চট্টগ্রাম শহরের গা-ঘেষাঁ সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণজনিত কম্পনের আওয়াজ এতটাই তীব্র ছিলো যে, আশেপাশের এলাকার অধিকাংশ বিল্ডিয়ের কাঁচের গ্লাস ভেঙে যায়। শহরের কাঁপন ধরায় তীব্র শব্দ। রাতের আকাশ লেলিহান আগুনের দাবানলে জ্বলতে থাকে।
শেষ রাত থেকেই অ্যাম্বুলেন্স আর দমকলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় চট্টগ্রাম শহরের। চট্টগ্রাম মেডিকেলে অসংখ্য গাড়িতে আহত-নিহতের আসা-যাওয়া চলে বিরামহীন। আর্তের আহাজারিতে ভারি বাতাস আচ্ছন্ন করে বন্দরনগরী। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে হাসপাতালে। রক্ত দিতে ছুটে আসে শত শত শিক্ষার্থী।
গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেট পাশে শহর সংলগ্ন সীতাকুণ্ডের ডিপোতে থাকা রাসায়নিক পদার্থবাহী কনটেইনার থেকে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। আগুন একটা কনটেইনার থেকে আরেকটাতে ছড়িয়ে পড়ে। আর এতে মালবোঝাই এইসব কন্টেইনারে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটছে। বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে আশেপাশের এলাকা।
কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নুরুল আলম দুলাল মিডিয়াকে বলেন, 'ওই কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থ ছিলো। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে সেখান থেকেই এই বিস্ফোরণ ঘটেছে।'
চট্টগ্রামেই নয়, বাংলাদেশের বহু স্থানেই আবাসিক ও জনবহুল এলাকায় বিপজ্জনক কারখানা ও গুদাম গড়ে উঠেছে। সেখানে মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার বা সংরক্ষণ হচ্ছে। প্রায়ই সেসব জায়গায় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটছে। মারা যাচ্ছে আশেপাশের নিরীহ মানুষ। পুড়ছে ঘরবাড়ি।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিশাল এলাকা জুড়ে শত শত ডিপো, কারখানা, জাহাজ ভাঙার কাজ চলে। তাতে বহু বিপজ্জনক ও মারাত্মক দ্রব্য ও পদার্থ ব্যবহৃত হয়। মারাত্মক দুর্ঘটনা ছাড়াও এতে দীর্ঘমেয়াদে মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশ ও পাবলিক সেফটি বলতে এসব স্থানে আদৌ কিছু আছে বলে মনে হয় না। থাকলে সাধারণ পণ্য ও বিস্ফোরক দ্রব্য আলাদা রাখা হতো। নীতিমালা ও বিধির আওতায় পণ্য খালাস, সংরক্ষণ ও সরবরাহ করা হতো। তা না হওয়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের জীবন ও অঙ্গহানি হয়েছে। সম্পদের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে।
ডিপোতে সংরক্ষণ ছাড়াও দিনেরাতে মহাসড়কে লম্বা লম্বা কনন্টেনার চলাচল করে। কেউ জানে না, কনন্টেনারের ভেতরে কি আছে? পাশে যাত্রীবাহী বাস, সিএনজি, মানুষ চলছে। কত বড় বিপদ যে দিব্যি চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ যেন তা দেখার নেই।
সীতাকুণ্ডের মতোই মহাবিপদ অপেক্ষমাণ চট্টগ্রাম শহরেও। নাসিরাবাদ দুই নং গেট থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত বিশাল এলাকায় চলছে সিমেন্ট, রড কারখানা। বেবি সুপার, পলিটেকনিক, রুবি গেট, টেক্সটাইল, শেরশাহ, বায়েজিদ এলাকায় বাংলাদেশের তথাকথিত নামকরা রি-রোলিং মিলগুলো। বিশাল আগুনের চুল্লিতে গলানে হচ্ছে ইস্পাত, লোহা। সারাদিন নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার বিশাল অঞ্চলের আকাশে সূর্য ঢেকে রাখে কারখানার কালো ধূম্রবর্ণা বাতাস। বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকর বস্তুর পরিমাণও ভয়াবহ।
অথচ শহরের মাঝখানে নাসিরাবাদের এহেন বিপজ্জনক শিল্পকারখানার পাশেই সেনানিবাস, মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, বহু স্কুল ও আবাসিক এলাকা। এখান দিয়েই শহরের নানা স্থানে যাতায়াত ছাড়াও উত্তর চট্টগ্রামের উপজেলাগুলো এবং দুই পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির প্রধান সড়ক। ফলে এতো জনবহুল ও সচল এলাকায় শিল্পকারখানা থাকা পরিবেশগত ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
শুধু সীতাকুণ্ড বা নাসিরাবাদ-বায়েজিদ এলাকাই নয়, বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দরনগরী হওয়ায় চট্টগ্রামের অলিতে গলিতে, আবাসিক এলাকায় অসংখ্য বিপজ্জনক কলকারখানা গড়ে উঠেছে। পরিবেশ ও পরিকল্পনার তোয়াক্কা না করেই চলছে এদের কার্যক্রম। আগাম ব্যবস্থা না দিলে এসব স্থানেও ঘটতে পারে মারাত্মক বিপদ।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সীতাকুণ্ডের বিভীষিকায় চট্টগ্রামের চরম নিরাপত্তাহীনতার চিত্রটি নগ্নভাবে উন্মোচিত হয়েছে। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। নচেৎ একের পর এক আরও বিপদ আসতে পারে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।