নারায়ণগঞ্জে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন। ‘নিহত’ নয়, বলা যায় ‘খুন’ হয়েছেন। নিহত শব্দেও যেমন প্রাণের অপচয়ের পরিণতি ধারণ করে, তেমনি খুনও; তবে খুন শব্দের সঙ্গে বীভৎস, অমানবিক, মানবতাবিরোধি অন্তর্গত অর্থের যোগ রয়েছে বলে একে খুন বলাই সংগত। নিহত যুবকের নাম শাওন প্রধান। সে জাতীয়তাবাদী যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করছে বিএনপি, যদিও খুন হওয়া যুবকের ভাই বলছেন শাওন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। আবার স্থানীয় আওয়ামী লীগ বলছে, শাওন যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। শাওন প্রধান যুবদল কিংবা যুবলীগ যে দলেরই কিংবা রাজনীতির সঙ্গে নন বলে পরিবারের দাবি থাকলেও প্রকাশিত একটা ছবি বলছে মিছিলের সম্মুখভাগে শাওন ছিলেন। এখানে তার রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে অমানবিক টানাটানি হলেও এই পরিচয়কে গৌণ ভাবছি, কারণ তার জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে, পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানোর মাধ্যমে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ঘোষিত কর্মসূচি ছিল নারায়ণগঞ্জেও। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী মিছিল প্রথমে পুলিশি বাধার মুখে পড়েছে, বচসা হয়েছে, ধাওয়া পালটা ধাওয়া, ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, পুলিশের লাঠিচার্জ হয়েছে, টিয়ারশেল নিক্ষিপ্ত হয়েছে পুলিশের কাছ থেকে; ঘটনার এতটুকু পর্যন্ত স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে মনে করা যেত, কিন্তু এরপর এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি করেছে। পুলিশের গুলি লেগেছে শাওনের বুকে। প্রাণ গেছে গুলিতে। এই প্রাণ হরণের ঘটনা আগের সব বিক্ষিপ্ত কিংবা স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি অথবা পুলিশের রুটিন ভূমিকাকে পেছনে ফেলে দেয়। কারণ ওই ঘটনায় একজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মানুষের মৃত্যুর মতো ঘটনার পর অন্যকিছু আর আলোচনায় জায়গা পাওয়ার কথা না।
এটা পুলিশ কর্তৃক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এটা পুলিশ বাহিনী কর্তৃক বিনাবিচারে মানুষ হত্যা। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গুলি করে মানুষ হত্যা। অথচ এই হত্যার অধিকার পুলিশের নেই, কারো নেই। এদিকে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমসহ নানা জায়গায় কিছু লোক বলতে চাইছে, ‘আত্মরক্ষার অধিকার কি পুলিশের নেই?’ হ্যাঁ, আত্মরক্ষার অধিকার পুলিশের আছে, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই মানুষের বুক লক্ষ্য করে গুলিয়ে চালিয়ে নয়। অথচ নারায়ণগঞ্জের সেটাই হয়েছে।
এই ঘটনার পর অনেকেই পুলিশকে লক্ষ্য করে বিএনপি নেতাকর্মীর বৃষ্টির মত ইটপাটকেল নিক্ষেপের ভিডিয়ো প্রচার করে মানুষ হত্যার ঘটনাকে ‘জায়েজ’ করতে চাইছেন। স্রেফ রাজনৈতিক কারণে মানুষ পরিচয় হারানো অমানবিক এই প্রচেষ্টা। মানুষের জীবনের কোন মূল্য নেই তাদের কাছে, অথচ আওয়ামী লীগ-বিএনপির পরিচয় বাদ দিলে তারাও তো মানুষ। আর মানুষ হয়ে কীভাবে আরেক মানুষ হত্যার সমর্থন করা যায়? ‘আত্মরক্ষার্থে’ পুলিশ গুলি চালিয়েছে বলছেন যারা তারা হয়তো ভেবে বসে আছেন রাষ্ট্র আত্মরক্ষার্থে পুলিশকে কেবল মারণাস্ত্রই দিয়েছে, আরও অনেক উপকরণ দিয়ে থাকে যা দিয়ে ইটপাটকেল মোকাবেলা করা যায়,আত্মরক্ষা করা যায়। অনেক জায়গায় অনেক ঘটনায় আমরা দেখেও আসছি, এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু ইটপাটকেলের জবাবে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো না।
এমনিতেই পুলিশ, র্যাবসহ নানা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে, হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে র্যাব-পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। খোদ পুলিশপ্রধানও র্যাবে থাকাকালের দায়িত্ব হিসেবে আছেন এই নিষেধাজ্ঞার আওতায়। ওই নিষেধাজ্ঞা তোলার জন্যে সরকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। তবু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। পুলিশপ্রধানের বিরুদ্ধে আমেরিকায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় তার আমেরিকার ভিসা প্রাপ্তিতেও সমস্যা ছিল। জাতিসংঘের এক সম্মেলনে আমন্ত্রিত পুলিশপ্রধানের সম্প্রতি আমেরিকার ভিসা মিলেছে, তবে ভিসা দিতে দেশটি যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলো সম্মানজনক কি-না ভাবাও দরকার। নিউ ইয়র্কে বাইরে যেতে পারবেন না, জাতিসংঘের কোন অধিবেশনের বাইরে অন্য কোন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে কথা বলতে পারবেন না; এইধরনের শর্ত ছিল পুলিশপ্রধানের। এগুলোর কারণ ওই একই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। যদিও আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা তাদের স্বব্যাখ্যেয় তবু ক্রসফায়ারের মতো বিনাবিচারে হত্যার মতো মানবতাবিরোধি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দেশের একাধিক বাহিনী। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে গেলেও এটা মিথ্যা হয়ে যায় না। আমেরিকার ওই নিষেধাজ্ঞার পর দেশে ক্রসফায়ারের ঘটনা বন্ধ হয়েছে সত্য, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে পুলিশের চড়াও হয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা নিয়ে আমাদের সতর্কতার দরকার আছে।
নারায়ণগঞ্জে যে যুবক পুলিশ কর্তৃক হত্যার শিকার হলেন তার রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিন, তিনি যুবদল-যুবলীগ যাই হোন না কেন তার পরিচয় তো মানুষ। আপনার-আমার, এখনও অশনাক্ত হলেও হত্যাকারী পুলিশ সদস্যের মতো তিনিও কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য, তিনিও কোনো না কোনো সমাজের মানুষ। আমাদের যে সমাজ সেখানে এখনও আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াত-হেফাজত-ডান-বামের সহাবস্থান রয়েছে। রাজনৈতিক বিভক্তি দিয়ে সমাজ এখনও বিভক্ত হয়নি, সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হয়নি এখনও কারো, এখনও আওয়ামী লীগের লোকজনের সঙ্গে বিএনপি-জাতীয় পার্টি, এমনকি জামায়াতের লোকজনের আত্মীয়তাও হয়। একে অন্যের জানাজায় যেমন অংশ নেয়, তেমনি অংশ নেয় সামাজিক অনুষ্ঠানেও। সমাজ এতখানি পচে গলে দুর্গন্ধে ভরে যায়নি যে রাজনৈতিক বিভক্তি এতদূর পর্যন্ত গড়াবে। তাহলে কেন কিছু লোক নারায়ণগঞ্জের মানুষ হত্যার জায়েজিকরণে নামবে? বড় অন্যায়, বড় নোংরা, বড় অমানবিক এই জায়েজিকরণ প্রচেষ্টা!
রাজনৈতিক সমর্থনের দিক থেকে আপনি আওয়ামী লীগ হতে পারেন, বিএনপি হতে পারেন, জাতীয় পার্টি হতে পারেন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী দল জামায়াত-শিবিরও হতে পারেন, ধর্মীয় বিভক্তির অপচেষ্টাকারী হেফাজতে ইসলাম হতে পারেন, ডান-বাম-মধ্যপন্থী যেকোনো দলের সমর্থক হতে পারেন; আপনি বুঝতে পারুন আর না-ই পারুন আপনিও মানুষ। মানুষ পরিচয়ধারী একক হিসেবে আপনি মানুষ হত্যা যেমন করতে পারেন না, তেমনি মানুষ হত্যার সমর্থকও হতে পারেন না। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রপঞ্চ। রাজনৈতিক বিভক্তির নামে আপনি যদি কোন মানুষ হত্যার সমর্থক হন আবার সেই রাজনৈতিক কারণেই যদি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরোধিতা পর্যন্ত নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন তবে মানুষ পরিচয় আপনারও ব্যর্থ। মানুষ হলেও মানুষ পরিচয়ের গভীরতা অনুধাবন করতে পারছেন না, মানবিক হতে পারছেন না। কেন পারছেন না, এই আত্মোপলব্ধি-আত্মসমালোচনার দরকার!