দুর্যোগে ‘দিকনির্দেশক’ সামাজিক মাধ্যম

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-09-01 19:01:54

সিলেট-সুনামগঞ্জ যখন ভাসছিল সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল এক দাবি- ‘উদ্ধারে সেনাবাহিনী নামান, সেনাবাহিনী নামান’। সেনাবাহিনী নামানোর এই দাবিকে প্রথমে এত গুরুত্ব দিতে মন সায় দেয়নি, কারণ দূর থেকে বোঝার উপায় ছিল না আমাদের কতখানি ভয়াবহ পরিস্থিতি। তখন পর্যন্ত সিলেটের আমাদের অঞ্চলটা ততখানি আক্রান্ত হয়নি যতটা হয়েছে এর কিছু পর। কেবল সুনামগঞ্জ নয়, সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ-গোয়াইনঘাটসহ আরও কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছিল আচমকা।

উদ্ধারে সেনাবাহিনীকে নামানোর দাবি যারা তুলছিলেন তারা হয় সুনামগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা নয়তো অন্য কোথাও বাস যদিও তবে তাদের পরিবারপরিজন সুনামগঞ্জে থাকেন। তাদের দেখা অথবা শোনা পরিস্থিতিতে এমন দাবি ওঠেছিল। ভাইরাল দাবির সঙ্গে আক্ষেপ কিংবা অভিযোগ ছিল জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম ততটা গুরুত্ব দিচ্ছে না বন্যাকে যতটা দিচ্ছে অন্য অনেক কিছুকে। উদাহরণ হিসেবে অনেকে টানছিলেন শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি নিয়ে দেশের মিডিয়ার উত্তাপ, জায়েদ খান-ওমর সানী বিষয়ে মিডিয়ার ধারাবাহিক সত্য-কিছুটা সত্য-অসত্য এবং মুখরোচক সংবাদ। তাদের প্রশ্ন ছিল কোনটা গুরুত্বপূর্ণ; মুখরোচক সংবাদ দিয়ে পাঠক আকৃষ্টে উপার্জন, নাকি মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়া লাখো বানভাসি! অনেকেই আবার পদ্মা সেতু নিয়ে চিরায়ত খচখচানির প্রকাশ ঘটিয়েছেন বন্যা ও সেতু নিয়ে তুলনামূলক প্রশ্নে। যদিও ওটা অপ্রাসঙ্গিক, তবু দাবির সঙ্গে খোঁড়া যুক্তি ওমনই; হয়তো এটা সংক্ষুব্ধজনের, নয়তো এটা চিরায়ত বিরোধিতার!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে একের পর এক তথ্য আসার প্রেক্ষিতে জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম দৃষ্টি দিতে শুরু করে। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। শেষ পর্যন্ত দুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়। তার আগেই ভেসে গেছে সুনামগঞ্জ। বিচ্ছিন্ন হয়েছে সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে সিলেট-সুনামগঞ্জের দুই জেলার অন্তত নব্বই শতাংশে, মোবাইল-ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে আদতে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যায় দুই জেলার লাখ লাখ মানুষ। জাতীয় গ্রিড লাইনের কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পানি ওঠেছে, বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। এরপর সেনাবাহিনী, সিটি করপোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিদ্যুৎ ফেরানোর পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। এখানে সামাজিক মাধ্যম আলোচনা জারি রেখেছে বলে সকল পর্যায়ের সকল দায়িত্বশীলদের আরও দায়িত্বশীল হয়।

দুর্গত এলাকায় বাঁচার আকুতি, ত্রাণের হাহাকারের সবটাই সামাজিক মাধ্যম কাছ থেকে দেখেছে, তুলে এনেছে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা অন্তর্জালে প্রকাশের কারণে স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের প্রশাসন মনোযোগী হয়েছে। কাজে গতি এসেছে। প্রাথমিক সীমাবদ্ধজনিত ব্যর্থতা কিংবা দায়সারা কাণ্ড আস্তে আস্তে দূরীভূত হয়েছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। ত্রাণের জন্যে হাহাকারের তথ্য সামাজিক মাধ্যমে আসার পর বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগ জোরদার হয়েছে। এখন ফেসবুক খুললেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সচিত্র তথ্য মিলছে। নানা প্রান্তের মানুষজন উদ্যোগী হয়েছেন, টাকা তুলছেন, ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন দুয়ারে-দুয়ারে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে শুকনো খাবার, শিশু খাদ্য, স্যানিটারি ন্যাপকিন, ওষুধ অনেক কিছুই আছে এই তালিকায়। দুর্যোগে নারী-শিশুরা যেন সামান্য হলেও উপকৃত হয় এমন লক্ষ্য অনেকের। সচেতনতার এমন নজির এও বলছে যে এই ত্রাণ কার্যক্রম করুণা নয় মোটেও, এটা মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসার উপহার।

কারা দিচ্ছে, কারা নিচ্ছে—এটা মুখ্য নয়; মানুষের দুর্দিনে মানুষই এগিয়ে আসছে। এটাই সত্য, এটাই চিরন্তন। উদ্যোগীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। মানবপ্রেমে উদ্যোগীরা যে পশুপাখিপ্রেমেরও নজির রাখছেন তার প্রমাণও মিলছে। বন্যার সময়ে অভুক্ত হয়ে থাকা কুকুর-বেড়ালদেরও উদ্ধার করছেন অনেকেই। তার নজির আমরা দেখেছি সামাজিক মাধ্যমে। সিলেট নগরে বন্যায় পানিবন্দিদের উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেওয়া অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হয্রত বিনয় ভদ্র নামের একজন একটা কুকুরকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে যখন বলেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য এবং আমরা কুকুর বিড়ালের পাশেও আছি’ তখন সত্যিকার অর্থে চোখে জল এসে পড়ে! গায়ে চামড়ার অনেকটা অংশ খসে যাওয়া দেখতে সুশ্রী নয় এমন একটা কুকুরকে কোমরসমান পানি ভেঙে বুকে জড়িয়ে উদ্ধার করার ভিডিয়ো যখন সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায় তখন নিশ্চিত মানুষ পশু-উদ্ধারেরও তাগাদা অনুভব করে। কেবল বিনয় নয়, এমন আছেন অনেকেই; অনেকেই অনুরূপ কাজ করেছেন।

এই বন্যায় আরও একবার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে মানুষ। যে সামাজিক মাধ্যমের বিরুদ্ধে ‘গুজব আর ভার্চুয়াল ট্রায়ালের’ অভিযোগ আছে সে মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কেবল তারাই নয় আরও অনেকেই আছেন এই দলে। ব্যবহারকারীরা তাদের বিতরণের দৃশ্যগুলো তুলে রাখছেন, অন্যরা সেগুলো দেখে আশ্বস্ত হচ্ছেন, উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন, আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শতভাগ না হলেও বেশিরভাগ লোকের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর পথ খুলেছে। দুর্গম যে সব অঞ্চলে সরকারি সহায়তা পৌঁছায়নি, এর দাবি ওঠছে, সমালোচনা হচ্ছে; এতে করে ব্যক্তি উদ্যোগের ত্রাণগুলো সেখানে পৌঁছানোর লক্ষ্য নির্ধারিত হচ্ছে। এটা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নয় যদিও তবু এখানে শৃঙ্খলা আছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জবাবদিহির জায়গা তৈরি হচ্ছে। অনেকেই উত্তোলিত এবং খরচের হিসাব দিচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে। তবে এর বাইরে কি এখানে নয়ছয় হচ্ছে না? অসৎ উদ্দেশ্যের অনেকেই হয়তো ওখানে আছেন, তারা হয়তো আর্থিক দুর্নীতি করছেন; তবে প্রমাণ যখন এখন পর্যন্ত নাই, তাই আপাতত ওদিকে না যাই, কারণ এই আলোচনা জোরালো হলে সৎ উদ্দেশ্যের মানুষগুলোর সহায়তা কার্যক্রম বিঘ্নিত হতে পারে অর্থের অপ্রতুলতায়।

একসঙ্গে একটা বিশাল এলাকা বন্যা আক্রান্ত হওয়ায় দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের প্রশিক্ষিত বাহিনী না থাকায় স্থানীয় প্রশাসন শুরুতে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। তারা সেনাবাহিনীকে দিয়ে উদ্ধার অভিযানের দাবি জানিয়েছে, প্রশাসন সে পথই বেছে নিয়েছে; এছাড়া আর গত্যন্তর ছিল না। ত্রাণের জন্যে জায়গায়-জায়গায় হাহাকারের যে তথ্য এসেছে সামাজিক মাধ্যম হয়ে গণমাধ্যমে সে তথ্যের ভিত্তিতে প্রশাসন উদ্যোগী হয়েছে। দুর্গম যে সকল অঞ্চল ত্রাণের বাইরে ছিল সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ সেখানেও যাচ্ছে। এতে করে লাভবান হচ্ছেন দুর্গতরাই। জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম শুরুতে গুরুত্ব দেয়নি বন্যার যে সংবাদ তারাও এখনও একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করছে, তুলে আনছে দুর্গত এলাকার মানুষের দুর্দশার নানা দিক।

সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যা জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে পৌঁছেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে এসেছেন। দীর্ঘদিন ধরে এলাকামুখী না থাকা একাধিক সংসদ সদস্য সরকারপ্রধানের এমন গুরুত্ব দেওয়ায় এলাকায় ফিরেছেন। প্রশাসনও তৎপর হয়েছে। এদিকে সিলেট অঞ্চলের বন্যা এখন কেবল সিলেটেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। সামাজিক মাধ্যম ও কিছু গণমাধ্যমের অধারাবাহিক সংবাদে জানা যাচ্ছে উত্তর বিশেষ করে কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সেখানেও মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে, ত্রাণ কার্যক্রমের দেখা মিলছে না। সিলেট অঞ্চলের পাশাপাশি দরকার এখন ওদিকেও দৃষ্টিপাত। তা না হলে মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে।

সামাজিক মাধ্যমে ‘ঝড়’ না ওঠলে অনেক কিছুকে হাওয়া হতে দেখেছি আমরা। আবার এই মাধ্যমের ‘ঝড়ে’ অনেক কিছুকে সরকারের গুরুত্বের তালিকায় যোগ করতেও দেখি আমরা। সিলেট অঞ্চলের বন্যা যেমন গুরুত্ব পেয়েছে তেমনি গুরুত্ব পাক অন্য অঞ্চলগুলোর বন্যার ভয়াবহতায় বিপন্ন মানুষেরা। প্রয়োজনে ঝড় ওঠুক, সরকারের দৃষ্টি পড়ুক; বাঁচুক মানুষ, পুনঃপুন মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হোক মানুষ!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর