‘ভাত পেলেই খেতে নেই, জায়গা পেলেই বসতে নেই’

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-08-31 22:44:37

এক.
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে-পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দল, নীতি-আদর্শ বদল, ডিগবাজি ও ভেলকিবাজির রাজনৈতিক অনেক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। জনগণ যা প্রত্যাশা করেনি, কল্পনা করেনি তার অনেক কিছুই বাস্তবে রূপ নেওয়ায় বাংলাদেশের ভবিষ্যতের রাজনীতির রূপরেখা ও গতিপথ নতুন পথের বাঁকে মোড় নিয়ে নতুন ঐক্যজোট, সংলাপ, নির্বাচন প্রস্তুতি, তফশিল ঘোষণা, মনোনয়ন, দল বদলের স্রোত প্রভৃতি মিডিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

বিএনপি'র সঙ্গে ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম রবের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন; বি. চৌধুরীর মহাজোটে যোগদান; প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা'র ভাগ্নে এস এম শাহজাদার পটুয়াখালী-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রাপ্তি; আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদের গণফোরামে এবং গোলাম মাওলা রনি'র বিএনপিতে যোগদান; রাজপথের নির্যাতিত আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া চায়ের কাপে ঝড়সহ তৃণমুলে আলোচনা-সমালোচনার রসদও জুগিয়েছে।

দুই.
সম্প্রতি টকশো’র আলোচনায় গোলাম মাওলা রনি এক মন্তব্যে বলেছিলেন, তারেক রহমান লাদেনের মতো গুহা থেকে দল পরিচালনা করে। অথচ সেই রনি এখন বিএনপি’র মনোনয়ন নিশ্চিত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ত্যাগ করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আজীবন সম্পৃক্ত থাকার শপথ নিয়েছেন। বাবা হত্যার বিচার না পাওয়া, দেশ পরিচালনায় সরকারের আদর্শের সাথে ব্যক্তিগত আদর্শের মিল না থাকার কারণ দেখিয়ে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার (২০০৫ সালে গ্রেনেড হামলায় নিহত) ছেলে অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়া হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে প্রার্থী হতে গণফোরামে যোগ দিয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের কাছে আদর্শের এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ের কথা বললেও রেজা কিবরিয়া হিসাবের খাতা মিলিয়ে দেখেননি স্বয়ং বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের এবং বারবার গ্রেনেড দিয়ে শেখ হাসিনা হত্যচেষ্টার বিচারই চলমান অথচ টানা দুই মেয়াদে দশ বছর শেখ হাসিনা নিজেও যেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

তিন.
একদিন টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে দেখতে পাই। মাজারের দিকে ফিরে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা-কর্মীসহ বঙ্গবীর খুবই নীরবতার সাথে বসে হয়ত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। ভাবছিলেন বঙ্গবন্ধুর কথা, স্মৃতিময় সাহচর্য। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা প্রমাণিত ও প্রশ্নাতীত। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতায় বঙ্গবীরের অবদান জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন না পাওয়ায় অথবা মূল্যায়িত হওয়ার মত যোগ্যতা হারানোয় কাদের সিদ্দিকী ড. কামাল হোসেনের কারণেই জাতীয় ঐক্যফ্রণ্টে যোগ দিয়েছেন। অথচ রাজশাহীর জনসভায় বঙ্গবীর তার বক্তব্যে বললেন, ‘ক্ষমতায় গেলে তিনি বঙ্গবন্ধু ও জিয়া সম্পর্কিত মানুষের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তা ঘোচাতে চান, তার নিজ দলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নারী কর্মী থাকলে তিন দিনের মধ্যে হাসিনাকে সরকার থেকে ফেলে দিতে পারতেন, বাংলাদেশের রাজনীতি বলতে খালেদা জিয়া-ইত্যাদি!

তার মত একজন মানুষ কীভাবে এ তুলনা করতে পারেন তা শুধু অবাক করার বিষয়ই নয়, বরং তার বক্তব্য ১৯৭৫ পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর খুনী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের পুরস্কৃত করা, শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যাচেষ্টা, ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার তথাকথিত জন্মদিন পালন ও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে জিয়া ও তার পরিবারের অবদান নতুন করে বাংলার মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছে।

চার.
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ নাগরিক ঐক্যের প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্নার সাথে তৎকালীন আমেরিকায় অবস্থানরত বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী অজ্ঞাত এক ব্যক্তির সঙ্গে টেলিফোন কথোপকথন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেখানে তিনি সরকার উৎখাতে সামরিক হস্তক্ষেপে আগ্রহ প্রকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই-তিনটি হল দখল এবং ক্যাম্পাসে মিছিলে হামলা করে দুই-তিনটি লাশ ফেলে দেওয়ার কথা বলেন (যদিও তিনি পরবর্তীতে অস্বীকার করেন)। ভাবতে বড় কষ্ট হয়, জনাব মান্না এক সময় বড় দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা ছিলেন। অথচ ক্যাম্পাসে অস্থিরতা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চেয়েছিলেন। টেলিফোন কথোপকথন সংবাদ মাধ্যমে দ্রুত প্রকাশ না পেলে না জানি কি হতো!

পাঁচ.
ক্ষমতার ভারসাম্য ও জামায়াত প্রশ্নে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদান না করে আদর্শগত কারণে মহাজোটে যোগদান করেছে। শেষ মুহুর্তে বিকল্পধারার পিছুটান আমার দাদা’র (পিতামহ) ‘ভাত পেলেই খেতে নেই, জায়গা পেলেই বসতে নেই’উপদেশটির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে কথাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় এখন।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটির সদস্য জনাব বি. চৌধুরী যে দলের উন্নয়নের জন্য জীবনের বড় একটি সময় ব্যয় করেছেন, তাকে এক রকম অপমান ও বড় কষ্ট নিয়ে সেই দল থেকে বিতাড়িত ও রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তার এই বেদনাময় ইতিহাসের পেছনে ছিল ‘রাষ্ট্রপতি একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি’ কারণ দেখিয়ে মৃত্যুবার্ষিকীতে জিয়ার মাজারে রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরীর ফুল দিতে না যাওয়া, ইতিবাচক রাজনীতিমনস্ক মাহী বি. চৌধুরীর স্ব-স্ত্রীক মিডিয়ায় উপস্থিতি ও জনপ্রিয়তা, বিএনপির রাজনীতিতে মাহী বি. চৌধুরীর রাজকীয় আগমন এবং ২০০১ সালে শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় মুন্সিগঞ্জ গেলে তাকে তোরণ নির্মাণসহ বিভিন্ন ভাবে মাহী বি. চৌধুরী কর্তৃক সম্মানিত করা। সম্মানিত কাউকে শ্রদ্ধা-সম্মান করলে প্রতিদান পাওয়া যায়, মাহী ও পেয়েছেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে মাহী বি. চৌধুরীর একাদশতম সংসদ নির্বাচনের প্রতীক আজ ‘নৌকা’।

ছয়.
বঙ্গবন্ধুর উদারতায় ও স্নেহধন্যে তারই ছেড়ে দেয়া আসনে ড. কামাল হোসেন ১৯৭০ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জাসদের শাহজাহান সিরাজের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সর্বস্ব হারানো বঙ্গবন্ধুর এতিম দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ড. কামাল হোসেনকে রাজনৈতিক ও পারিবারিক অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি সাত্তারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিলেও ড. কামাল জিততে পারেননি। স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, যুদ্ধাপরাধ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং কমপক্ষে ২২ বার শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা প্রসঙ্গে তার নীরবতা জাতির সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর তাই, বর্তমানে অত্যন্ত আস্থাভাজন, পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত মহীরূহে পরিণত হওয়ায় বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার ‘চাচা’ড. কামাল বিএনপিতে ‘কামাল সাহেব’সম্ভাষণ পেয়েছেন।

তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহ-মমতা ও তার এতিম দুই কন্যার পরম আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিদান যেভাবে অতীতে দিয়েছেন আর বর্তমানে ‘যুক্তফ্রণ্ট’ ও ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার’ মাধ্যমে যেভাবে দেওয়ার বাসনায় সম্পৃক্ত হয়েছেন তা ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

রাজনীতির খেলা কিংবা খেলার রাজনীতি বড় বৈচিত্র্যময় হলেও সব দলের, নেতার রাজনীতি হোক নীতিগতভাবে আদর্শময় যা আমাদের মত আমজনতার প্রত্যাশা। যারা রাজনীতিবিদ তারা রাজনীতির মধ্যে না থাকতে পারলে বিকল্প পথে হাঁটবেন সেটাই স্বাভাবিক। অন্যের কাছে যেটা আদর্শহীনতা, সেটাই তাদের কাছে আদর্শ হবে বৈকি। তবে, রাজনীতির মাঠ আদর্শ, নীতিবান ও পেশাদার রাজনীতিবিদের হাতেই থাকুক সেটাই প্রত্যাশিত।

গত ৬ অক্টোবর, ২০১৮, শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ রাজনীতি, নির্বাচন ও মনোনয়ন নিয়ে হাস্যোরসের মাধ্যমে যা ইঙ্গিত করেছেন তাতে এক কঠিন বাস্তবতা উন্মোচিত হয়েছে যা অলংঘনীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। রাজনৈতিক সহচর কে বা কারা জনগণ তা বিচক্ষণতার সাথে অবলোকন ও বিবেচনা করে থাকে। তৃণমূল কর্মী ও সাধারণ মানুষের সাথে হাত মিলিয়ে যারা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেন তেমন অপেশাদার রাজনীতিবিদকে না বলুন। যারা শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিতদের পাশে সব সময় থাকেন তাদের জন্যই রাজনীতি।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পি.এইচ.ডি গবেষক, জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর