নির্বাচনী ইশতেহার ও জনগণের প্রত্যাশা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-31 16:50:57

দরজায় কড়া নাড়ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পুরো দেশে বইছে নির্বাচনী হাওয়া, আবার কেউ কেউ বলছেন গোটা দেশ এখন নির্বাচনী জ্বরে আক্রান্ত। যে যেভাবেই বলুক এবারকার নির্বাচন একটু ব্যতিক্রমধর্মী কারণ সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়নি, ও তত্ত্বাবধায়ক অর্থাৎ নির্দলীয় সরকারের অধীনেও নির্বাচন হচ্ছে না। হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। এ নিয়ে সরকারের বাইরে থাকা বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বেশ কিছু দল আন্দোলন করে আসছে, দাবী-দাওয়া করে আসছে কিন্তু নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেই হচ্ছে।

এর ভাল ও মন্দ দুটো দিকই আছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, এই নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল বিজয়ী হবে আর কোন দল হারবে, তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে জনগণ হারবে। বড় কঠিন সত্য কথা বলেছেন তিনি। আসলে গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় পৃথিবীর ক’টি দেশে তার প্রকৃত প্রয়োগ আছে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কারণ গণতান্ত্রিক দেশে চার/পাঁচ বছর পরেই জনগণের কাছে তাদের মতামত প্রয়োগ করার একটি সুযোগ আসে, সেই সুযোগটিও তারা সারাজীবনে হয়তো একবারও ভালভাবে ব্যবহার করতে পারে না। আর ভোট প্রদান করার পরে কিন্তু ভোটার তথা জনগণের আর কোনো ক্ষমতা থাকে না, মূল্য থাকে না, তাদের মতামতের আর কোনো দাম থাকে না। তারপরেও অনেকেই চার বা পাঁচ বছর পরে এই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে এক ধরনের আনন্দ পায়।

লর্ড লিংকন নামের এক ব্রিটিশ ঐতিহাসিক বলেছেন `Power tends to corrupt; absolute power corrupts absolutely.’’। এ অভিজ্ঞতা বিশ্বের প্রায় সকল দেশের । তার পরেও আমরা দেখতে পাই বৃহত্তম রাজনৈতিক absolute power অর্জন করার জন্যই ব্যস্ত থাকে। রোমান্টিক কবি পারসি বিশি শেলি তাঁর কুইন ম্যাব কবিতায় বলেছেন, Power, like a desolating penitence, Pollutes whatever it touches। ক্ষমতা মানুষকে যে দুর্নীতপরায়ণ করে এই জন্যই গণতন্ত্রে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকতে হয় কিন্তু বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিরোধী দলের কোনো ভূমিকা থাকে না।

ক্ষমতাসীন দল সব সময়ই একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করতে চায়, বিরোধী দলকে কোনো ধরনের সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করাতে চায় না যার ফলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জন্য গণতন্ত্রে থাকতে হয় সহনশীলতার নীতি, সমমর্মিতা, জনকল্যাণ করার মানসিকতা, অন্যদেরকে অধিকার দেওয়া, অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা।

কিন্তু এগুলোর অনুশীলন দেশের ভবিষ্যত নাগরিক ও নেতৃবৃন্দ কোথায় শিখবে? সমাজ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের কোথাও যদি এর কোনো প্রতিফলন না দেখে তাহলে ভবিষ্যত বংশধররা এগুলো কোথায় শিখবে? আমরা এগুলো পরিবর্তন করার কোনো চিন্তা করছি নাকি দেশে প্রচলিত গণতন্ত্রকেই আমরা ধারণ করব?

ভোট দেওয়ার পরে যদি কোনো নির্বাচনী এলাকার প্রার্থী বিজয়ী হয়, তাদের প্রার্থী যে পার্টির সমর্থক সেই পার্টি যদি সরকার গঠন করতে পারে তাহলে হয়তো ঐ এলাকার জনগণের কিছুটা আনন্দ থাকে, হয়তো এলাকার উন্নয়নেও কিছু কাজ হয়। কিন্তু ঐ নির্দিষ্ট সংসদীয় এলাকার জনগণ যারা বিজয়ী প্রার্থীকে ভোট দেয়নি তাদের অবস্থা প্রচলিত গণতন্ত্রে কী হয়? তাদের উপর নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার।

এসব কারণে নির্বাচন, ভোট, প্রার্থীর বিজয় ইত্যাদি নিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর আগ্রহটা যেন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের, শান্তিপ্রিয় মানুষের, নিরীহ মানুষের ও শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে আগ্রহ। অথচ এসব মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া তো প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা কোথাও হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কী ভাবছে, কী তাদের মতামত তা জনগণের সামনে পরিস্কার করা উচিত।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের ক্ষমতা কতটুকু, তারা রাষ্ট্র থেকে কীভাবে ও কতটুকু সম্মানপ্রাপ্ত হবে, এসবই কাগুজে ব্যাপার। বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। অন্তত তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশ তা প্রত্যক্ষ করে না। গণতান্ত্রিক নিয়মে বলা হয় যে দল ক্ষমতায় যাবে তারা জনগণের কল্যাণে কাজ করবে। আর তাদের যারা বিরোধী থাকবে তারা হবে ‘ছায়া সরকার’। তারা সরকারের সকল কর্মকাণ্ডের ওপর ফিডব্যাক দেবে। ফিডব্যাক ছাড়া যেমন পেশাগত উন্নয়ন সম্ভব নয়, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনার মতো বৃহৎ কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে পরিচালনা করা দ্বিতীয় বা তৃতীয় পক্ষের ফিডব্যাক ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর আমরা পৃথিবীতে যে গণতন্ত্র নামের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি প্রত্যক্ষ করি সেখানে সমালোচনা মানে শত্রুতা।

এসব কারণে পৃথিবীর খুব কম দেশেই প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চা , রীতিনীতি সঠিকভাবে পালিত হয়। পৃথিবীর দু চারটি দেশে যদিও হয় সেখানে রয়েছে আবার অন্য ধরনের দুর্বলতা। আবার এটিও ঠিক যারা বিরোধী দলে থাকে তাদেরও অনেক দায়িত্ব থাকে কিন্তু তারা সেগুলো পালন করে না। তারা অপেক্ষায় থাকে শুধু ক্ষমতা দখল করার। এর ফলে গণতন্ত্রের প্রকৃত সুফল বিশাল জনগোষ্ঠির ভাগ্যে জোটে না। জোটে একশ্রেণির মানূষের। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর স্পষ্ট নীতি থাকা উচিত, তা না হলে রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ কমতেই থাকবে। আর যাদের জন্য রাজনীতি তারা যদি অংশগ্রহণ না করে তাহলে এই গণতন্ত্রেও অর্থ কী?

নির্বাচনের মাধ্যমে যারা দেশকে নেতৃত্ব দেবে তারা নেতৃস্থানে চিরদিন থাকবেন না। প্রকৃতির নিয়মে পরবর্তী প্রজন্ম সেই স্থান দখল করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মও কি একই ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চ করবে? আমরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখি জনগণের ন্যায্য ও সাধারণ অধিকার পেতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ঘুষ দিতে হয় কারণ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি, অধিকার দেওয়ার কথা চিন্তাও করছি না। সবকিছুর মূলে রয়েছে প্রকৃত শিক্ষা। প্রকৃত শিক্ষায় ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে আশা করা যায় দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চা হবে, নিরীহ জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনগণের অধিকার ফিরে আসবে।

প্রচলিত গণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে ঘুষ ছাড়া তাদের কোনো অধিকার আদায় হয়না। তারা মেধার ভিত্তিতে যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য বিবেচিত হয় সেখানেও তাকে ঘুষ দিতে হয়। এটি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যে দল আগামী দিনে সরকার গঠন করবে এই বিষয়টি তারা কীভাবে দেখছে, কীভাবে ম্যানেজ করবে তার একটি সুনির্দিষ্ট মেনিফেষ্টো জনগণের জানা উচিত।

উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবে সেখানেও রাজনীতি। ভর্তি হওয়ার পর হলে সিট পায় না। যদি কোনো পার্টির সাথে যুক্ত হয়, পার্টির মিটিং মিছিল করে, প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করতে পারে তাহলে সে হলে সিট পায়। এখানেও গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে একজন নাগরিক বঞ্চিত। তারপর উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশুনা, গবেষণার চর্চা বাদ দিয়ে চর্চা হচ্ছে হকিস্টিক, পিস্তল আর কাটা রাইফেলের। এই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মেনিফেষ্টো কী তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা প্রয়োজন।

নিত্যদিন ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলনের পর সরকার আইন করেছে কিন্তু পরিবহন শ্রমিকরা তা মানছে না। আসলে এখানে পরিবহন শ্রমিকদের ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। পথচারীদের এবং সাধারণ নাগরিকদের পরিবহন আইন মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এটি একপক্ষের কাজ নয়। তাদেরকে আইন মানানোর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিষয়টি শেখাতে হবে, বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের বিষয়টি শেখাতে হবে, আইন অমান্যকারীদের মৃদু শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ফলে বিষয়টিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক দলগুলোর এ ব্যাপারে কি মেনিফেষ্টো রয়েছে তা জানাতে হবে।

সর্বোপরি নাগরিকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য রাষ্ট্র কী কী করবে তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। যে রাষ্ট্র নাগরিকদের মর্যাদা দিতে জানে না সেই রাষ্ট্রের নাগরিকরাও রাষ্ট্রকে তথা রাষ্ট্রীয় রীতিনীতিকে সম্মান করে না। এই বিষয়গুলোসহ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রেখে রাজনৈতিক দলগুলো জগনগণের কাছে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করবে বলে আমরা আশা করি।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর