শিক্ষার বিপথগামিতা ও বিপথগামী শিক্ষা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান | 2023-09-01 18:06:25

এক.
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান ‘ছাত্ররা শিক্ষকদের নৈতিকতা ও সততার উদাহরণ হিসেবে দেখতে চায়, কিন্তু বর্তমান সমাজে আশা করা যায় না’ শীর্ষক জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে ‘বিদ্যালয়ের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ: শিক্ষায় প্রাণের উজ্জীবন’ শীর্ষক এডুকেশন ওয়াচ-২০১৭ প্রতিবেদনে বিভিন্ন পর্যায়ের ১ হাজার ৪০০ শিক্ষার্থী, ৫৭৬ শিক্ষক, ১ হাজার ২৮০ অভিভাবক ও স্কুল কমিটির সদস্যের মতামত নিয়ে প্রকাশ করেছে যে, প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এখন আর নৈতিকতার ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের শিক্ষককে আদর্শ বা অনুকরণীয় মনে করেন না। প্রাথমিকের ৫০ শতাংশ, মাধ্যমিকের ৬৪ ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং ৬৫ শতাংশ অভিভাবক ও প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষকও বিষয়টির সঙ্গে সহমত পোষণ করেন (১০ মে ২০১৮, দৈনিক বণিক বার্তা)।

দুই.
শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষাঙ্গনের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর, অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে কোচিং, কোচিং সেন্টার, গাইড বই, চটকদার হ্যাণ্ডনোট এবং কিছু নামধারী শিক্ষকের মধ্যকার সম্পর্কও অত্যন্ত গভীর। বিষয় দু’টি দুই মেরুর মতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো অত্যন্ত ঘৃণিত ও জঘন্যতম কাজ সংঘটিত হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস মানে হলো- শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষাঙ্গনসহ গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিবেকবোধের জলাঞ্জলি দেওয়া। বড় হতাশা ও দু:খজনক ব্যাপার হলো- প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে কিছু নামধারী শিক্ষকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এই নামধারী শিক্ষকদের নিজেদের কোচিং সেন্টার রয়েছে। নামধারি এই (অ)শিক্ষকদের কোচিং সেন্টারগুলোর মধ্যে এক ধরণের নীরব প্রতিযোগিতা চলে কোন বছরে কোন কোচিং সেন্টার পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফলে কেমন অবদান রাখল। কারণ তার ওপর নির্ভর করে পরবর্তি বছরের শিক্ষা ও কোচিং বাণিজ্য।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- অভিভাবকদের মধ্যে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়ার কি যে আকুতি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীর মায়ের ঘুম থাকে না সারা রাত। আর ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র না নিয়ে বাসায় ফিরলে ওই সব গৃহিণীর মুখে যা আসে তা দিয়ে পরীক্ষার্থীর বাবাকে সম্ভাষণ জানান। এখন সহজেই অনুমেয় যে, এমন মা-বাবার সন্তানদের ভূত-ভবিষ্যতের গতি-প্রকৃতি এবং রূপরেখার গন্তব্য কোথায়?

তিন.
আনন্দহীন শিক্ষা, শৃঙ্খলাহীন শিক্ষাঙ্গন আর নৈতিকতাহীন শিক্ষক দিয়ে একটি জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা কতদূর এগোবে তা সহজেই অনুমেয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, যে শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন নিয়ম-শৃঙ্খলার সাথে যতো বেশি শৃঙ্খলিত সেই শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন তত বেশি প্রশংসার যোগ্য, ফলদায়ক। ছোটবেলায় দেখা একটা ভাঙাসাইকেল, ফুটো সেলাই করে নেওয়া একটি ছাতা আমাদের শিক্ষকদের সম্বল ছিল। বেতন বৃদ্ধিতে সে অবস্থা হয়ত এখন আর নেই। শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গনকে আমরা আকর্ষণীয় করতে পারিনি বলেই সত্যিকার অর্থে ত্যাগী, নিঃস্বার্থ, নিবেদিতপ্রাণ, মেধাবী, প্রতিভাবান তরুণরা আজ শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছেন না। শিক্ষা হচ্ছে- কলুষিত, শিক্ষার্থীরা হচ্ছে- বিপথগামী এবং শিক্ষার বিপথগামিতায় শিক্ষাঙ্গন হচ্ছে- অশান্ত ও শৃঙ্খলাহীন।

গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞান শিক্ষা যাদুঘরে যাবার মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছে। মানসম্মত লাইব্রেরি নেই, বিজ্ঞানাগার নেই, বিজ্ঞানের ভালো শিক্ষক নেই। মেধাবী এবং বিজ্ঞান নিয়ে খেলতে ও খেলাতে পারে এমন শিক্ষকের বড় অভাব আজ গ্রামে।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে আমরা গ্রেডিং পদ্ধতি বেছে নিলাম। সৃজনশীলতা দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার নিভু নিভু দীপ দপ করে নিভিয়ে আধো আলো ছায়ার মধ্যে ফেলেদিলাম। বহুনির্বাচনী (এমসিকিউ) প্রশ্ন দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংক্ষিপ্ত করে আনন্দহীন করে ফেললাম।

দেশের আজ যারা বুদ্ধিজীবী শিক্ষক, রাজনীতিবীদ, নীতি নির্ধারক, আমলা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি এখনকার চেয়ে বড়ই সেকেলে বা অনুপোযোগী ছিল? মোটেও নয়। তাহলে কেন আজ আমাদের এই দশা হবে? ‘পাশ চাই, ফেল নয়’ নির্ভর শিক্ষা থেকে আমাদেরকে বের হতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে দেশে কিশোর, তরুণ ও যুব সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তি দাবানলের মত এবং আশঙ্কাজনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বনাশা মাদকের কারণে কিশোর, তরুণ ও যুব সমাজ একদিকে যেমন মেধাশূন্য হচ্ছে তেমনি আরেক দিকে তাদের মনুষত্ববোধ এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। শিশুর সামাজিকীকরণের প্রধান সূতিকাগার হলো- পরিবার। তাই ঢালাওভাবে শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবস্থাকে দোষারোপ না করে অভিভাবকগণকে আরো সচেতন হতে হবে।

চার.
ইউজিসি’র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ৪০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, ও ১০১টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কবুতর বা হাঁস-মুরগীর খোপের মতো গড়ে ওঠা ক্যাম্পাসবিহীন অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান উন্নীতকরণ, উচ্চশিক্ষার নামে বাণিজ্যিকীকরণের অপচেষ্টারোধ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ, উচ্চশিক্ষাকে যুগোপযোগী ও বহুমাত্রিক ধারায় বিকশিত করা সম্ভব হচ্ছে কি?

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসন, শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে তা সমাধানকরার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাজারে এক ধরণের নোট বইয়ের প্রাচুর্যতা ও হ্যাণ্ডনোটের প্রচলন রয়েছে। যে বইগুলো রচনা, সম্পাদনা ও প্রকাশনার সাথে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষকের সম্পৃক্ততাও রয়েছে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়প্রশাসনের উচিৎ ২০টি থেকে ৩০টি বিষয়ভিত্তিক মৌলিক বই নির্বাচন করে দেওয়া এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিসিএসর মাধ্যমে পরীক্ষিত শিক্ষকগণের উচিৎবিষয়ভিত্তিক মৌলিক বই পঠনে ও লেখায় শিক্ষার্থীদেরকে উৎসাহ প্রদান ও গুরুত্বারোপ করা।

