক্ষেত্রে কোন ভূমিকায় দেখতে রাজি নন তারা। তারা তাদের অর্জিত সম্পদ নিজেদের প্রয়োজনে ব্যয় করছেন, নাকি জঙ্গি অর্থায়নের ব্যয় করছেন এনিয়েও তাদের ভাবান্তর নেই। এটাকে ‘ধর্মের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ বলেও অনেকের অভিযোগ। কিন্তু কেউ যদি তার সম্পদের হিসাব দেয়, কাউকে যদি তার সম্পদের হিসাব দিতে বলা হয় সেটা কি অপরাধ হয়? বরং আলোচিতজনদের সম্পদের হিসাব না দেওয়াটাই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। ১১৬ জন আলেমের যে তালিকা দেখছি আমরা তারা হিসাব দিলেই বরং তাদের অঘোষিত সম্পদ আর থাকে না, সবটাই শুদ্ধ ধর্মের ভাষায় যা ‘হালাল’ হয়ে যায়! হেফাজত ও ১১৬ আলেমের শুভাকাঙ্ক্ষীরা কেন তাদের শ্রদ্ধাভাজনদের সম্পদকে স্বীকৃত কিংবা ‘হালাল’ রূপে দেখতে চাইছেন না?

এটা ঠিক আমাদের দেশে যাদের সম্পদের হিসাব জনগণ দাবি করে তারা সেটা করেন না। মন্ত্রী-সাংসদদের হিসাব প্রকাশের কথা থাকলেও তারা করেন না। বরং ক্ষমতার পটপরিবর্তনে ক্ষমতা-হারা হয়ে যাওয়ার পর দুদকের পক্ষ থেকে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে  মামলা হয়, জেলা-জরিমানাও হয়। তারাও সে পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। গণকমিশন ১১৬ আলেমের সম্পদ ও জঙ্গি অর্থায়নে তাদের জড়িত থাকার কথা বললে অনেকেই এখন রাজনীতিবিদ, আমলা, প্রশাসন, পুলিশের লোকজন, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সম্পদের হিসাব চাওয়ার কথা বলছেন। এটা মূলত গণকমিশনের দাবিকে গুরুত্বহীন করে তোলার হীন প্রচেষ্টা; অর্থাৎ কেউ সম্পদের হিসাব দেয় না, আলেমরা দেবে কেন? গণকমিশন কেন অন্যদের হিসাব না চেয়ে কেবলই আলেমদের হিসাব চাইছে, এ প্রশ্নও করছেন অনেকেই। অথচ এই কমিশনই গঠন করা হয়েছিল মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের দিনগুলো, এর কারণ অনুসন্ধান এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের সুপারিশের জন্যে। বিষয় যেখানে সুনির্দিষ্ট সেখানে এর সঙ্গে যুক্ত যারা তাদের নাম-পরিচয় ও জঙ্গি অর্থায়নে তারা জড়িত কি-না এটা আসাটাই তো স্বাভাবিক!

গণকমিশনের শ্বেতপত্রে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও জঙ্গি অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত কেবল ১১৬ ধর্মীয় বক্তার নাম আসেনি। এসেছে পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম, ইউএনওর নাম, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম যারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে, বিদ্বেষ  প্রচারে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, সহযোগিতা করেছেন। নির্মূল কমিটি এই নামগুলো পেয়েছে ঘটনার শিকার ব্যক্তিসহ এর সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত মানুষদের সাক্ষ্যে। এখানে তাই উদ্দেশ্যমূলকভাবে ১১৬ ধর্মীয় বক্তাকে জড়ানো হয়েছে বলে যে অভিযোগ অনেকের তা সঠিক নয়। ২ হাজার ২০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র স্রেফ ১১৬ নামেই সীমাবদ্ধ নয়; এরসঙ্গে যুক্ত আছে আরও অনেক নাম, অনেক সাক্ষীর সাক্ষ্য, অনেক ঘটনার বিবরণ, সমস্যা থেকে উত্তরণের পথও।

মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, জঙ্গি অর্থায়নে যারা যুক্ত তাদেরকে আইনের আওতায় না আনলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না। বর্তমানে দেশে জঙ্গিবাদের প্রকাশ বিস্তৃত পরিসরে দেখা না গেলেও সময়ে-সময়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটতেই আছে। নির্মূল কমিটির শ্বেতপত্রে ধর্মীয় বক্তা, প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতাসহ যাদের নাম এসেছে তারা কোনো না কোনোভাবে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের অংশ হয়েছে বলে তাদের অনুসন্ধানে ওঠে আসা তথ্য। তালিকার সবাই যে জঙ্গি অর্থায়ন করছে এমন নাও হতে পারে, তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে, নারীদের অসম্মান করতে নানাভাবে ভূমিকা রেখেছে, এবং সেটা ধর্মের নামে। সামাজিক বিভক্তি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টির সহায়ক যারাই হয়েছেন তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।

আমরা জানি না নির্মূল কমিটির শ্বেতপত্রে উল্লেখ সুপারিশগুলো সরকার গ্রহণ করবে কি-না। আমাদের বিশ্বাস ধর্মাচার ও ধর্মীয় বক্তব্য দেওয়া কোনোভাবেই অপরাধ নয়, তবে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভক্তি ছড়ানো নিশ্চিতভাবেই অপরাধ। এই অপরাধে যারা জড়িত তারা হতে পারে ‘হেভিওয়েট’ কোনো, তবু তাদের কোনোভাবেই ছাড় নয়!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর