'স্টকহোম সিনড্রোম' নাকি আবহমান প্রতিবাদহীন নারী নির্যাতন?

, যুক্তিতর্ক

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-30 10:59:23

১৯৭৩ সালে সুইডেনে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিলো। সে বছর ২৩ শে আগস্টের সকালবেলা সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের স্পেরিকাস ক্রেডিট ব্যাংকে একটা ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ সময়ে ডাকাত দল অনেক জনকেই ব্যাংকের মধ্যে জিম্মী করে রাখেন এবং সেটা টানা ৬ দিন ধরে। তাদের মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো ছিলেনই।

ছয় দিন পর পুলিশ যখন ডাকাত দলের উপরে অ্যাকশনে যায়, তখন ব্যাংকে জিম্মী থাকা মানুষগুলো উলটো ডাকাতদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলো। এই ঘটনায় সবাই অবাক হয়ে পরেন।

যারা আটকে রাখলো, তাদের প্রতিই এই ভালোবাসা কিভাবে তৈরী হলো! এমনকি দেশের প্রেসিডেন্ট মহোদয় যখন অপহৃত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন, তখন ডাকাতদের প্রতি সহমর্মিতার ব্যাপারেও আবেদন জানিয়েছিলেন অপহৃত ব্যক্তিরা। এই ঘটনা তখন ঘটা করে রেডিওতে প্রচার পেয়েছিলো।

এই ঘটনা থেকেই "স্টকহোম সিনড্রোম" কথাটার জন্ম। আমাদের দেশেও এমন ঘটনা ঘটে।

দেখা যায়, একজন স্বামী তার স্ত্রীর উপর নির্যাতন করলেন, এমনকি নির্যাতনের এক পর্যায়ে হত্যা চেষ্টাও করলেন। পরবর্তীতে স্ত্রীর বাপ-ভাই যখন তার স্বামীর নামে মামলা করলো, স্ত্রী আদালতে গিয়ে স্বাক্ষ্য দিলেন যে, এই অত্যাচার তার স্বামী করেন নাই বা তার স্বামী একজন আপাদমস্তক ভালো মানুষ।

এটাকেও 'স্টকহোম সিনড্রোম' বলা যায়।

দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচারিত হতে হতে অত্যাচারকারীর প্রতি এক সময় একটি অসুস্থ আবেগ বা অস্বাভাবিক দুর্বলতার জন্ম হয়।

অত্যাচার সহ্য করে হলেও তাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করে না। এভাবেই একটি জনপদে শিশু নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতনগুলো আলো বা বিচারের মুখ দেখে না।

২০০২ সালে মাত্র স্টন হর্ণব্যাক নামের এক ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়। তাকে প্রায় ২ বছর পরে অপহরণকারীর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। তার শরীরে অত্যাচারের চিহ্ণ ছিলো। তদন্তে দেখা যায়, অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে পালানোর কোনো চেষ্টা করেনি। এমনকি স্টন হর্ণব্যাকের কাছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পর্যন্ত ছিলো!

২০২২ সালে একটি জেলার একটি লোকারণ্য রেলস্টেশনে একজন নারী অন্য একজন নারীর উপরে আক্রমনাত্নক হয়ে ওঠেন। প্রথন নারীর অভিযোগ এই যে, দ্বিতীয় নারী একটি স্লিভলেস পোশাক পরিধান করেছেন যা মোটেও সেই দেশে কোন ফৌজদারী বা দেওয়ানী অপরাধ না।

কিন্তু সারা জীবন একটি মহলের দ্বারা শাসিত ও পদদলিত হয়ে থাকতে থাকতে প্রথম নারী তার ব্যক্তিসত্ত্বাকে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছেন। পোশাকের মতো একটি সাধারণ নাগরিক 'অধিকার' তার কাছে অনৈতিক, বেমানান ও অসামাজিক মনে হচ্ছে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটি অসুস্থ অংশের এই নোংরা শোষণের প্রতি তার গভীর আবেগ ও ভালোবাসা তৈরী হয়েছে। তাই সেই দিন একজন নারী হয়েও অন্য একজন নারীকে আক্রমণ করতে, শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত করতে এবং দ্বিতীয় নারীর গায়ের পোশাক টেনে ছিঁড়ে ফেলতেও তার খারাপ লাগছিলো না। অথচ 'স্বল্প' পোশাক পরিধান নিয়েই তার অভিযোগ ছিলো। কিন্তু তিনি নিজেই আবার অন্য নারীটির পোশাক ছিঁড়ে ফেলছেন নির্দ্বিধায়। আবার এই কাজে তিনি সেই সমাজের গুটিকয়েক পুরুষের সাহায্য নিচ্ছেন!

সাইকিয়াট্রিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থা একদিনে তৈরী হয় না। মানসিক দৈন্যতার এই স্তরে যেতে কয়েক মাস, কয়েক বছর এমনকি কয়েক প্রজন্ম লেগে যেতে পারে।

অত্যাচারকারীর প্রতি এই স্নেহ বা আবেগ অনেক সময় বিপদজনক পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এমনকি এ সময় কেউ উদ্ধারে এগিয়ে এলে তাকেও আক্রমণ করে বসতে পারেন স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি। অবশ্য ক্রিমিনোলজিস্টরা অনেকে স্টকহোম সিনড্রোমে বিশ্বাস করে না।

যাই হোক, চোখের সামনে প্রতিনিয়ত একটি অন্যায় দেখছেন, অথচ সেই অন্যায়ে আপনি কোন বাঁধা দিচ্ছেন না। বরং সেই অন্যায় আপনার ভালো লাগছে, মজা লাগছে। সেই অন্যায়কে আপনি যত্নে এবং খুব গর্বে লালন করছেন, পৃষ্ঠপোষকতা করছেন -

এরকম উদাহরণ এই দেশে কি খুব বেশি অপ্রতুল?

লেখক: ডা. রাজীব দে সরকার, চিকিৎসক, সার্জারী বিভাগ (৩৩ বিসিএস), শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

এ সম্পর্কিত আরও খবর