পাঁচ.
শুভ ও বিবেকবোধসম্পন্ন নাগরিক বা মানুষ তৈরির জন্য যে নৈতিক ও ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন- তা শেখানোর মতো শিক্ষকের কি বড় অভাব আজ? মসজিদের ইমাম, মন্দির, গির্জা কিংবা প্যাগোডার পুরোহিত হতে গেলে যেমন বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে হয়, তেমনি শিক্ষক হতে গেলে অবশ্যই বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মেধাবী মানুষ দরকার যারা শিক্ষা নিয়ে খেলতে পারে, খেলাতে পারে এবং মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাঠদানকে মোহনীয় করে রাখতে পারে।

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা যাচাইয়ের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি কলেজসমূহে (নিবন্ধনে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরলিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা) এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি কলেজসমূহে (বিসিএস এর মাধ্যমে) থাকলেও দূর্ভাগ্যজনকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষা) নেই।

আমাদের গভীরভাবে ভাবার সময় হয়েছে যে, বর্তমান সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষা মেধা যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট কি না। একাডেমিক, দর্শনগত, আদর্শগত, নৈতিক দিক দিয়ে দূর্বল মানের শিক্ষক নিয়োগের কারণে মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রটা নষ্ট হচ্ছে, হয়েছে। জ্ঞানের আকাশে উন্মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে শিখছেন না শিক্ষার্থীরা।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সকল অস্পষ্টতা, অসামঞ্জস্যতা ও বৈষম্য দূর করে একটি সুন্দর, সর্বজনগ্রহণযোগ্য, উচ্চতর মান ও বিজ্ঞানসম্মত অভিন্ন নীতিমালা দয়া করে দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য সময়োপযোগি পদক্ষেপ নিলেই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নতুনএক উচ্চতায় উঠবে। গৌরবের ইতিহাস রচিত হবে। তাতে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ও গবেষণার মান রাষ্ট্রকে ছাপিয়ে আর্ন্তজাতিকমানে উন্নীত হবে। আর তাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিচালনা ও সহযোগিতার জন্য, সত্যিকারের উন্নত মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা, মেধাবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর স্বার্থে যথেষ্ট যুগোপযোগীআইন সম্বলিত সম্পূর্ণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতামুক্ত একটি উচ্চশিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।

দয়া করে অধিক মেধাবী, দক্ষ, বিজ্ঞ, গবেষক, এবং সুশিক্ষিত জনবল দ্বারা ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তর করুন। এটা সময়ের দাবি। আমাদের শপথ করাউচিৎ যে, অন্তত: শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক তদবির না করা, নিয়োগ বোর্ডের ও প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা না করা, স্বজনপ্রীতি না করা এবং মেধাবীর সাথে বঞ্চনা-ছলনা না করা।

শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানে তুলে আনতে সময় এসেছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা এবং শিক্ষাকে শৈল্পিক ও বৈশ্বিকমানে উন্নীত করা, শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও জীবন ও জীবিকামুখী করা। মূল্যবোধসম্পন্ন ও বিবেকবান শিক্ষক প্রত্যাশা করার আগে সমাজ ওরাষ্ট্রের প্রচলিত শিক্ষা নীতিমালা, শিক্ষা ব্যবস্থায়ও সময়োপযোগী মৌলিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

এ দেশ ধন-ধান্যে, পুষ্পে, জ্ঞানী আর গুণীতে, শিক্ষায়, গৌরবে, মানবতায়, উদারতায়, মনুষত্ববোধে পরিপূর্ণ হোক তা আমরা সবাই চাই। সে স্বপ্নও দেখি। সব ধরনের প্রভাব ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে জ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার জন্যে এই প্রতিযোগিতার যুগে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বৈশ্বিক যোগাযোগ, শিল্প-সংস্কৃতি, বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্র মানসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো অধিকতর কার্যকর ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প যে নেই তা আমাদের সময় মতো বুঝতে হবে। সোনার বাংলায় মূল্যবোধ, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, মানবিকতার অভাব নেই। অভাব হলো- পরিচর্যার।

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান: পি.এইচ.ডি গবেষক, জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর