আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারা

, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ আহমদ | 2023-08-31 08:13:41

‘ত্রিভুবনে প্রিয় মুহাম্মদ এলরে দুনিয়ায়/আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়/ধূলির ধরা বেহেশত আজ, জয় করিল গেলরে লাজ/আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারা।’ মহানবীর (সা.) ভালোবাসায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কতই না চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন তার অভিব্যক্তি। আসলে বিশ্বনবীর আগমন ছিল বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ।

এই মহান রাসুল সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা এই ঘোষণা দিচ্ছেন, ‘আর আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (সুরা সাবা: ২৮)। মহানবীকে (সা.) কেবল মক্কা শহর বা সেই যুগের লোকদের জন্যই আবিভূর্ত করেন নি বরং তিনি কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীর মানুষ ও জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন। তার (সা.) মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তির বাতাস প্রবাহিত হয়েছে।

কতই না অতুলনীয় ছিল মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদা মসজিদে একমরুচারী বা বেদুঈন আসে আর সেখানেই প্র¯্রাব করতে বসে পড়ে। লোকজন তার দিকে ধেঁয়ে আসে বা ছুটে যায়। মহানবী (সা.) লোকদের বারণ করে বলেন, একে ছেড়ে দাও আর সে যেখানে পেশাব করেছে সেখানে পানির বালতি ঢেলে দাও। তোমরা লোকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সৃষ্টি হয়েছ, কাঠিন্যের জন্য নয়।’ (বোখারি) অন্য আরেকটি রেওয়ায়েতে এটি আছে যে, পরবর্তীতে সেই বেদুঈন সর্বদা মহানবীর (সা.) অনুপম চরিত্রের কথা বর্ণনা করতো আর বলতো, মহানবীর (সা.) জন্য আমার পিতামাতা নিবেদিত, তিনি (সা.) কত অসাধারণ ভালোবাসার সাথে আমাকে বুঝিয়েছেন। আমাকে কোন গালি দেন নি। ভর্ৎসণা করেন নি। মারধর করেন নি বরং সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। কাজেই দেখুন! এক অশিক্ষিতকে ভালোবাসার সাথে বুঝানোর ফলে তার অবস্থাই পাল্টে যায়।

প্রতিবেশির অধিকারের বিষয়েও মহানবী (সা.) বিশেষ তাকিদ দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, প্রতিবেশির সাথে সদ্ব্যবহার করা অনেক বড় একটি নৈতিক গুণ। হজরত জিব্রাঈল (আ.) সর্বদা আমাকে প্রতিবেশির সাথে সদ্ব্যবহার করার তাগিদ দিয়েছেন, এমনকি আমার ধারণা হয়, সে তাকে আবার উত্তরাধিকারীই না বানিয়ে দেয়। প্রতিবেশির সাথে সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব এত বেশি।

এরপর রয়েছে শাসকের আনুগত্য। এ সম্পর্কে তিনি সবসময় তাগিদ দিয়েছেন আর বলেছেন, শাসকের আনুগত্য করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য আর উন্নত নৈতিকতার এটিই দাবি আর সুনাগরিকের হওয়ার দাবি হল, নিজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আনুগত্য কর। যদি কোন কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসও তোমাদের আমির নিযুক্ত হয় তাহলে তার আনুগত্য কর, এরপর যে দেশে বসবাস করছ, যেখানকার নাগরিক, সেদেশকে ভালোবাসা সম্পর্কে বলেছেন, ‘দেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ’। এজন্য যেখানে এই  নৈতিক চরিত্রের দাবি হল, নিজ কর্মকর্তাদের আনুগত্য করা আর স্বদেশকে ভালোবাসা সেখানে স্মরণ রেখ, এ বিষয়গুলো ঈমানের অঙ্গও বটে। এজন্য একজন মুসলমানকে, যে দেশেই সে বসবাস করুক না কেন দেশীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রেখে বসবাস করা উচিৎ।

মহানবী (সা.) আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে যখনই কোন জাতির কোন সম্মানিত ব্যক্তি আসবে তাকে সম্মান করো।’ (জামিউল মাসানিদ ওয়াল সুনান, ৮ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৩) মহানবী (সা.) সম্পর্কে একথা প্রসিদ্ধ ছিল যে, তিনি কোন জাতির দূতকেই কোনরূপ কষ্ট দিতেন না। (সহিহ বোখারি) বরং তিনি তার শেষ দিনগুলোতে ওসীয়্যত হিসেবে এই তাগিদ দিয়েছিলেন, তোমাদের কাছে যখনই কোন জাতির কোন প্রতিনিধি আসেন তখন তাকে উপহার উপঢৌকন ইত্যাদি দিও, যেভাবে আমি দিয়ে থাকি। (সহিহ বোখারি)

মহানবী (সা.) বিশ^বাসীর সংশোধনের কাজ করেছেন। যেখানে না কোন স্কুল ছিল আর নাই মাদ্রাসা। তিনি বাড়িতে উঠা বসা, শয়ন জাগরণ, কথাবার্তা বলায় এবং জ্ঞানার্জনের শিষ্ঠাচার থেকে আরম্ভ করে দেশীয় এবং জাতীয় আর পৃথিবীতে রাজত্বকরার সকল নিয়ম নীতি অত্যন্ত স্নেহ ও ভালোবাসার সাথে শিখিয়েছেন। মক্কা মদিনার ছোট ছোট বাহ্যত দরিদ্র ও অনুন্নত জনবসতিতে মহানবীর হাতে শিক্ষা প্রাপ্তরা নিজেদের যুগে ইরান, রোম, মিশর, সিরিয়া আর দজলা ও ফুরাত নদীর তীরে বসবাসকারীদের অজ্ঞতা ও নিস্পেষণমূলক সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে তাদের মধ্যে জ্ঞান ও তত্ত্বের এমন ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করেছেন যা পরবর্তীতে শত শত বছর ধরে গোটা মানবজাতীকে সরল সুদৃঢ় পথ প্রদর্শনের কাজ করেছে। তাঁর শিষ্যরা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জ্ঞান, সাহিত্য এবং ধর্মীয় জগতের চিত্রই পাল্টে দিয়েছেন। বরং যদি একথা বলা হয় তাহলে তা ষোলআনা সত্য ও যথার্থ হবে যে, আজও বিশ্বে মানবীয় সম্পর্কের পবিত্রতাকে বহাল করার আর সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মাঝে ভালোবাসা ও প্রেমপ্রীতির সম্পর্ক গড়ার জন্য মহানবীর (সা.) শিক্ষা এবং তার আদর্শ ছাড়া অন্য কোন আচরনবিধি নেই বললেই চলে।

মহানবীর উপদেশাবলী সমাজে বিজ্ঞানের সূত্রের মত কার্যকর হতে দেখা যায়। যেমনটি তিনি (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাত মায়েদের পদতলে আর পিতা হলেন, জান্নাতের দ্বার।’ পিতামাতারা যদি রাতে উঠে সন্তানদের জন্য আকুতিমিনতিভরে দোয়া করতে থাকেন তাহলে তাদের সকল দোয়া সন্তানদের জীবনে মহান বিপ্লব সাধন করে। এটিই সবচেয়ে মূল্যবান ও নিরাপদ ভাণ্ডার যা দোয়ার আকারে পিতামাতা ঊর্ধ্বলোকে জমা করতে থাকেন যা পরবতীর্তে নিজ নিজ সময়ে সন্তানদের কাজে আসতে থাকে। এরপর তিনি (সা.) বলেছেন, সন্তানদের সম্মান কর আর তাদের তরবিয়ত করার সময় তাদের আত্মমর্যাদার প্রতি খেয়াল রাখো। এখন সন্তানদের শিক্ষা দেয়ার সময় যদি তাদের আত্মসম্মানের প্রতি খেয়াল রাখা না হয় তাহলে ভালো ভালো কথা এবং সর্বোত্তম উপদেশও তাদের ধ্বংসের গহ্বরে নিক্ষেপের কারণ হয়ে যায়।

এরপর তিনি (সা.) বলেছেন, সালামের প্রচলন কর, ক্ষুধার্তকে আহার করাও আর সমাজ থেকে ক্ষুধাকে নিমূর্ল কর যা বিভিন্ন প্রকার অপরাধের মূল কারণ, আত্মীয়স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার কর। রাতের বেলা এমন সময় উঠে নামায পড় যখন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকে। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটি এমন একটি উপদেশ যা প্রত্যেক বাড়িকে এবং প্রতিটি শহরকে শান্তির নীড়ে পরিণত করতে পারে। বাহ্যত তাঁর ছোট-ছোট কথা তা যদি শিশুকাল থেকেই আদর-ভালোবাসা ও স্নেহের সাথে বার বার কর্ণগোচর হতে থাকে তাহলে সেই শান্তি যার সন্ধানে শিশু-বৃদ্ধ, যুবক, নারী-পুরুষরা ঘরের বাইরে রাস্তাঘাটে এবং অলিগলিতে আর বিভিন্ন ক্লাবে ঘুরে বেড়ায় সেই শান্তি তারা বাড়িতেই পেয়ে যাবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর