দৈনিক চল্লিশ শিশুর সলিল সমাধি ভাবা দুষ্কর

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 01:43:39

গ্রামের বাড়িতে দুপুরের খারার খেয়ে একটি টং ঘরে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ মানুষের শোরগোল শুনে ওদিকে কি হয়েছে, মানুষ দৌড়াচ্ছে কেন- এমন কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু কেউ সঠিকভাবে কিছুই বলতে পারছিল না। একটি সমূহ বিপদ ঘটেছে আঁচ করে সবার সাথে দ্রুত অকুস্থলে গেলাম। অনেক মানুষ ভীড় করছে। মধ্যিখানে যেতে মানুষ ঠেলে ভিতরে ঢুকতে হলো। সেখানে একটি ছোট্ট শিশুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কেউ পেট টিপছে, কেউ মুখের মধ্যে মুখ লাগিয়ে শ^াস দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। কতক্ষণ আগে সে পাশের পুকুরে পড়ে গিয়েছিল কেউ সেটা জানে না। তার সাথের সঙ্গী শিশুটিও সেকথা বলতে পারছিল না। হাসপাতালে নেবার মতো অবস্থা নেই, সেকথা কেউ ভাবেওনি। সবাই চিৎকার, শোরগোল ও বিশৃংখলা করে আহাজারি করছে। গোটা গ্রামের মানুষ ভেঙ্গে সেখানে এসে হাজির। কিন্তু পেট থেকে পানি বের করা হলেও শিশুটিকে বাঁচানো যায়নি।

এমন একটি দুর্ঘটনা চোখের সামনে ঘটে যাবে তা ভেবে আমিও হতবিহ্বল হয়ে পড়েছি। সেটা বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা হলেও মনে খুব দাগ কাটে। কিছুদিন পূর্বে টিভি সংবাদে স্বাস্থ্য বিভাগের পিআইপিআরবি কর্তৃক সাঁতার শিক্ষা প্রকল্পের এক অনুষ্ঠানে দৈনিক এতগুলো শিশুর পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার তথ্যে হঠাৎ খুব বিচলিত বোধ করেছি।

গত ০৯ অক্টোবর ২০২২ কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের পূর্ব বামপাড়া গ্রামে মামা-ভাগ্নে সাইফ ভূঁইয়া (১২) ও সাব্বির (১০) বাড়ির পাশের পুকুরে গোসল করতে গিয়ে পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে। সাইফ স্থানীয় বেল্টা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণি এবং সাব্বির ঢাকার একটি বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। সে ঢাকা থেকে মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। পানিতে ডোবার কিছুক্ষণ আগে তারা উভয়ে বাইসাইকেল নিয়ে বাইরে বের হয়েছিল। হঠাৎ এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা কার প্রাণে সহ্য হয়? মনে পড়ে গিয়েছিল গ্রামের প্রতিবেশীদের পুকুরে সেই শিশুটির মৃত্যুর কথা।

শিশু মৃত্যুর দশ কারণের একটি পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। ডাব্লিউএইচও-র মতে, বিশ্বে প্রতি বছর তিন লাখ ৫৯ হাজার ৪০০ জন মানুষ মারা যায় পানিতে ডুবে। মধ্যে ৯০ ভাগ মৃত্যু ঘটে বাংলাদেশের মত নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। আমাদের দেশে প্রতিবছর দুই লক্ষ ৩৫ হাজার মানুষ মারা যায় পানিতে ডুবে। এদেশে দৈনিক ৫০ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায় যার চল্লিশ জন শিশু। এরা গোচরে-অগোচরে পানিতে ডুবে অকালে প্রাণ হারায়। সেই চল্লিশ জনের মধ্যে ৩০ জনের বয়স পাঁচ বছরের নিচে।

প্রতিবছর ২৫ আগস্ট পানিতে ডোবা মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস। কারণ, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য। যা প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার উপায় নেই।

পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুরা বেশীরভাগ গ্রামাঞ্চলের। বর্ষাকালে এই মৃত্যুসংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। বর্ষাকালে বাড়ির নিকটস্থ পুকুর, ডোবা, হাওড়, বাওড়, খালবিল পানিতে পরিপূর্ণ থাক। বাড়ি, স্কুল, খেলার মাঠ সবকিছুর সীমানা ঘেঁষে খোলা জলাধার লক্ষ্যণীয়। গ্রামের পুকুর পাড়ে, বিলের ধারে, নদীর তীর ঘেঁষে আলপথে শিশুরা পায়ে হেঁটে স্কুলে যাতায়ত করে। অনেক জায়গায় বাঁশের সাঁকো পার হতে হয় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে। সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিতে থাকে কঁচি শিশুরা। তারা হাঁটতে শিখলে খেলার ফাঁকে উঠোন পেরিয়ে নিকটস্থ জলাশয়ের নিকট চলে যায় বাবা মায়ের অগোচরে। বর্ষাকাল ছাড়াও নদীমাতৃক বাংলাদেশে সারা বছর পানিতে ডুবে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে নদীপথে যাতায়তকারীদের জন্য নৌকাডুবি, লঞ্চডুবিতে মারা যাবার ঘটনা বছরের যে কোন সময় শোনা যায়। ডোবা-খালের সামান্য পানিতে এমনকি চৌবাচ্চা ও গোসল করা গামলার স্বল্প পানিতে অভিভাবকের অসাবধানতা ও উদাসীনতার কারণে শিশুমৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়।

বিশেষ করে দুপুর বেলা যখন মায়েরা রান্নাঘরে ব্যস্ত, সন্ধ্যার পূর্বে যখন বড়রা বাইরে খেলে কঁচি শিশুরা তখন তাদের সাথে খেলার সুযোগ না পেলে কৌতুহলবশত: এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে নিকটস্থ জলাশয়ে পড়ে যায়। এর ফলে ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা। হঠাৎ পানিতে পড়ে ডুবে গেলে তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না। দুই-একদিন পর ভেসে উঠে কারো কারো ফুলানো লাশ। এটা বড় মর্মান্তিক।

পানিতে ডুবে মারা যাওয়া রোধকল্পে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি কিছু ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এটা খুবই অপ্রতুল। তাই অচিরেই পরিকল্পিত উপায়ে ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ডব্লিউএইচও এজন্য ১০টি নির্দেশনা দিয়েছে। সেগুলো বেশ ভাল হলেও অনেক দেশ সেগুলোর দিকে কর্ণপাত করছে না। সেগুলোতে আইন ও প্রশাসনিক ব্যাপার জড়িত থাকায় অনেক দেশ সেগুলো বাস্তবায়ন করতে ততটা আগ্রহী নয়। তবে ডাব্লিউএইচও-এর কিছু নির্দেশনা মেনে চলা অতি সহজ। যেমন, পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কিন্তু তাদের নির্দেশিত অনেক আধুনিক ও ভাল নির্দেশনা মানা সহজ ব্যাপার নয়।

যেমন, বাচ্চাদের স্কুলে সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করা। আমাদের দেশে স্কুলের আয়োজনে সেটা নেই। এজন্য স্কুলের নিজস্ব পুকুর না থাকলে নিকটস্থ পুকুর জলাশয়, সুইমিংপুল ইত্যাদি ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা খুবই জটিল ব্যাপার। কারণ, আমাদের দেশে সব এলাকায় সুইমিংপুল নেই। জলাশয় অনেক আছে। কিন্তু সেগুলোর পানি নোংরা, সাঁতার কাটার জন্য উপযোগী বা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

শিশুদের বাড়তি নিরাপত্তার জন্য স্কুলের পাশের, চলার পথের বা খেলার জায়গার কাছে উন্মুক্ত জলাশয়ের আলপথে বেড়া দেয়ার জন্য পুকুর-ডোবার মালিককে কড়া নির্দেশনা দিয়ে হুকুম জারি করা যেতে পারে। ছুটির দিনে শহরের স্কুলের সকল শিশুকে বিশেষ ব্যবস্থায় সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কেউ হঠাৎ পানিতে ডুবে গেলে তাকে দ্রুত উদ্ধার করার জন্য সিভিল ডিফেন্স ব্যবস্থার কথাও আজকাল কেউ ভাবছেন না। আক্রান্তদেরকে প্রাথমিক প্রতিবিধান দেয়ার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এলাকার ক্লাবগুলোর সাঁতার জানা সদস্যদেরকে এ কাজে উৎসাহিত করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।

এছাড়া নৌ দুর্ঘটনায় পানিতে ডুবে মৃত্যু কমাতে নদীপথে ভ্রমণের সময় সব যাত্রীর জন্য লাইফ জ্যাকেট পরিধান করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এজন্য নৌযান মালিককে ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে ঝড়ের পূর্বাভাষ থাকলে বা মাঝ নদীতে ঝড় শুরু হলে সাইরেন বাজিয়ে দ্রুত সব যাত্রীকে লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করে বাধ্যতামূলকভাবে পরিধান করিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় নৌযান মালিক ও যাত্রীকে বড় অংকের জরিমানা গুনতে হবে বলে আগাম সতর্ক করতে হবে। এজন্য গণমাধ্যমে আগেই মানুষকে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

পানিতে ডুবে মারা যাওয়া পানিতে ডুবে মারা যাওয়া একটা নীরব মহামারী। এই মহামারীতে প্রতিদিন অনেক বাবা-মায়ের কোল খালি হয়ে যায়, অনেক পরিবার কর্মক্ষম সদস্য বা অভিাবক হারিয়ে নি:স্ব হয়ে পথে বসে পড়ে। এজন্য আমাদের দেশে নেই কোন সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি। এটা সবার জন্য খুবই খারাপ সংবাদ।

অদৃশ্য মহামারীতে আমাদের দেশে করোনায় প্রতিদিন এত শিশুর মৃত্যু হয়নি। ডেঙ্গু বা কলেরা ডায়রীয়াতেও দৈনিক এতটা মৃত্যু ঘটতে দেখা যায় না। ছয়টি ভয়ংকর শিশু রোগেও দৈনিক এত সংখ্যক শিশুর মৃত্যুর কথা শোনা যায় না। এসব রোগে মৃত্যুর জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও পানিতে ডুবে এত মৃত্যুর পরও কোন কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে কেউ ভাবেননি। তাই এই ভয়ংকর বিষয়টি নিয়ে এতদিন কোনরূপ নীতিমালা ও পরিকল্পনাও হাতে নেয়া হয়নি। গড়ে উঠেনি কোন প্রতিরোধ সেল ও সামাজিক সচেতনতা।

এজন্য স্বাস্থ্য বিভাগের পিআইবিআরবি-র পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক চিন্তাভাবনাকে এই সমস্যার চাহিদার সাথে সম্প্রসারিত করে সামাজিক আন্দোলন তৈরি করতে হবে। এজন্য গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষকে বুঝাতে হবে পানির দেশ বাংলাদেশে পানির মাঝে নিরাপদে বসবাস করার পরিবেশ তৈরীর বিকল্প নেই। বিপদের সময় বা ভয় পেয়ে বয়স্ক মানুষ বা শিশুদের পানিতে ডুবে যাওয়া অনিবার্য নয়- এটা প্রতিরোধযোগ্য। এজন্য একটু চেষ্টা ও সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষকে প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার। তাই আর অবহেলা না করে পানিতে ডুবে অকাল মৃত্যু রোধকল্পে সরকারি ও বেসরকারিভাবে জরুরি কর্মসূচি গ্রহণ করতে সবাইকে দ্রুত এগিয়ে আসা দরকার।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর