‘জিন্দাবাদ’ পুঁতে রেখে শাশ্বত যে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-09-01 01:35:11

ঘরে থেকে ঘরকে আপন না ভাবলে আপনি নিজ গৃহে পরবাসী। ঘরে থেকে ঘরের অধিকার না পেলেও একই পরিণতি; পরবাসী। ঘরে থাকলে মানুষ ঘরের অধিকার চায়, ঘরে না থাকলেও মানুষ অধিকার নিয়ে একটা ঘর চায়। এ সহজাত, এটাই ধর্ম মানুষের। এর ব্যতিক্রম কম, খুবই কম। ব্যতিক্রম সেখানে যেখানে মানুষ তার ‘মানুষ’ নামের অর্থ ও ভার বুঝতে অক্ষম।

আমাদের ঘর বৃহত্তর অর্থে আমাদের দেশ। আমাদের ঠিকানা দেশ; বাংলাদেশ। যার জন্ম স্রেফ নয় মাসের এক যুদ্ধেই নয়, দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের ধারাবাহিকতা আছে ওখানে; যার চূড়ান্ত পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ, মার্চ ছাব্বিশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ষোলো ডিসেম্বরের বিজয় অর্জন। একাত্তরের নয় মাস বাঙালি যে রণহুঙ্কারে কাঁপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানিদের সেই হুঙ্কারের নাম, সেই রণধ্বনির নাম ‘জয় বাংলা’। এই ‘জয় বাংলা’ আমাদের জাতীয় স্লোগান হিসেবে আদালত কর্তৃক স্বীকৃত, এবং অবশ্যপালনীয়।

মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’, পাকিস্তানি তরিকার ‘জিন্দাবাদ’ নয়। জয় বাংলা আর জিন্দাবাদের সেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে ৫১ বছর আগেই। জয় বাংলা উচ্চারণে তাই বাংলাদেশ ভাসে; জয় বাংলা উচ্চারণে তাই লক্ষ শহিদ ভাসে; জয় বাংলা উচ্চারণে তাই লক্ষ বীরাঙ্গনা ভাসে; জয় বাংলা উচ্চারণে তাই অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা ভাসে; জয় বাংলা উচ্চারণে তাই সবুজের বুকে লাল জমিনের পতাকা ভাসে; জয় বাংলা উচ্চারণে তাই পিতার মুখ ভাসে। এই ‘জয় বাংলা’ আমাদের স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক, অনন্ত গৌরবের উত্তরাধিকার। জয় বাংলা উচ্চারণ, জয় বাংলা রণধ্বনি দলীয় স্লোগান নয়; এটা বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান, জাতীয় সম্পদ। এখানে ভিন্ন কিছু ভাবার সুযোগ নাই, এখানে ভিন্ন স্লোগান জপেরও সুযোগ নাই।

‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর কফিন পুঁতে দেওয়া হয়ে গেছে একাত্তরে। প্রতিস্থাপন হয়েছে ‘জয় বাংলা’র। বিজয়ের এই ৫১ বছর পরেও যারা স্লোগান বিষয়ক বিভ্রান্তিতে তারা কেন ‘জিন্দাবাদ’ আঁকড়ে ধরে রাখবেন? বাংলাদেশে পাকিস্তানকে যেমন ‘গুডবাই’ বলা হয়েছে, তেমনিভাবে জিন্দাবাদকেও। এখানে স্লোগান বিষয়ক কোন রাজনৈতিক সমীকরণ নাই। সিদ্ধান্ত সাফ-সাফ; পাকিস্তানের সঙ্গে খতমও জিন্দাবাদ। জিন্দাবাদের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক; এ দুই শব্দের কোন একটাকে ধরে রাখলে মনে হয় অপরটা উহ্য, ভেতরে ভেতরে উচ্চারিত; একটার মৌখিক উচ্চারণে, অন্যটার উচ্চারণ অন্তর্গত। লোকলজ্জায় অস্বীকার- এ যে আত্মপ্রতারণা!

পাকিস্তান যেমন আমাদের ছিল না, জিন্দাবাদও আমাদের নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে সঙ্গে তাড়িয়ে দেওয়া হয়ে গেছে জিন্দাবাদকেও। তাই ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর স্বর ধরে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নয়; আমাদের স্লোগান ‘জয় বাংলা’। দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে বাস করেও আপনি যদি ‘জয় বাংলা’-কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে মনেপ্রাণে গ্রহণ না করেন তবে আপনি কি-না সেই লোক নিজ গৃহেই পরবাসী!

একাত্তরে জিন্দাবাদকে মাটিতে পুঁতে দিয়ে শাশ্বত হয়েছিল যে ‘জয় বাংলা’ তা আমাদের অবিসংবাদিত স্লোগান। এখানে নাই রাজনৈতিক সমীকরণ। তবে দুর্ভাগ্য আছে আমাদের, কারণ এই স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান করতে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছে, সরকারি প্রজ্ঞাপনে একে অবশ্যপালনীয় বলে ঘোষণা দিতে হয়েছে। অথচ এটা নিজ থেকেই আমাদের আরও আগে করা উচিত ছিল। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যাদের দলীয় স্লোগানের সঙ্গে জিন্দাবাদ শব্দ ছিল তাদের উচিত ছিল ঘোষণা দিয়ে এই জিন্দাবাদ বর্জনের, কিন্তু সেটা হয়নি। না হওয়ার কারণ অবিদিত নয়, অনেকটাই সেই পুরনো পাকিস্তানপ্রেম!

বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি, এমনকি বামপন্থী কিছু দলের স্লোগানের সঙ্গেও আছে এই ‘জিন্দাবাদ’ শব্দ। তাদের কেউ কেউ প্রগতির কথা বলে, জাতীয়তাবাদের কথা বলে, কিন্তু দলীয় স্লোগানে এ কি হাল? এ প্রগতি নয় যেন অধোগতি! এ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত তাদের। জানি না বেরুবে কি তারা? তবু আশায় থাকি!

দিনকে দিন এই প্রজন্মের লোকজন ইতিহাসবিমুখ হচ্ছে। তারা জাতীয় স্লোগানকেও দেখছে দলীয় স্লোগান হিসেবে। এখানে দলীয় যোগ আছে সত্য কিন্তু এই যোগ যখন একাত্তরকে ধারণ করে তখন দলীয় বৃত্ত থেকে এই স্লোগানকে বের করিয়ে নিয়ে আসা উচিত ছিল আমাদের সকলের। এখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা কিংবা অমনোযোগিতার দায় আছে। সকল রাজনৈতিক দলই এটাকে আওয়ামী লীগের সম্পত্তি বলে মেনে নিয়েছে, আওয়ামী লীগও গ্রহণ করে রেখেছে বলেই হয়তো এই বিপত্তি। তবে ‘জয় বাংলা’ যখন জাতীয় স্লোগান বলে আদালত কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে তখন সকল দলের উচিত ছিল এটাকে গ্রহণ করে নেওয়ার। সেটা তারা করেনি।

জাতীয় স্লোগান স্বীকৃতির অনেক আগে থেকেই এই ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আমাদেরকে উজ্জীবিত করেছিল, এখনও করে। আমাদের বিশ্বাস এটা উজ্জীবিত করবে অনন্তকাল ধরে যদি সকল রাজনৈতিক দল এটাকে গ্রহণ করে ইতিবাচকভাবে। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের অনুধাবন করা উচিত ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির সঙ্গে বাংলাদেশ মিশে আছে, আর জিন্দাবাদের সঙ্গে মিশে থাকে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তান!

ঘরে থেকে নিজ গৃহে পরবাসী না হয়ে থেকে গৃহবাসী হওয়া উচিত সকল রাজনৈতিক দলের। দলীয় স্লোগানের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব একমাত্র জিন্দাবাদ বর্জন করে জয় বাংলা স্লোগান গ্রহণের মাধ্যমে। আমরা চাই দেশের সকল রাজনৈতিক দল জাতীয় স্লোগান জয় বাংলাকে নিজেদের দলীয় স্লোগান হিসেবেও গ্রহণ করবে।

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ সম্পর্কিত আরও খবর