নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলা জরুরি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-30 19:18:51

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠ এখন গরম। এই শীতে আসন্ন নির্বাচন বেশ উষ্ণতা ছড়াবে বলেই মনে হয়। আমাদের দেশে শীত ও নির্বাচনের সঙ্গে রয়েছে এক মধুর সম্পর্ক। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক আচরণবিধির মতো প্রকৃতিতে শীতও এখন তার চিরন্তন গতিবিধি পরিবর্তন করে ফেলেছে। প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণও এ থেকে ভিন্ন কিছু নয়।

নির্বাচনের আচরণবিধি পালনের ব্যাপারে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ শোনা গেছে। কিন্তু আচরণবিধিতেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবায়নে ততোটা নয়। দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ থেকেই শুরু হয়েছে বিধিমালা ভঙ্গের হিড়িক। গাড়ি, বাস, ট্রাকে করে এলাকা থেকে লোক ভাড়া করে ঢাকার পল্টন বা ধানমন্ডি এসে শোডাউন করে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। কাচ্চি বিরিয়ানি-মোরগ পোলাও খাইয়ে আবার তাদের বাড়ি পৌঁছেও দেওয়া হয়েছে। এতে এক দশক পরে নির্বাচনের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি এ জাতীয় কর্মকাণ্ড সামগ্রীকভাবে সুষ্ঠু ও শৃঙ্খলাপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ বিনষ্ট করে সেটিও ঠিক। এবং শেষ পর্যন্ত এ রকম শোডাউনের পরিণতি আমাদের জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসেনি। একজন মানুষের মৃত্যু অথবা পুলিশের গাড়িতে আগুন- কোনোটিই হওয়ার কথা নয়।

আইন শুধু কাগজে থাকলে হয় না, কাজেও থাকা চাই। আচরণবিধিমালা অনুযায়ী কোনো ট্রাক, বাস অথবা মোটরসাইকেল নিয়ে কোনো ধরনের শোডাউন করা যাবে না। কিন্তু আমরা দেখলাম শোডাউনের প্রতিযোগিতা। যেনো যে প্রার্থী যতো বড় শোডাউন করতে পারে তার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা ততো বেশি। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ও এ জাতীয় শোডাউন করা নিষেধ। কিন্তু আমরা দেখলাম, অনেক জায়গায় মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ও শোডাউন।

১০ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনের আসল প্রচারণা শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবে প্রার্থীরা বিগত দুই-তিন মাস আগ থেকেই নানাভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। আজকাল প্রচার-প্রচারণা শুধু পোস্টার দিয়েই হয় না। তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে আরও নানাভাবে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এই বাস্তবতারোধ করা যাবে না। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে গণসংযোগতো চলছেই।

তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল মিডিয়ার আবির্ভাবের ফলে প্রচার-প্রচারণায়ও এসেছে রকমফের, চমক। কিন্তু এসবের অনেক কিছু সম্পর্কেই বিদ্যমান আচরণবিধিমালায় কিছু বলা নেই। আবার এটাও ঠিক যে সব কিছু অক্ষরে অক্ষরে বলে-কয়ে হবে না। কিন্তু সব ধরনের প্রচার-প্রচারণা সম্পর্কেই নির্বাচন কমিশনকে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপও করতে হবে।

আইনে বলা আছে, ভোট গ্রহণের দিনের তিন সপ্তাহ আগে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করা যাবে। তার মানে বিধি অনুযায়ী এখন প্রচারণা চালানো নিষেধ। কিন্তু বাস্তবে সব প্রার্থীই তাদের প্রচারণা চালাচ্ছেন। মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় যেমন শোডাউন করা হয়েছে, অনেক প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়েও একই কাণ্ড করে বসেছেন।

নির্বাচনী আচরণবিধির তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচন কমিশন। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্বও তাদের। আচরণবিধি লংঘনের দায়-দায়িত্বও কমিশনকে নিতে হবে। এর দায় রাজনৈতিক সরকার নেবে না। কারণ, নির্বাচনকালীন সরকার মূলত নির্বাচন কমিশন। সংবিধান অনুযায়ী সরকার কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে। কিন্তু কমিশনকে সরকারের কাছে সে সহায়তা চাইতে হবে।

বিধিমালা লঙ্ঘনের তদন্ত করার জন্য ‘নির্বাচনী তদন্ত কমিটি’ গঠন করার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সারা দেশে ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠনও করেছে। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটির কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়েনি। শুধু তদন্ত কমিটি গঠন করে চুপচাপ বসে থাকলেই কমিশনের কাজ শেষ হয়ে যায় না। তদন্ত কমিটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করা ও তাদেরকে স্বপ্রণোদিত হয়ে দায়িত্ব পালনে তৎপর করাও কমিশনের কাজের মধ্যে পড়ে। সংবিধানের ১১৮ ও ১১৯ অনুচ্ছেদ নির্বাচন কমিশনকে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ বলছে, নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন। এছাড়া ১১৯ (১) অনুযায়ী কমিশন রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী সংসদ নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এ ছাড়া আব্দুল মোমেন চৌধুরী ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ ( রিট পিটিশন নং ২৫৬১/২০০৫) মামলায় হাইকোর্ট বলনে, "From a close reading of Article 119 of the Constitution, it appears that the Election Commission has been given a plenary power of superintendence, direction and control of the preparation of the electoral rolls for elections and therefore whatever power is necessary for the purpose must be presumed to be there unless there is and ouster by express provision". সোজা কথায়, আইন বা বিধিমালায় কমিশনকে কোনো কাজের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা না হলে কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা প্রয়োজ তাই করতে পারবে। কাজেই আচরণবিধি লঙ্ঘনরোধে কমিশন তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে এগিয়ে আসবে এটাই কাম্য।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, আইনজীবী ও কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর