আগামী নির্বাচন ও বিরোধিতার রাজনীতি

, যুক্তিতর্ক

ড. প্রণব কুমার পান্ডে | 2023-09-01 08:19:21

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংসদ নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের কৌশল নির্ধারণ করতে ব্যস্ত রয়েছে। সরকারি দল-আওয়ামী লীগ- ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে  যাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। ঠিক তেমনি ভাবে প্রায় ১৫ বছরের অধিক সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি চেষ্টা করছে বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে জয় লাভ করে  ক্ষমতায় আসার জন্য। একই সাথে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলীয় জোট বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে সরকারকে বিব্রত করবার জন্য যাতে তারা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে।

গত রোজার আগে থেকেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বিভিন্ন সভায় ঘোষণা দিয়েছিল যে ঈদের পরে তারা সরকার পতনের আন্দোলন করবে। রোজার ঈদ পার হয়ে কোরবানির ঈদ প্রায় আসন্ন। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে সেই রকম কোন আন্দোলন সংগঠিত করবার প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। কারন তারা খুব ভালোভাবেই জানে যে গত ১৫ বছরের অধিক সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার ফলে এক দিকে যেমন দলীয় সমর্থকরা তাদের উপর আস্থা হারিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের জনগণ তাদের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। এই কারণেই এই রাজনৈতিক জোটের নেতৃবৃন্দ সরকার বিরোধী বিভিন্ন ধরনের প্রপাগণ্ডা এবং অপকৌশলের রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের মনে সরকার বিরোধী একটা অবস্থান তৈরি করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

গত ২৫ শে জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবার পরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলার সাথে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। আমরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ওই অঞ্চলের মানুষের আবেগ এবং আনন্দের বহিঃপ্রকাশ প্রত্যক্ষ করেছি। পদ্মা সেতুকে ঘিরে একদিকে যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের বিজয় উল্লাস রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে সেই অঞ্চলের ১৯টি জেলার মানুষের মধ্যে রয়েছে এক অন্যরকম আনন্দ। সেতুর উদ্বোধনের প্রায় ১০ দিন অতিবাহিত হলেও মানুষের মধ্যে সেতুকে নিয়ে উন্মাদনা এখনো কমেনি। যদিও কিছু ক্ষেত্রে সেই উন্মাদনার মাত্রা অতিক্রম করেছে। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি পদ্মা সেতুতে অত্যন্ত জোরে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে দুই যুবক নিহত হয়েছে- যা কখনো কাম্য নয়। ফলে, সরকার বাধ্য হয়েই পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করেছে।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে এই অর্জন শুধু বর্তমান সরকারের অর্জন নয়, এই সেতুকে জনগণ বাংলাদেশের সক্ষমতা এবং আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসেবে দেখছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই অর্জনকে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে যা অত্যন্ত স্বাভাবিক।  কারণ এই অঞ্চলে দল-মত-নির্বিশেষে ব্যাপক জনগোষ্ঠী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আগামী নির্বাচনে  সমর্থন জানাবে -এই প্রত্যাশা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কারণ এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের কষ্ট লাঘব করেছে তারা। এই সেতুর মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষকে ঢাকাসহ দেশের  অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সাথে খুব সহসাই যুক্ত করা হয়েছে। এই সেতুর মাধ্যমে একদিকে যেমন এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে, ঠিক তেমনিভাবে এই সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন দ্বার উম্মোচিত হবে। আগামী নির্বাচনে এই সেতু বর্তমান সরকারি দলকে অনেকটা এগিয়ে রাখবে বিধায় অন্য দলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফলে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা এবং অর্ধসত্য তথ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এরিই মধ্যে বিএনপির মহাসচিব দাবি করে বেসেছেন যে এই সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তাদের নেত্রী। আবার কখনোবা তারা এ রকম একটি স্থাপনাকে ভারতের একটি ছোট সেতুর সাথে তুলনা করছে। তবে পদ্মা সেতু কেন্দ্রিক এই দলটির অপপ্রচারে জনগণ বিভ্রান্ত হয়নি। জনগণ খুব ভালোভাবেই বুঝেছে যে পদ্মা সেতু নির্মাণ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল-যে চ্যালেঞ্জে বর্তমান সরকার উত্তীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশে এই ধরনের একটি সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর এই আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করার সকল কৃতিত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। 

কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠী খুব উৎফুল্ল হয়েছিল। তারা সেই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিষয় প্রচার করেছিল যে বাংলাদেশের অবস্থা অচিরেই শ্রীলংকার মত হবে।  সে সময় বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি বিবেচনায় নিয়ে স্পষ্টভাবেই বলা যায় যে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে না যা ইতোমধ্যেই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে চার মাস অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এমন কোন আঘাত আসে নি। তবে করোনা অতিমারির ক্ষতির কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে।  আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশ গত দুই বছর যেমন করোনাকে সফলভাবে মোকাবেলা করেছে, আগামী দিনেও সেরকম ভাবেই মোকাবেলা করবে। বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশার মূল কারণ হচ্ছে সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে আজ আমরা এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশের জনগণ।

রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের মূল হাতিয়ার হচ্ছে জনগণের আস্থা অর্জন করা। যে রাজনৈতিক দল জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে তারাই নির্বাচনে বিজয়ী হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে জনগণের সামনে পরিবর্তনের একটি রূপরেখা তুলে ধরতে হয়। গত ১৩ বছরে বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের অর্জন প্রত্যক্ষ করেছে। ঠিক একিই ভাবে রাজনীতির আস্তাকুড়ে বিরোধীদলের নিক্ষিপ্ত হবার প্রক্রিয়া দেখেছে। গত ১৫ বছরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সামনে এমন কোন রূপরেখা উপস্থাপন করতে পারেনি যাতে জনগণ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আন্দোলনে শামিল হবে এবং সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে। যে সকল রাজনৈতিক দল সরকার পতনের আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসবে মর্মে স্বপ্ন দেখছেন তাদের এই বাস্তবতাটা বোঝা উচিত।

এছাড়া বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের যে সংস্কৃতি সেটিও তাদের জন্য বুমেরাং হচ্ছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ বোধ করে। যদিও বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের কারণে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ কমেছে। তার পরেও নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান হবে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে নির্বাচন কমিশন কিংবা নির্বাচন বর্জনই বর্তমান সমস্যার সমাধান নয়। তাদের ক্ষমতায় যাবার জন্য মূলত যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে দলীয় কিছু সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য আওয়ামী লীগ যে রূপরেখা প্রদান করেছে তার বিপরীতে জনগণকে আকৃষ্ট করবার মতো রূপরেখা প্রদান করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে বিরোধী দলগুলো সেই বিষয়গুলো উপলব্ধি না করে শুধুমাত্র বিরোধিতার ক্ষেত্রে বিরোধিতা করছে এবং বিভিন্ন প্রপাগণ্ডা এবং অপপ্রচারের রাজনীতির মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় যেতে চাইছে।

কয়েক মাস আগে যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে সেই নির্বাচন কমিশনে তেমন কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি নেই। যাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে তারা প্রত্যেকেই নিজেদের চাকরি জীবনে খুব স্বচ্ছতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। অতএব এই ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা না রেখে তাদেরকে আস্থায় নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে বিরোধী দলেকে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্তমান  কমিশনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সেই পরীক্ষাতে কমিশন উত্তীর্ণ হয়েছে। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে এবং যিনি ভোটে জিতেছেন তিনিই মেয়র হয়েছেন। ফলে, বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে অপপ্রচার এবং অপকৌশলে রাজনীতি থেকে সরে  এসে গঠনমূলক রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত বিরোধী দলের। একই সাথে সরকারের উচিত কিছুটা হলেও ছাড় দিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করা।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

এ সম্পর্কিত আরও খবর