জোট-মহাজোটের সমীকরণ এবং মৌসুমী ব্যবসা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-24 16:05:57

সবকিছু ঠিক থাকলে নতুন বছরের শুরুতেই দেশে নতুন সরকারের যাত্রা শুরু হবে। নতুনের আবেদন চিরন্তন, বলা যায় নতুনের প্রত্যাশা আমাদের প্রতিদিন নতুন করে বাঁচতে শেখায়। তারপরও আমাদের মনের কোনে থায় যেন সবসময় বিষাদের গোপন সুর বাজতে থাকে। আমাদের উন্নয়নের ধারার সাথে রাজনীতি যথাযথভাবে খাপ খাইয়ে সত্যিকার একটি গণতান্ত্রিক ধারার দিকে নিয়ে যাচ্ছে কি না- সচেতন মানুষের মনে সম্ভবত এই ভাবনাগুলো আজকাল প্রবলভাবে দোলা দেয়।

দেশে নির্বাচন আসছে। রাজনৈতিক দলগুলো তথা নেতাকর্মীদের দলীয় আদর্শের প্রতি আনুগত্যের এক অলিখিত পরীক্ষা দেখছি প্রতিদিন। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিকে বর্তমান দুই জোটে যোগদানে উদ্বুদ্ধ হতে দেখছি। এদের মধ্যে রয়েছে নানাবিধ সমীকরণ। কেউ এমপি হতে চান, কেউ নেতা আবার কেউবা তাদের বিদ্যমান অবস্থানকে সুসংহত রাখতে চান।

রাজনৈতিক দল বা জোটের আদর্শে সত্যিকারভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে এভাবে দলে দলে লোক ভিড় করছেন – একথা আমি মানতে নারাজ, কেননা আপাতঃ দৃষ্টিতে কোনো দল বা জোটের ভেতর আদর্শিক রাজনীতির কোনো অবস্থান নেই। যা আছে তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন রাজনীতি। যে কোনো প্রকারে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করাই এখন মুখ্য বিষয়।

হয়ত নির্বাচন অতিক্রান্ত হবার পর আবারও আদর্শিক রাজনীতির বুলিতে মুখরিত হয়ে উঠবে রাজনৈতিক অঙ্গন। এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা কিছুদিন আগেও নিজ দলের আদর্শের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেছেন, কিন্তু নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ার ক্ষোভে সেই আদর্শ সহসাই পরিবর্তন হয়ে নতুন আদর্শকে ধারণ করে বাকী জীবন পথ চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছেন। এইতো গত সোমবার আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ গোলাম মওলা রনি বিএনপিতে যোগ দিয়েই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নগদ পুরষ্কার হিসেবে মনোনয়নপ্রাপ্ত হয়ে আজীবনের জন্য নিজেকে বিএনপির সেবাদাস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।

অপর আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদ যোগ দিলেন গণফোরামে। তাও কেন এইসময়ে? কারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে যেকোনভাবে একটা মনোনয়ন ফরম দরকার। সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং এক এগারোর আলোচিত ব্যক্তি মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি উভয় দল থেকেই মনোনয়ন সংগ্রহ করলেও জাতীয় পার্টি অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাঁকে নগদে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে পুরস্কৃত করে মনোনয়নের নিশ্চয়তাও দিয়েছে। অর্থাৎ, দলের রাজনীতি নয়, এমপি হয়ে মনের খায়েস মেটানোই হচ্ছে বড় বিষয়।

তবে এত কিছুর পরেও কখনও কখনও কারও কারও দলের প্রতি আনুগত্য এবং আস্থা দেখলে ভাল লাগে। সাবেক ডেপুটি স্পীকার শওকত আলীর ছেলে ডাঃ খালেদ শওকত আলী দলের মনোনয়ন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরও তার বাসায় সমবেত ক্রন্দনরত মানুষকে সান্ত্বনা দিয়ে দলের আদর্শের জন্য কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে দলকে আবারও ক্ষমতাসীন করতে সকলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। রাজনীতিতে এধরণের আত্মত্যাগ আজকাল বিরল।

গত কিছুদিন ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবং তাদের ১৮ দলের শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করা নিয়ে জটিলতার রেশ কাটেনি। এক্ষেত্রে ১৪ দলীয় অপর শরিকদের সাথে তাদের সমস্যা না হলেও জাতীয় পার্টির জন্য বরাদ্দ করা আসন নিয়ে এরশাদ খুশী হতে পারেননি। মঙ্গলবার রাতে জানা গেল পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ অসুস্থতাজনিত কারণে সিএমএইচ এ ভর্তি হয়েছেন। এর কয়েকদিন আগেও তিনি সেখানে ভর্তি ছিলেন। এমন একটা সময়ে তার এই অসুস্থতাকে সঙ্গত কারণেই অনেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনপূর্ব সময়ে সিএমএইচ এ অবস্থান করার সাথে তুলনা করছেন। এদিকে বনানীর পার্টি অফিসে দলের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা মহাসচিবের সাক্ষাত পাচ্ছেন না। শোনা যাচ্ছে মনোনয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেকের সাথে মোটা অংকের আর্থিক লেনদেন হয়েছে। এই অবস্থায় সোমবার রাতে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ৪৭ জনের নাম উল্লেখ করে একটি তালিকা দেয়া হলেও বাস্তবে অন্ততপক্ষ্যে ১৫টিতে আওয়ামীলীগ তাদের নিজস্ব প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। কথিত আছে এর আগের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে যেসকল আসনে ছাড় পেয়েছিল সেগুলোতে প্রার্থীদের জনপ্রিয়তার নিরিখে নয়, আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। জোটগত নির্বাচনের সুফল হিসেবে এদের অনেকেই সেইসময় বিজয়ী হয়ে আসেন।

কেবল ক্ষমতাসীন হওয়ার তাগিদে জোটগত রাজনীতি এখন এমন এক অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে যে এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলো খুব শীঘ্রই চরম অস্তিত্বসংকটে ভুগবে সন্দেহ নেই। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আনুমানিক ৭০টি এবং বিএনপি ৬০টি আসন জোটভুক্ত অপরাপর দলগুলোকে ছেড়ে দিচ্ছে। উভয়ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে সকল আসনগুলোতে তাদের প্রার্থীদের স্থলে জোটের অপর শরিকদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে সেখানে দলীয় নেতাকর্মীরা চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে জ্বালাও পোড়াও করছে।

অনেক ক্ষেত্রে দলের ত্যাগী নেতাদের মনোননয়ন না দিয়ে ক্ষুদ্র দলগুলোকে পাশে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার তাগিদ থেকে যেভাবে অনেক দলীয় নেতাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে এতে এবারের নির্বাচনে খেসারত কতটুকু দেয়া লাগতে পারে সেটা অস্পষ্ট হলেও ভবিষ্যতে এর অবশ্যম্ভাবী সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।

এক্ষেত্রে বিএনপির বিগত নির্বাচন বর্জন করার ফলে স্থানীয় পর্যায়ের অনেক হতাশ নেতাকর্মীর এবারও মূল্যায়ন না হওয়াতে সাংগঠনিকভাবে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোকে কঠিন করে তুলবে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও অনেক নির্বাচনী আসনে বারবার নিজ দলের বাইরের দল বা প্রার্থীর জন্য আসন ছেড়ে দেয়ার ফলে তাদের ভোটব্যাংকে এর প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে তাদের দুর্গ বলে খ্যাত এমন অনেক আসন রয়েছে যেখানে জোটের স্বার্থে এধরণের আত্মত্যাগ অনেকটা রাজনৈতিক আত্মহত্যার সামিল।

বর্তমান সংসদে বাম দলগুলোর যে কয়জন সাংসদ রয়েছেন এদের কেউই অতীতে তাদের দলগত বা ব্যক্তিগত ক্যারিসমার বলে সাংসদ হয়ে আসতে পারেননি; বরং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অতীতে তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এধরণের কিছু ব্যক্তির প্রতি আওয়ামী লীগের অসীম মমত্ববোধের ক্রমাগত খেসারত দিতে হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ের ত্যাগী নেতাদের। এছাড়াও সবমিলিয়ে মহাজোটের ব্যানারে অপর দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়ার ফলে নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন দলের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে।

সম্প্রতি বিএনপি নেতা ডঃ খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং ডঃ এমাজ উদ্দিনের মধ্যকার ফোনালাপের অডিও ফাঁস হয়, যেখানে তাদের ঐক্যফ্রন্টের বিভিন্ন দল এবং নেতাদের নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করতে শোনা যায়। এই আলাপের মূল বিষয় ছিল এধরণের ঐক্য করে কি লাভ হল এবং এর ফলে অনেক জায়গায় তাদের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে এমন কিছু আসন নামসর্বস্ব দলের কিছু নেতাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, যাদের অতীতে নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নেই অথবা নির্বাচন করতে গিয়ে জামানত পর্যন্ত হারিয়েছেন।

আসলে এই জোট মহাজোটের সমীকরণের মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে এবং সরকার পরিচালনায় পর্যন্ত উঠে আসছে আমন কিছু ব্যক্তিত্ব, যারা রাজনীতিতে অনেকটাই অচ্ছুৎ। এদের কাছে রাজনীতি অনেকটা হয়ে উঠেছে মৌসুমী ব্যবসার মত। ব্যবসার হিসেব কষে যখন যে দিকে ঝোকা দরকার তখন সেদিকেই ঝুঁকছেন তারা। আমার মনে হয় এই সকল সুবিধাবাদী মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রাজনীতিকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠিত বড় দুই রাজনৈতিক দলের।

নির্বাচনকে উপলক্ষ করে জোট হবার চেয়ে সরকার গঠনের সময় এধরণের জোট হলে নির্বাচনকালীন সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বীয় নেতা কর্মীদের মূল্যায়ন করতে পারেন। সবার মনে রাখার দরকার নির্বাচনের পূর্বে সাধারণ মানুষও অপেক্ষায় থাকেন তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের মূল্যায়ন হচ্ছে এটা দেখার জন্য। আমরা সচেতন মানুষ, যাদের বেশীরভাগই মূলত দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থক তারা কোনভাবেই যেনতেনভাবে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হোক এটা দেখতে চাইনা। কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা জোটগত অপরাপর দলকে সাথে রাখার প্রয়োজনে নিজের দলের অস্তিত্ব এবং মূল আদর্শ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে কি না সেটা ভেবে দেখা জরুরি।

ফরিদুল আলম:  সহযোগী অধ্যাপকআন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানেবেইজিং এর ইউআইবিই-তে উচ্চশিক্ষারত

এ সম্পর্কিত আরও খবর