বাবরের বদলে বউ, গ্রেনেড কথা কও

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-28 09:02:21

আওয়ামী লীগের প্রাথমিক মনোনয়ন দেখার পর আমি 'বদির বদলে বধূ, লাউয়ের বদলে কদু' শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। বিএনপির প্রাথমিক ঘোষণার পরও একই অনুভূতি হয়েছে। কোনো চমক নেই। আগের শিরোনামে বদির বদলে অন্য একটি নাম বসিয়ে দিলে একই শিরোনামে আরেকটি লেখা লিখে ফেলা যায়। যেই লাউ, সেই কদু। তবে আমার আগের লেখায় এক ফেসবুক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিলেন 'বাবরের বদলে বউ, গ্রেনেড কথা কও' শিরোনামে যেন একটি লেখা লিখি। এই লেখার জন্য তার শিরোনামটিই আমার পছন্দ হয়েছে।

বিএনপি ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে। ১/১১এর দুই বছর পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি হেরেছিল শোচনীয়ভাবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। এবার তাই তাদের দলে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৩০০ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন ৪ হাজার ৫৮০ জন। বিএনপি একেক আসনে ২ জন বা ৩ জন করে প্রায় ৮০০ জনের নাম প্রাথমিকভাবে ঘোষণা করেছে।

মনোনয়ন তালিকা দেখে বোঝা গেছে, গত ১২ বছরে তারা কোনো শিক্ষা নেয়নি। অতীতের সব ভুল স্বীকার করে, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোনো আকাঙ্খা নেই মনোনয়নে। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকার সময় যাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল, যারা জঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক, বিভিন্ন সময়ে যারা বিভিন্ন অপরাধে দণ্ডিত; তাদের সবাই আছেন মনোনয়ন তালিকায়। কোনটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দণ্ড, কোনটা সত্যি; তা নিয়ে তর্ক হতে পারে; তবে সাধারণ মানুষ কিন্তু জানে, কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা।

১/১১এর সময় সংস্কারপন্থী হওয়ার অপরাধে যারা দলের বাইরে ছিলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে ফিরে এসেছেন তারাও। আর দণ্ড বা অন্য কোনো জটিলতায় কেউ নির্বাচন করতে না পারলে তাদের স্ত্রী বা সন্তানদের বিকল্প প্রার্থী রাখা হয়েছে।

রাজশাহীর ব্যারিস্টার আমিনুল হক, নাদিম মোস্তফা আর নওগাঁর আলমগীর কবিরের সরাসরি পৃষ্ঠপাষকতায় উত্থান ঘটেছিল বাংলা ভাই আর শায়খ আব্দুর রহমানের। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটে। বিএনপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ এই জঙ্গী পৃষ্ঠপোষকতা। সে অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ছিল এবার। বিতর্কিতদের মনোনয়ন দিয়ে সেই সুযোগটি তারা হেলায় হারালো।

বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর জোট নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু তাতে থোরাই কেয়ার বিএনপির। যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামী এবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায় বিএনপির কাঁধে চড়ে। জামায়াত তো না হয় জোটসঙ্গী। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যরা আছেন বিএনপিতেই। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া জয়পুরহাটের আব্দুল আলিমের ছেলে ফয়সাল আলিম মনোনয়ন পেয়েছেন।

২ বছরের বেশি দণ্ড হওয়ায় এবার নির্বাচন করতে পারবেন না বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সাদেক হোসেন খোকা, মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ, আমানউল্লাহ আমান, ডাঃ এ জেড এম জাহিদ হোসেন, মসিউর রহমান, আব্দুল ওহাব, ওয়াদুদ ভুঁইয়ারা। এই ওয়াদুদ ভুঁইয়ার অত্যাচারে খাগড়াছড়ি পরিণত হয়েছিল বিচ্ছিন্ন জনপদে। বগুড়ায় শোকরানা ছিলেন আতঙ্কের নাম। বিতর্কিতরা বাদ পড়লেও মনোনয়ন থাকছে তাদের পরিবারেই। ব্যারিস্টার রফিকের স্ত্রী বা সাদেক হোসেন খোকা ও আমানউল্লাহ আমানের ছেলের নাম আছে মনোনয়ন তালিকায়। নিজের দলের বিতর্কিতরা তো আছেনই, আওয়ামী লীগ থেকে শেষ মুহূর্তে ডিগবাজি খেয়ে আসা বিতর্কিত গোলাম মাওলা রনিও পেয়েছেন বিএনপির মনোনয়ন।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় দুটি অভিযোগ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান। এই দুই ঘটনারই মূল কারিগর তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজজামান বাবার ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কারাগারে। তাই তার নির্বাচন করার সুযোগ নেই। কিন্তু তার আসনে মনোনয়ন পাচ্ছেন তার স্ত্রী শ্রাবণী। তার মানে বন্ধু হাসান আহমেদের শিরোনামটিই যথার্থ, 'বাবরের বদলে বউ, গ্রেনেড কথা কও'।

বিএনপির সামনে সুযোগ ছিল জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষক, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী, যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্য, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান, গ্রেনেড হামলার সাথে জড়িতদের বাদ দিয়ে নতুন মুখ দিয়ে নতুন রাজনীতির পথে যাত্রার। কিন্তু তা হয়নি। সেই পুরোনো মুখ নিয়ে, আবার সেই পুরোনো রাজনীতির পথেই বিএনপি।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর