মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ভূমিকা প্রত্যাশিত নয়

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. সুলতান মাহমুদ রানা | 2023-08-24 04:20:40

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত মোট ৩৯টি দলই আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। খবরটি গণতন্ত্রের স্বার্থে অনেকটা সুখের। কারণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার হার যখন সবচেয়ে বেশি হয় গণতন্ত্র তখন বেশি পরিশুদ্ধ হয়। তবে এক্ষেত্রে শুধু সব দলের অংশগ্রহণই নয়, নির্বাচনকেও হতে হবে অবাধ এবং নিরপেক্ষ। আর এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ওই নিরপেক্ষতার প্রশ্নটিই ঘুরপাক খাচ্ছে।

যেকোনো রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। আর বাংলাদেশে নির্বাচনই একমাত্র বৈধ পদ্ধতি যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া যায়। অবশ্য গণতন্ত্রে নির্বাচন এমন একটি ব্যবস্থা যা কেবল একটি সরকারকে নির্বাচিত করে না, পাশাপাশি নির্বাচিত সরকার আইনের শাসন সম্বলিত, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ধারক, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সংরক্ষক, সমবেত হওয়ার সুযোগের নিশ্চয়তাদানকারী, নিজ নিজ পছন্দমত ধর্মচর্চা করার সুযোগ দানকারী এবং সম্পত্তির সংরক্ষক হিসেবেও কাজ করে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখে সুশাসন প্রতিষ্ঠার শ্লোগান বজায় রাখে।

একটি নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো একটি দল বা জোট ক্ষমতায় আসতে পারে আর বাকিগুলো আসতে পারে না। যেসব দল ক্ষমতায় আসতে পারে না সেসব দল বা জোটের কোনোটি বিরোধী দলে থাকে, আবার কোনোটি থাকে না। নির্বাচন-পূর্ব নানা প্রতিশ্রুতিতে তারা নির্বাচনে অংশ নিলেও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী বৈতরণী পারি দেয়াকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়। এ কারণে অনেক সময় তারা ভুলে যায় তাদের প্রতিশ্রুতির কথা। আবার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে না পারলে ভূমিকা এক ধরনের আর ক্ষমতায় আসতে পারলে ভিন্ন ধরনের।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবগুলো গণতান্ত্রিক সরকারের সময়েই এবং বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের নেতাদের ক্ষেত্রে একই অবস্থা অবলোকন করেছি। সাধারণত নির্বাচন-পরবর্তী কোনো গণতান্ত্রিক অঙ্গীকারই যথাযথভাবে রাজনৈতিক দলগুলো মানতে চায় না।

৯০’পরবর্তী প্রায় প্রতিটি সরকার শেষেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দেশে সংঘাত ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। কখনো সংকট থেকে সুষ্ঠু উত্তরণ ঘটেছে আবার কখনো রাজনৈতিক ঘোলাটে পরিবেশ জাতির জন্য চরম দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে এবং মেয়াদ শেষ করে ক্ষমতা থেকে চলে যায়। এখন যে দল ক্ষমতায় আছে ভবিষ্যতে এই দল ক্ষমতায় নাও আসতে পারে। আবার এখন যে দল ক্ষমতায় নেই সেই দলই ক্ষমতায় আসতে পারে। এক্ষেত্রে উভয় দলেরই পারস্পরিক কিছু ‍ভূমিকা থাকা দরকার। বিরোধী দল থেকে সরকারি দল হলে প্রতিশোধের মাত্রা যেমন থাকা উচিত নয় তেমনি বিরোধী দলে গেলে সংসদ বর্জনসহ অন্যান্য অগণতান্ত্রিক ভূমিকা পরিত্যাগ করা উচিত।

দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই আনতে পারেনি। রাজনীতিবিদরা তাদের প্রদত্ত গণতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকার করা হয় কিন্তু গণতন্ত্র কিংবা গণতান্ত্রিক পরিবেশ কোনোটাই রক্ষিত হয় না। বাংলাদেশে নির্বাচনের উদ্দেশ্য হলো গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা, কারণ গণতন্ত্র আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেকোন মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।” সত্যিকারের গণতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক শাসনের কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভর করে সরকারের আচরণ ও কার্যক্রমের ওপর। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের দায়িত্বও কম নয়।

সংসদ নির্বাচনের পূর্বে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রসম্মত অঙ্গীকার। রাজনৈতিক বিরোধিতার জের ধরে, বিরোধী দলের নেতার নামে প্লেট চুরির মামলা কিংবা ককটেল ফাটানোর মামলায় দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতাকে কারাগারে প্রেরণের সংস্কৃতি গণতন্ত্রের নমুনা নয়। গণতন্ত্রে বিরোধী দলও সাংবিধানিক মর্যাদা পায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সরকারি ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিরোধী দলের যথাযথ মান রাখে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে আজ একই কণ্ঠে অঙ্গীকার করতে হবে যে, তারা আজ যে সমঝোতা এবং প্রতিশ্রুতি দিবে তা আগামী দিনেও যথাযথভাবে মেনে চলবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে হতে হবে স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ এবং গণতন্ত্রমনা।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিশ্রুতি দেয় ঠিকই কন্তু তা রক্ষায় তাদের সফলতার পরিমান খুবই কম। সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও দলতন্ত্র ও ফায়দাতন্ত্রের লাগামহীন চর্চার ফলে তারা যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।

রাজনৈতিক দলগুলো দেশ ও সমাজ গঠনের কোনো আদর্শভিত্তিক পরিকল্পনা কিংবা বক্তব্য দেয় না। ক্ষমতায় যাওয়াই হলো দলগুলোর সর্বশ্রেষ্ঠ লক্ষ্য। রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় সন্ত্রাস ও দুর্নীতি এখন রাজনীতির বড় নিয়ামক। এখানে নির্বাচন হয়, মনোনায়ন হয় কিন্তু কীভাবে হয় সেটা একটু বিশ্লেষণ করলেই এর প্রকৃতি অনুধাবন করা যায়। নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নির্ধারক কিংবা নীতিমালা নেই। দুর্নীতিবাজ, বিতর্কিত ব্যত্তিদেরও মনোনয়ন দেয়া হয়। একবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে বারবার মনোনয়ন পাওয়ার মাধ্যমে সংসদ সদস্য হওয়ার নেশায় মত্ত থাকে। আবার মনোনায়ন না পেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শে গিয়েও মনোনয়নের ব্যবস্থা করতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করে না।

আসলে এই পরিবেশ তৈরি না হওয়ারও কোনো কারণ নেই। কারণ বাংলাদেশে যেভাবে একজন বিত্তশালী ব্যক্তি হাট কিংবা বাজার ইজারা নিয়ে থাকে সেভাবেই দেশের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। একজন বিত্তশালী ব্যক্তি হাট বা বাজার ইজারা নেন এ জন্য যে কয়েক বছর পর সেখান থেকে তিনি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা মুনাফা করবেন। আর রাজনীতিবিদদেরও এমন মুনাফার চিন্তা এবং দেশের অসচেতন নাগরিকদের ভোটের রাজনীতিতে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করার সুযোগ পেয়ে যাওয়াও এর অন্যতম কারণ।

কাজেই মনোনায়ন থেকে শুরু করে রাজনীতির প্রতিটি স্তরে দলের অভ্যন্তরে প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিবাচক ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছুটা শুদ্ধ পথে হাঁটার পথ আবিস্কার হতে পারে। এজন্য নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই সমস্বরে অঙ্গীকার করতে হবে।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর