কবে থামবে এ মৃত্যুর মিছিল?

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান | 2023-08-30 03:59:56

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে। এ ছাড়াও দেশের অধিকাংশ মানুষের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম নৌপথ। তুলনামূলকভাবে কম খরচ এবং আরামের কারণে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ যাতায়াতের জন্য নদী পথ বেছে নেয়। কিন্তু যাতায়াতের সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক এই পথটি এখন সড়ক পথে যাতায়াতের মতোই অনিরাপদ হয়ে ওঠেছে। একের পর এক ঘটছে নৌ দুর্ঘটনা । এসব দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছে।

সম্প্রতি ঘটে গেল আরো একটি হৃদয়বিদারক নৌ দুর্ঘটনা। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ডুবে মারা গেলেন প্রায় ৪১ জন নারী, পুরুষ ও শিশু। গত রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে মহালয়া উপলক্ষে পাঁচপীর,বোদা, মাড়েয়া, ব্যাঙহারি এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে বদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন পূজা দিতে। এ সময় নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী ছিল। এ কারণে মাঝ নদীতে পৌঁছানোর পর যাত্রীর চাপে নৌকাটি ডুবে যায়। এ সময় কিছু মানুষ সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও বেশির ভাগ যাত্রীই এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এর তথ্য মতে, দেশে গত সাত বছরে ৪,৭৯১টি নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৪,২৩৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ২,৭১৪ জন। নৌপথে দুর্ঘটনাগুলোর প্রায় ৫৪ শতাংশই অন্য নৌযানের সঙ্গে সংঘর্ষ ও ধাক্কা লেগে হয়েছে। বাকি দুর্ঘটনার কারণ বৈরী আবহাওয়া, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, লঞ্চের তলা ফেটে যাওয়া, যান্ত্রিক ত্রুটি, আগুন লাগা ও বিস্ফোরণ। সবচেয়ে বেশি নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৌ দুর্ঘটনা রোধে নৌপরিহনের চালক ও যাত্রী সবাইকেই সচেতন হতে হবে। চালকরা সাবধানে নৌযান চালালে অনেক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। নৌযান দুর্ঘটনার বিশেষ করে লঞ্চ দুর্ঘটনার যে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত হয়েছে তার মধ্যে অন্য নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, বৈরী আবহাওয়ায় লঞ্চ চালনা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এছাড়া আগুন ও বিস্ফোরণ, মানবসৃষ্ট ভুল, নৌরুট ও বন্দরের দুর্বল ব্যবস্থাপনাও রয়েছে৷।

এছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চে সার্ভে সনদ ও রুট পারমিট প্রদান, অতিরিক্ত যাত্রী ও অদক্ষ চালকসহ নানা কারণে নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটে। বাসের মতো লঞ্চেও মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ইঞ্জিন বা বডি নিয়ে অসংখ্য যাত্রীর জীবন নিয়ে খেলছেন নৌযান মালিক ও চালকরা।

দেশে একেকটি দুর্ঘটনা ঘটে। তদন্ত কমিটি হয়। প্রতিটি তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার কারণ, দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিতকরণ, ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধের উপায় বা প্রতিকার এবং কিছু সুপারিশ করলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখে না।

জানা যায় ‘অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল আইন, ২০২১’ নামে একটি খসড়া আইন প্রণয়নের মধ্যেই তা আটকে রয়েছে। এই খসড়া আইনটির ৭৩ ধারায় অপরাধ ও দণ্ডের বিষয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ৮০ ধারায় কোম্পানির পরিচালকদেরও সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায়ী করে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি আইনটি।

নৌ দুর্ঘটনাসহ সবধরনের দুর্ঘটনা বন্ধে বিশেষজ্ঞরা যেসব সুপারিশমালা বিভিন্ন সময়ে প্রদান করেছেন সেসবের যথাযথ বাস্তবায়ন করে মানুষের জীবন রক্ষা করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা নাহলে এ মৃত্যুর মিছিল থামবে না বলেই প্রতীয়মান হয়। সুতরাং যথাযথ কর্তৃপক্ষ এদিকে আশু নজর দিবেন বলে মনে করি।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর