নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ব্যবহার থেকে সাবধান!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-31 01:05:40

জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির ও হেফাজতে ইসলামের মতো কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ও অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মার্কিন কংগ্রেসে উত্থাপন করা এক প্রস্তাবে। তাতে ওই কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে থামাতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ওই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন এবং তাদের সঙ্গে অংশীদারি বন্ধ করতে আহ্বান জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) প্রতি।

নির্বাচনের প্রাক্কালে মার্কিন কংগ্রেসের এই প্রস্তাবে জামায়াত, শিবির ও হেফাজতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন এবং তাদের সঙ্গে অংশীদারি বন্ধ করার আহ্বান জানানোটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

আমরা জানি জামায়াতে ইসলামী একটি স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দেশের মূল চেতনার বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। গত জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল। তাদের হামলায় হিন্দুদের ৪৯৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হিন্দুদের ৫৮৫টি দোকানে হামলা বা লুট হয়েছে। এ ছাড়া ভাঙচুর হয়েছে ১৬৯টি মন্দির। মার্কিন কংগ্রেসের এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সম্প্রতি হামলার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী জড়িত। এ ছাড়া বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আহমদিয়া মুসলমানদের ওপর ধর্মীয় উগ্রবাদীরা হামলা চালিয়েছে।

অন্যদিকে হেফাজতে ইসলাম অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে পুরোপুরি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে আন্দোলন চালাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রস্তাবে। এতে বলা হয়েছে, দাবি মানা না হলে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের হুমকি দিয়েছে হেফাজত। প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের জন্য আসন্ন ও চলমান হুমকি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ওই ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর হামলার ঝুঁকিতে আছে।

যে জামায়াত ও হেফাজতকে নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, যাদের তৎপরতা নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে, সেই দুই সংগঠনকে আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মাথায় তুলে রেখেছে। জামায়াত আশ্রয় নিয়েছে বিএনপির কোলে আর হেফাজত প্রশ্রয় পাচ্ছে আওয়ামী লীগের কাছে।

যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া, ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মিত্র খুঁজে বের করা, তাদের নিয়ে জোট করার প্রবণতাই আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলবাদী শক্তির কদর বৃদ্ধির মূল কারণ। যে বিএনপি আজ জামায়াতের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির আশায়, এক সময় তারাও জামায়াত সম্পর্কে অনেক কড়া বলেছে।

এ ব্যাপারে একটু অতীতে ফিরে যাওয়া যেতে পারে। ১৯৯৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের এক নারকীয় হামলায় শতাধিক নিরীহ ছাত্র আহত এবং ছাত্রনেতা রিমু নিহত হয়েছিলেন। নিহত রিমু ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রমৈত্রীর নেতা হলেও তার মা হেলেনা চৌধুরী ছিলেন সাতক্ষীরা বিএনপির সভাপতি।

বিএনপি তখন ক্ষমতায় ছিল। রিমু হত্যার প্রতিবাদে ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে এক উত্তপ্ত ও আবেগপূর্ণ আলোচনা হয়েছিল। ক্ষমতাসীন বিএনপি দলের সাংসদরা তখন জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন। তৎকালীন কিশোরগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ সদস্য মেজর আখতারুজ্জামান সেদিন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বলেন, ‘আজকে আসুন শুধু সরকারিভাবে সরকার নয়, সবাই মিলে সামাজিকভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের বয়কট করি। আসুন, আজকে তাদের সঙ্গে আমরা এক কক্ষে বসব না সেই প্রতিজ্ঞা করি।... আজকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে জামায়াত-শিবির ঔদ্ধত্য দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে, এটা আমাদের দুর্বলতার জন্য। শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, আমাদের যারা বিরোধিতা করেছে, আমাদের অস্তিত্বের যারা বিরোধিতা করেছে, যারা আমার অস্তিত্ব স্বীকার করেনি তাদের সাথে আমাদের কোনো সামাজিক বন্ধন হতে পারে না।’

সেদিন পাবনা-৪ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপির এমপি সিরাজুল ইসলাম, লক্ষ্মীপুর-৩ থেকে নির্বাচিত বিএনপির এমপি অ্যাডভোকেট খায়রুল এনামসহ বিএনপির ১৬ জন এমপি প্রায় একই ভাষায় জামায়াত-শিবিরের নৃশংসতার বিবরণ দিয়ে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে এ দুটি সংগঠন নিষিদ্ধকরণের দাবি জানিয়েছিলেন।

জোটভিত্তিক রাজনীতি আজ তাদের সে ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়েছে। যেমন আওয়ামী লীগ ভুলে গেছে হেফাজতিদের কথা।

বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির পুনর্জন্ম ঘটেছিল বিএনপির হাত দিয়ে। স্বাধীন দেশে ধর্মের অপরাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল৷ যুদ্ধাপরাধে ব্যাপকভাবে জড়িত জামায়াতে ইসলামীও তখন নিষিদ্ধ ছিল৷ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের নারী-শিশুসহ প্রায় সবাইকে হত্যা করার পর ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অনেক কিছুই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ফিরিয়ে আনা হয়৷

জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞাটা তুলে নেয়া হয়৷ পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা জামায়াত নেতারা একে একে ফিরেও আসে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের পরে৷ তথাকথিত ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ নামে জামায়াতকে ফিরিয়েছিল বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীর ‘পুনর্জন্ম' না হলে বাংলাদেশে ধর্মের রাজনীতি এভাবে বিকশিত হতো না৷

জিয়াউর রহমান বাকশাল ‘নাকচ' করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা ফিরিয়ে এনেছিলেন – এ কথা খুব গর্ব করে বলে বিএনপি৷ কিন্তু একটা কথা বিএনপির সব নেতাই চেপে যান৷ বিএনপির কোনো নেতা বা সমর্থক কখনোই স্মরণ করতে চায় না যে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামায়াতে ইসলামীকেও রাজনীতিতে ফিরিয়েছিলেন ‘শহিদ প্রেসিডেন্ট' জিয়াউর রহমান৷ স্বাধীনতার পরে যে দলটি নিষিদ্ধ ছিল বিএনপির বিশেষ কৃপায় সেই জামায়াত এক সময় জাতীয় সংসদেও ঢুকে পড়ে৷ ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত তো বিএনপির সহযোগী শক্তি হিসেবে মন্ত্রী পরিষদেও ঢোকে৷ আলবদর নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামী তখনই কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী হন৷

বিএনপি কখনো যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগও নেয়নি। বরং এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে। হেফাজতকেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টায় ব্যবহার করতে চেয়েছিল বিএনপি। পরবর্তী সময়ে নানা কৌশলে এমনকি বড় রকমের ছাড় দিয়ে হলেও বিএনপির ‘থাবা’ থেকে সেই হেফাজতকে বের করে এনে আওয়ামী লীগ তাদের বশে রাখার চেষ্টা করছে।

পক্ষান্তরে যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে চিহ্নিত ও নিবন্ধন হারানো জামায়াতকে ধানের শীষে নির্বাচন করার সুযোগ দিয়ে বিএনপি মূলত এই অপশক্তিকে ‘আত্মীকরণ’ করে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছে। 

বিএনপি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে, নানা অপশক্তিকে প্রশ্রয় দেয়-এটা নিয়ে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের অনেক খেদ আছে। তাহলে কি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি বাংলাদেশে ব্যর্থ? যে দেশের জন্মই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে, সেই দেশই বা কীভাবে আবার উল্টো হাঁটে?

মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাব পাশ হয়েছে বলেই নয়, জামায়াত ও হেফাজত সম্পর্কে এমনিতেই আমাদের সতর্ক হওয়া জরুরি। বড় দলগুলোর ঘাড়ে বসে এরা যেন হিংস্রতা প্রকাশের সুযোগ না পায়, যে কোনো মূল্যে তা নিশ্চিত করা জরুরি। 

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর