বে-আক্কেল পুটিন ও রিকশাচালক মঈনুদ্দীন

, যুক্তিতর্ক

মো. বজলুর রশিদ | 2023-08-31 13:08:04

অনেক দিন হল মঈনুদ্দীনের সাথে দেখা নেই। সে দিন কলেজ থেকে বেরিয়েই দেখি সে গেটের সামনে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘামে ভেজা শরীর, রুক্ষ চেহারা। আমাকে দেখেই সালাম দিয়ে হাসি মুখ করার চেষ্টা করল কিন্তু সে হাসি আমার কাছে শুকনো ও ক্লান্তিকর মনে হল। সে জানতে চাইল, স্যার, যাইবেন কই? ফাল দিয়া উইঠ্যা পড়েন। একটানে নামায়ে দিমূ। আইজকা রাস্তাঘাটতো মনে লয় জ্যামজট নাইক্যা। আমি তার রিকশায় উঠতে উঠতে বললাম, চলো একটু নিউ মার্কেট ঘুরে আসি। কিছু কেনাকাটার আছে।

মঈনুদ্দীন রিকশা চালাতে শুরু করল কিন্তু একটানে আর যাওয়া হলোনা। চার রাস্তার মোড়ে এসে সে রিকশা থামাতে বাধ্য হলো কারণ যানযট। ছাল চামড়া উঠে যাওয়া কয়েকটি বাস মুখোমুখি হয়ে যানজট তৈরি করে ফেলেছে। সেই সাথে আছে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা, মোটর সাইকেলসহ হরেক রকম যানবাহন। সবাই আগে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু কেউই এগোতে পারছে না। চারদিকে নানা ধরণের যানবাহনের তীব্র শব্দ। এক কথায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। যানযট ছাড়ার অপেক্ষায় ঝিম ধরে রিকশায় বসে থাকলাম।

আচমকা মঈনুদ্দীন বলে ওঠে, এই পুলিশ গুলা স্যার মানুষ না। যে কষ্টটা সারাদিন হেরা করে! আমিও ভাবতে লাগলাম সত্যিইতো এখানে ট্রাফিক বাতির সিগন্যাল রযেছে কিন্তু তার সবই নষ্ট। এতো টাকা খরচ করে এগুলো লাগানোর কি দরকার যদি তা কাজেই না আসে। আমি বললাম, তা তুমি ঠিকই বলেছো। সরকার এত টাকা খরচ করে ট্রাফিক বাতি লাগিয়েছে তা এখন কোনো কাজ করে না। এগুলো কাজ করলে পুলিশের দরকার হতোনা। বিদেশের বড় বড় শহরে সবাই ট্রাফিক বাতি মেনেই গাড়ি চালায়। সেখানে আমাদের দেশের মত ট্রাফিক পুলিশদের গাড়ির যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না। আসলেই আমাদের দেশের বিশেষ করে ঢাকা শহরের ট্রাফিক পুলিশের অবস্থা অমানবিক।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর যানজট ছাড়লে রিকশা চলতে শুরু করে। আমি মঈনুদ্দীনকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি এত দিন ছিলে কোথায়? অনেক দিন দেখি না। উত্তরে সে বলল, তার পরিবারকে সে দেশে রাখতে গিয়েছিল। আমি আবারো জিজ্ঞাসা করলাম পরিবারকে কেনো দেশে রেখে এলে? সে বলল, স্যার ঢাকা শহরে থাকনের মত অবস্থা আর নাইক্যা। জিনিসপাতির যা দাম। তার উপর গত ঈদের পর বাড়ী ভাড়া বাড়াইছে ৫০০ টাকা। এক ঘরের ভাড়ায় এহন দেওন লাগে ৫০০০ টাকা। রিকশার মহাজনরে দেওন লাগে ৫০০ টাকা। যা আয় করি তা দিয়ে স্যার ঢাকাতো থাকন হয়ে উঠল না। তাই বউরে কইলাম, চলো তোমাগোরে গ্যারামতো রাইখ্যা আসি। বউতো রাজী হয় না। শেষে দিলাম এক প্যাদানি। তারপর হেই রাজী হইল। আমি জানতে চাইলাম, প্যাদানি মানে কি মঈনুদ্দীন? সে বলল স্যার, প্যাদানি বুঝেন নাই। হেইডা হইল মাইর। আমি বললাম, স্ত্রীকে মারা তো অন্যায় মঈনুদ্দীন। সে বলল, যাই কন স্যার মাইরের উপর কোনো ঔষুধ নাই। তাছাড়া বিধান আছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না।

রাস্তায় গাড়ীর চাপে রিকশা আস্তে আস্তে চলছিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তো অনেক দিন পরে গ্রামে গেলে, গ্রামের অবস্থা কি? সে বলল, গ্যারাম স্যার আগের মতো নাইকা। পাকা বাড়ী হইছে অনেক। রাস্তাও পাকা হইছে। কারেন্ট লাগছে। ভালই উন্নতি হইছে। আমি ফের জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার বাড়ী ঘরের অবস্থা কি? অনেকদিন তো পরিবার নিয়ে ঢাকা শহরে ছিলে? গ্রামে ঘর বাড়ী আছে? সে বলল, ঘর একখান আছে। তয় ছনের ঘর, মাটির দেয়াল। সেইহানেই পরিবার রাইখ্যা আসছি। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, বলো কি, গ্রামে মাটির ঘর এখনও আছে। সে বলল, মাটির ঘরই তো স্যার আসল। বেজায় ঠান্ডা। টিনের ঘর, ইটের ঘর হইয়ায় তো সর্বনাশ করছে। দ্যাখতেছেন না ক্যামন ঘামতাছি। অত্যাধিক গরম বাড়ছে। আগে স্যার এ্যামন গরম দ্যাখছেন। আমি বললাম তা অবশ্য ঠিকই বলেছ। আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে গেছে। যাকে বলে জলবায়ু পরিবর্তন। গরম, শীত সবই বেড়ে গেছে। অসময়ে বন্যা হচ্ছে। ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। ঝড়, সাইক্লোন হচ্ছে। সামনে অবস্থা আরও খারাপ হবে বলে সবাই অনুমান করছে।

মঈনুদ্দীন বলল, তয় স্যার আমিও ঘর এক খান পাকায় দিমু। গ্রামে এখন এনজিওরা গরীব মানুষগো সমানে টাকা দিতাছে। কিস্তিতে শোধ করন লাগে। বউরে বইলা আসছি এনজিও থোন লোন লইতে। রিকশা চালাইয়া কিস্তিতে টাকা শোধ করুম। এদ্দিন মনে লয় সে সদস্য হইছে। কিছু টাকা জমা হইলেই লোন পাইব। আমি বললাম, ভালো তো। গ্রামে যখন থাকতেই হবে তখন পাকা ঘর বানানোই তো ভাল।

সে আরো জানালো পুলাটারে স্যার মাদ্রাসতো ভর্ত্তি করাই দিছি। হেফজী পড়ব। আমার খুব স্বাদ আছিল পুলায় লেহাপড়া শিইখ্যা ভালো চাকরি করব। তয় স্যার এবারে গ্যারামে যাইয়া দ্যাখলাম বেবাক পুলা ও মাইয়া কলেজথোন পাস দিয়া ঘরে বইস্যা আছে। চাকরি নাইক্যা। আমার এক বোনের মাইয়া গ্রামের কলেজথোন ফাস্টকেলাস পাইয়া এমএ পাস করছে। এনজিওতে চাকরি পাইছে। বেতন কত পাই জানেন নি? দশ হাজার টাকা মাত্র। আমিই তো স্যার লেহাপড়া না জাইন্যা রিকশা চালাইয়া মাসে আয় করি পনের-বিশ হাজার টাকা। আর হেই বিশ বছর ধইরা লেহাপড়া শিইখ্যা বেতন পাই দশ হাজার টেকা। কন স্যার, অ্যাত বছর ধইরা লেহাপড়া শিইখতে হের যে খরচ হইছে তা কি উঠব? হের লাইগ্যাই মাদ্রাসার হুজুরে কইলো পোলারে মাদ্রাসাতো ভর্ত্তি কইরা দ্যাও মিয়া। পুলাই হাফেজ হইব। তোমারও সওয়াব হইব। ঠিক করছি কি না স্যার? আমি বললাম ঠিক- বেঠিক বলা মুস্কিল মঈনুদ্দীন। রিকশা চালাও।

তবে সে কথা বলতেই থাকল, বলল গ্যারামেও এখন শান্তি নাই স্যার। রাজনীতি নিয়া ঝামেলা লাইগায় আছে। তার ওপর এবার গিয়া শুনি মেম্বারের পুলায় এক মাইয়ারে বেইজ্জতি করছে। পাবলিকে দিছে ধোলাই। খাইছে কেস। এই নিয়া স্যার বিরাট যন্ত্রণা। পোলার বাপেরও ক্ষ্যামতা কম না । আবার যারে বেইজ্জতি করছে হের বাপ-চাচাগো ক্ষামতাও কম না। এই নিয়া বাধছে ক্যাচাল। আমি বললাম সারা দেশেইতো ক্যাচাল মঈনুদ্দীন। তুমি রিকশা চালাতে থাক।

মঈনুদ্দীন আমার কথা শুনল কি না বুঝলাম না, সে প্রশ্ন করল স্যার এই পুটিন ব্যাটাই কেডায়? আমি বললাম কেনো, তুমি জেনে কি করবা, সে হচ্ছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে সারা বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট। মঈনুদ্দীন বলল, ওই ব্যাটা পুটিন একটা বেয়াক্কল স্যার। হের লাইগাই যুদ্ধ বাধছে। জিনিসপাতির দাম বাড়ছে। আমার পরিবারকে দেশে যাইতে হইছে। দুই বছর ধইরা আল্লার গজব লাগছে। কত মানুষ মইর‌্যা গেছে। আর ওই ব্যাটা পুটিন হের মইধ্যেই যুদ্ধ বাধাইছে। বেয়াক্কল না হইলে হেইডা কেউ করতে পারে কন স্যার। আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। নিউ মার্কেট এসে গেলাম। ভাড়া দিয়ে মঈনুদ্দীনের দিকে সান্ত্বনার দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে নিউ মার্কেটের জনারণ্যে মিশে গেলাম।

মো. বজলুর রশিদ, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর