চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য

, যুক্তিতর্ক

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন | 2023-08-30 03:41:41

২০২০ সালের নির্বাচনে এনএলডির বিজয়ের পর ক্ষমতায় তাদের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর আগে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। বর্তমানে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছে এবং সেনাবাহিনীর এই সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে মরিয়া হয়ে জনগণের উপর অত্যাচার ও নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁরা এখন বেসামরিক মানুষকে হত্যা, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মত কাজ করছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই সংঘাত নিয়ন্ত্রণ এখনও সম্ভব হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলোর চলামান এই গৃহযুদ্ধ বন্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। দেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আধিপত্য এখন আর আগের মতো নেই। সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক দলগুলো সেনা শাসনের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে চায়। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে জাতীয় ঐক্যের সরকার (এন ইউ জি) গঠন করেছে। এন ইউ জি তাদেরকে সমর্থন দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে এবং অনেক দেশ এতে সাড়া দিয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে দেখা করেছেন আসিয়ান ও মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর গণতন্ত্রপন্থীদের ওপর দমন পীড়ন শুরু হলে তাদের অনেকে দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো থেকে সহায়তা ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়। অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে নতুন প্রায় ১০০টির মত সশস্ত্র গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করেছে, এবং এদের বেশিরভাগই দুর্গম এলাকাভিত্তিক। সারা দেশের গণতন্ত্রপন্থীদের সংগঠিত করে এন ইউ জি পিপল'স ডিফেন্স ফোর্স- পিডিএফ গঠন করেছে। পি ডি এফ এখন অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে মিলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোর শহর, নগর আর গ্রামে তারা সামরিক শাসন ও স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২০২১ সালের অক্টোবর নাগাদ দেশের সব শহর এলাকায় নিজেদের অবস্থান তৈরি করে পিডিএফ। এই অস্থিরতার সুযোগে মিয়ানমারের আরাকান, কাচিন, কারেন, শান এবং ওয়া বাহিনীর মতো ১১টি জাতিগত গোষ্ঠী, যারা বহুদিন ধরে মিয়ানমারের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তারা নিজেদের আধিপত্য এবং দখল বাড়ানোর জন্য নতুন করে লড়াই শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে সামরিক অভিজ্ঞতা লাভ করে পিডিএফের যোদ্ধারাও।

গণতান্ত্রিক সরকার সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা সেনাবাহিনীকে ভালোভাবে নেয়নি মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিক। জান্তাবিরোধী বিক্ষোভের সময় কয়েক হাজার সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং তাঁদের উপর নিপীড়ন নির্যাতন এখন ও চলছে এসব নিয়ে ক্ষুব্ধ দেশের সাধারণ মানুষ। জান্তাবাহিনীর চালানো অত্যাচার ও লুটপাটের রেশ এখনো সাধারণ মানুষের মনে গেঁথে আছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিদ্রোহ-বিক্ষোভ হচ্ছে। সাধারণ মানুষের সহযোগিতাতেই জান্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে বিদ্রোহীরা। বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতি দেশটির নাগরিকদের সমর্থন প্রায় নেই বললেই চলে। এ কারণেই কেউ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। একসময় সেনা সদস্য হওয়াকে গর্বের বিষয় মনে করত তরুন সমাজ এবং এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের দেশপ্রেম তুলে ধরত। নতুন করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য মিডিয়ার মাধ্যমে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালানোর পর ও খুব কম সংখ্যক আবেদনপত্র জমা পড়ায় আবেদনের সময়সীমাও দুইদফা বাড়ানো হয়েছে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের সময় বহু সামরিক কর্মকর্তা ও সেনা সদস্য স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীর চাকুরি ছেড়ে দেয়। বিদ্রোহীদের দলগুলোর সাথে চলমান সংঘর্ষে প্রায় ২০ হাজার সেনাসদস্য নিহত ও প্রায় ৭ হাজার গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। ফলে সেনাবাহিনীতে এখন জরুরি ভিত্তিতে সৈন্য নিয়োগের প্রয়োজন পড়েছে। আগে তরুণদের মধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে যে আগ্রহ দেখা যেত বর্তমানে সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে তেমন আগ্রহী নয় দেশটির তরুণ সমাজ। সেনাবাহিনীতে জনবল সংকট কাটাতে ঋণখেলাপি ও মাদকসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িতদেরকেও এখন নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে সামরিক জান্তা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে বিরোধিতা পাশাপাশি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিদ্রোহ দমনে তাদেরকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে সবসময়। অভ্যুত্থানের পৌনে দু'বছর পরও সেনাবাহিনী দেশটিতে তাঁদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান সংঘর্ষের পাশাপাশি দেশের মধ্যাঞ্চলের মাগোয়ে ও সাগাইং অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হচ্ছে।এই এলাকা গুলোতে সংখ্যা গরিষ্ঠ ভামার জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। দেশের মূল জনগোষ্ঠী ভামাররা এতদিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়নি। এখন তারাও এখন সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। অভ্যুত্থানের পর বিরোধীদের দমন করতে ব্যাপক শক্তি ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে একাধিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হচ্ছে সামরিক জান্তাকে।

সরকারি বাহিনী মিয়ানমার জুড়ে একাধিক ফ্রন্টে মোতায়েন রয়েছে এবং সেখানে সশস্ত্র দলগুলোর সাথে লড়াই করছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং এ এ’র মধ্যে লড়াই সাম্প্রতিক সময়ে তীব্রতা পেয়েছে। আরাকান আর্মি একাধিক সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে এবং কৌশলগত পরিবহন রুটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। আরাকান আর্মি দাবি করেছে যে মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন ও দক্ষিণ চিন রাজ্যে এএ’র কাছে দেশটির সেনাবাহিনীর শতাধিক সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। ২০২০ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে শুরু হওয়া অঘোষিত অস্ত্রবিরতির পর প্রায় ১৬ মাস রাখাইন ও পালেতওয়াতে আপাত শান্তি বিরাজ করছিল। মে মাস থেকে পালেতওয়াতে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ শুরু হয় এবং আগস্ট মাসে ভারত – মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কাছে মংডু এলাকাতে ও সংঘাত শুরু হয়। এই সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে সরকার ক্রমাগত সেনা মোতায়েন বাড়াচ্ছে এর ফলে সামনের দিনগুলোতে লড়াইয়ের তীব্রতা আর ও বাড়বে।

সহিংসতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের শীর্ষ সাতটি সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠীর সদস্যরা ওয়া রাজ্যের পাংসাংয়ে বৈঠকে বসে। এসব গোষ্ঠীর প্রায় ৩০ হাজার সদস্য রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। নিজেদের মধ্যে একতা আরও বৃদ্ধি করার উদ্যোগই হবে বৈঠকের মূল লক্ষ্য। বর্তমানে উত্তর রাখাইন, চিন, শান ও কাচিন রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তারা ভারী অস্ত্র ও ট্যাঙ্কের সহায়তা অনেকগুলো শহরে প্রবেশ করে সেখানকার একাধিক গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে এবং গ্রামে গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে। সাধারণ জনগণের ওপর সামরিক বাহিনীর ভারী অস্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সামরিক সরকারের রণকৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভামার জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাতে ও সংঘর্ষ হচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যাই বেশি। 

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন করতে ট্যাঙ্ক, ভারী অস্ত্রের পাশাপাশি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করতে শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে একই সঙ্গে বিভিন্ন সীমান্ত প্রদেশগুলোয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পাশাপাশি দেশের ভেতরের বিভিন্ন প্রদেশে গণতন্ত্রপন্থী পিডিএফ বাহিনীর সাথে ও সংঘর্ষে জড়াতে হচ্ছে।এই বহুমুখী সশস্ত্র আন্দোলন ঠেকাতে গিয়ে যেভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হওয়ায় তারা কোন জায়গাতেই ঠিক মতো সামাল দিতে পারছে না। সেনাবাহিনীর ভেতরে ও সৈন্যদের মনোবল আগের মত নেই, সেনাবাহিনী থেকে প্রচুর সৈন্য পালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে জুনিয়র অফিসার এবং সৈনিকদের মধ্যে অনেকে সেনাবাহিনী ছেড়ে সরাসরি পিডিএফে যোগ দিচ্ছে কিংবা পালিয়ে যাচ্ছ। জাতিগত বাহিনীগুলো ও পিডিএফ আরও বেশি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের সামর্থ্য, যোগাযোগ আর সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, অনেক এলাকায় সরকারি শাসন ভেঙ্গে পড়েছে।

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার কিছুকাল পরই বার্মার রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রবেশ ঘটে। এর কিছুকালের মধ্যেই দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভামারদের সাথে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ওই সময় শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অভাবে দেশের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার নামে সামরিক বাহিনী রাজনীতিক অঙ্গনে তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে তাঁদের এই আধিপত্য চালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা কারণে মিয়ানমারের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের বেড়ে গেছে।সব কিছু মিলিয়ে মিয়ানমারের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না। মিয়ানমারে চীন সিঙ্গাপুর, জাপান এবং ভারতের বিনিয়োগ আছে এবং কয়েকটি বন্ধুপ্রতিম দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে তাঁরা এসব চাপ উপেক্ষা করতে পারছে।

পি ডি এফ ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র দলগুলোর সাথে সেনাবাহিনীর সংঘাত বেড়ে চলছে ভবিষ্যতে তাঁরা আরও সংগঠিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে এতে ক্ষয়ক্ষতি, সংঘাত আরও বাড়বে এবং শান্তি প্রক্রিয়া ও স্থিতিশীলতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে সংঘর্ষের ঘটনা ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যাবে। সব মিলিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও আধিপত্য এখন চালেঞ্জের সম্মুখীন। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য সংঘাত ও সংঘর্ষ পরিহার করে মিয়ানমারে জনগণকে সাথে নিয়ে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়াই এখন তাদের মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার।

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর