বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দিগন্তে দুর্যোগের কালো মেঘ!

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:20:09

২০২২ সালের শুরু থেকেই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দিগন্তে দুর্যোগের কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে, যার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, সামরিক ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বহুমুখী কার্যকারণ।

প্রথম থেকেই চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনার থাবা অনেককিছুর মতোই অর্থনীতিতেও হানা দিয়ে চলেছে। বেড়েছে বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি এবং কমেছে উৎপাদন। করোনার মধ্যেই রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনে আক্রমণ বিশ্বব্যাপীই খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহকে ভঙ্গুর করেছে। পাশাপাশি, জলবায়ুর পরিবর্তনে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে অর্থনীতির মেরুদণ্ডে পৌনঃপুনিক আঘাতের নানা ক্ষতিকর প্রতিফল ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। যার প্রভাবে পৃথিবীর দেশে দেশে বাজার ব্যবস্থা ও ভোক্তাদের জীবনে তীব্র ও সঙ্কটজনক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বল্পমেয়াদি উন্নতির সম্ভাবনা কমে এসেছে, জ্বালানি ও অন্যান্য শক্তির দাম বেড়েছে, বাণিজ্য-সাম্য নেতিবাচকতার দিকে ঢলেছে, ফিসক্যাল ব্যালান্স (রাজস্বের সঙ্গে সরকারি ব্যয়ের তুলনামূলক হিসাব) উচ্ছন্নে গিয়েছে, প্রায় প্রতিটি দেশেই টাকার মূল্যমান কমেছে। সর্বপরি বাজারে এক রকমের শঙ্কিত অবস্থায় বিরাজ করছে এবং ভোক্তারা মূল্যবৃদ্ধির আঁচ খুব ভাল করেই অনুভব করছেন।

আন্তর্জাতিক পরিসরে যুদ্ধাক্রান্ত শরণার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধিজনিত চাপ ছাড়াও বিশ্বের ধনী দেশগুলোতে (যেখানে পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশ মানুষ বাস করেন) দরিদ্রতর দেশগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক অভিবাসীর বলপূর্বক বা জীবনবাজি রেখে অনুপ্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে, চীনের উত্থানের ফলে ক্ষমতাবিন্দুর স্থানাঙ্ক পরিবর্তনেও অর্থনীতির গতি ঘুরে গিয়েছে। ইউরোপ নয়, বিশ্বের ক্ষমতা ও আর্থিক ভরকেন্দ্র এখন ইন্দো-এশিয়া অঞ্চল। পৃথিবী পূর্বতন শক্তিসাম্যকে ঝেড়ে ফেলে নতুন কোনও ব্যবস্থার জন্ম দেওয়ার প্রাক্কালে 'প্রসববেদনা কাল' অতিক্রম করছে।

এইসব রাজনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত পালাবদলকে আরও উতপ্ত করছে জৈব-সঙ্কটের ক্রমপ্রবাহ— ম্যাড কাউ ডিজিজ, সার্স, বার্ড ফ্লু, কোভিড-১৯ এবং নবাগত মাঙ্কি পক্সের মতো অতিমারি বা মহামারি।  ফলে স্বাভাবিকভাবেই পণ্য  উৎপাদন ও পরিবহণ এবং গণগতিশীলতা ও গণপর্যটন বিপর্যস্ত হয়েছে। এহেন স্থবিরতা বৈশ্বিক অর্থনীতির চাকাকে শ্লথ কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে স্থবির করে দিচ্ছে।

আরেকটি বিপদ পুরো জগতকেই অলক্ষ্যে গ্রাস করতে চলেছে, তা হলো বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো বিষয়। ক্রনিক রোগের মতো তা সামগ্রিক শক্তি উৎপাদন, পরিবহণ ও ব্যবস্থাপনাকে  আকস্মিক বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে আর মানবজীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড ধ্বস সৃষ্টি করতে পারে।

বিশ্বের বা কোনও কোনও দেশের আর্থিক মন্দা বৈশ্বিক প্রবাহের বাইরের বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনামাত্র নয়। নয় কোনও সস্তা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরের বিষয়। হয়তো কোনও কোনও দেশের সুশাসনের ক্ষয়, ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা ও দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত আর্থিক মন্দাকে ত্বরান্বিত ও প্রকটিত করছে। তথাপি বিপদের কেন্দ্রবিন্দু একাধিক ও বৈশ্বিক, এটাই বাস্তবতা।

ফলে বৈশ্বিক পদক্ষেপের সম্মিলিত উদ্যোগ আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলার প্রধান অবলম্বন। তাছাড়া, বিভিন্ন দেশ বিপদের আঁচ আগাম টের পেয়ে ব্যয় সঙ্কোচন, দুর্নীতি ও সিস্টেম লস কমানো, বাজার মনিটরিং-এর মাধ্যমে মজুদদারি ও সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের প্রকোপ কমাতে সচেষ্ট হচ্ছে।

ব্যক্তিগত পর্যায়েও ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার সীমিতকরণ ও বিকল্প দ্রব্যসামগ্রীর সন্ধান চলছে বিশ্বের দেশে দেশে।  কঠিন এক আর্থিক দুর্গতির করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতন পদক্ষেপের নানা মাত্রাও উন্মোচিত হচ্ছে।

অতএব, বৈশ্বিক ও জাতীয় পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতির প্রতি তীক্ষ্ণ নজরদারি, নিজস্ব বাজারব্যবস্থার জন্য টেকসই নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন, বিকল্পের সন্ধান করা সকল রাষ্ট্রের জন্যেই বর্তমানে এক জরুরি কর্তব্য রূপে বিবেচিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিতর্ক ও পারস্পরিক দোষারোপের মাধ্যমে কোনও দেশের পক্ষেই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দিগন্তে ঘনায়মান দুর্যোগের কালো মেঘের প্রবল বিপদ থেকে নিষ্কৃতি সম্ভব হবে না।

ড.মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর