নির্বাচনে মাইনাস জিয়া পরিবার!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-27 04:59:42

বিএনপির প্রাণভোমরা হচ্ছে জিয়া পরিবার। সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলটি প্রতিষ্ঠা করার পর এই পরিবারের মাধ্যমেই দলটি বিকশিত হয়েছে, জিয়া পরিবারই দলটিকে পরিচালিত করেছে। দেশের এই জনপ্রিয় দলটি প্রায় এক যুগ ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে। ১০ বছর পর তারা জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে।

এবারের নির্বাচনে দলটি অংশ নিলেও জিয়া পরিবারের কেউ নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই। মামলা, কারাদণ্ড ও পলাতক থাকার সমস্যার কারণে এবার জিয়া পরিবারের কারো অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি। প্রায় চার দশক পর জিয়া পরিবারবিহীন বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ দলটির জন্য করুণ বিপর্যয়েরই বহি:প্রকাশ।

১৯৭৯ সালে এ দল থেকে নির্বাচন করে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান বিদ্রোহী কিছু সেনাসদস্যের হাতে নিহত হলে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসন চলাকালে ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে এই দলটি একতরফা বিতর্কিত নির্বাচন করে কিছু দিনের জন্য সরকার গঠন করেছিল। ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ওই দুই মেয়াদে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল ছিল বিএনপি। আওয়ামী লীগের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। তারপর থেকেই ক্ষমতা বলয় থেকে একেবারেই ছিটকে পড়ে দলটি।

এর আগের নির্বাচনগুলোতে জিয়া পরিবারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে বিএনপি প্রথমবারের মতো ভোটে অংশ নেয়। ওই নির্বাচনে খালেদা জিয়া ও তাঁর ভাই সাঈদ ইস্কান্দার বিজয়ী হয়। এরপর প্রতিটি নির্বাচনে খালেদা জিয়া ভোটে অংশ নিয়ে একাধিক আসনে জয়লাভ করেন। ভোটে প্রার্থী না হলেও বিভিন্ন সময় খালেদা জিয়া ও জিয়াউর রহমানের পরিবারের সদস্যরা ময়দানে ছিলেন। ২০০১-এর নির্বাচনে দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচন পরিচালনায় সরাসরি ভূমিকা পালন করেছিলেন।

খালেদা-তারেক একসঙ্গে মাইনাস– দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ইতিহাসে এমন দুঃসময় আর আসেনি কোনও দিন। দুর্নীতির দুটি মামলায় দশ এবং সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। গত আট মাস ধরে তিনি কারাবন্দি। তার বড় ছেলে তারেক রহমানেরও দুর্নীতির দুটি মামলায় সাত ও দশ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। এছাড়া ২১শে আগস্ট মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে তার। এসব দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় বিএনপিকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে হচ্ছে।

বিএনপির জন্য রাজনীতি এখন আর সহজ নেই। একথা বলা যায় বিএনপির রাজনীতি কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে গেছে। সংগঠন হিসাবে বিএনপির দুর্বলতম অবস্থান খালেদা মুক্তির ইস্যুতে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। নেতাদের কথাবার্তা এবং তৎপরতার বিশ্বাসযোগ্যতাও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির এই এলোমেলো, দ্বিধাগ্রস্ত ও অসহায় অবস্থান কেন এবং কীভাবে তৈরি হয়েছে? কে বা কারা এই দলীয় অধঃপতনের জন্য দায়ী, সেই প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে আসছে।

অনেক বিশ্লেষকের মত হচ্ছে, বেগম জিয়া এবং বিএনপির আজকের এই পরিণতির জন্য দায়ী তারেক রহমান। আর মা হিসেবে সন্তানকে শাসন করার ব্যর্থতাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। লোভ, ক্ষমতার মদেমত্ত বিপথগামী সাবালক সন্তানকে তিনি শাসন করতে পারেননি। আর পারেননি বলে তিনি নিজে আজ করুণ পরিণতির সম্মুখীন। তারেক রহমান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের পরিকল্পনায় ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা করে শেষ করে দিতে চেয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের। এ ঘটনা ক্ষমার অযোগ্য জেনেও তিনি ছেলেকে বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন বেআইনি পন্থার। নিজের শাসন আমলে বিচার করেননি এ অপরাধের। বরং দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন আওয়ামী লীগের ওপর। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার নোংরা খেলায় ছেলের অন্যায়ের কাছে মাথানত করেছেন। এতিমদের জন্য আনা টাকা নয়-ছয় করার খেলায়ও ছেলের সঙ্গী হয়েছেন। পরিণতিতে এই শেষ জীবনে এসে নানা রোগব্যাধি নিয়ে নিঃসঙ্গ কারাবাস করছেন। ভোগ-বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবনে এরচেয়ে নির্মম পরিণতি আর কি হতে পারে?

ক্ষমতা থেকে অপসারিত হবার পরে বেগম খালেদা জিয়া একবারও এদেশের গণমানুষের কোনো সমস্যার বিষয় নিয়ে আন্দোলন বা কোনো কর্মসূচি দেননি। একবার তিনি তার শহীদ মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে আইনি উচ্ছেদের সময়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনার আহ্বান প্রত্যাখান করে দশম জাতীয় নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়ে হরতাল অবরোধ আর আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছিলেন। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের সেই কান্নার রোল, অগ্নিদগ্ধ বিপন্ন মানুষের সেই আহাজারি দেশের মানুষ ভুলতে পারেনি। মানুষকে পুড়িয়ে মারবার নির্মমতা হিংসাত্মক নৈরাজ্য, নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকতে তারা দেশের বহু মানুষের জানমালের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি করার পরও জনস্বার্থে তিনি আর কোনা রাজনৈতিক কর্মসূচি দেননি। ইতিমধ্যে দলটি বিদেশি কূটনীতিকদের আস্থাও হারিয়েছেন। সম্প্রতি বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠক করেছেন। এবং তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, ‘বেগম জিয়াকে অন্যায়ভাবে সরকার কারাগারে নিয়েছে’।

কিন্তু কূটনীতিকদের মন তাতে গলেনি। একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বিএনপি নেতাদের প্রশ্ন করেন, দলের চেয়ারপারসন যখন দণ্ডিত তখন আর একজন দণ্ডিত এবং বিদেশে নির্বাসিতকে কেন আবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হলো? সেই প্রশ্নের জবাব কোনো নেতা দিতে পারেননি। যেমন ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে’র ঠিকানা, অস্তিত্ব, কোথায়? তা বলতে পারেননি খালেদার বিজ্ঞ ব্যারিস্টার আইনজীবীগণ!

বিএনপি রাজনীতির এই অন্তিম দশার জন্য আরও যা দায়ী তা হচ্ছে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী ও মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে জোটবাঁধার রাজনীতি। দেশের জনগণের পরিবর্তে দেশি-বিদেশি শক্তিকে আশ্রয় করে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের অলীক স্বপ্ন দেখে বিএনপি ক্রমেই রাজনীতি থেকে কক্ষচ্যুত হয়েছে।

বিএনপি এর আগেও বহুবার নানান জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হঠাৎ মৃত্যুর পর এবং এরশাদের ক্ষমতা দখলের পরও সঙ্কটে পড়েছে। এক এগারোর সরকারের সময় বিএনপির সঙ্কট ছিল আরো ভয়াবহ। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে বেশি জটিল। সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে দলের মধ্যে তারেকের নেতৃত্ব এবং নির্দেশ মেনে দলের ঐক্য আর সংহতি বজায় রাখার সমস্যা।

অনেকে অবশ্য বিএনপির মধ্যে কোনো সংকট দেখছেন না। বিএনপির সুহৃদ ডা. জাফরুল্লাহ তো অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হবে, ২ জানুয়ারি বেগম জিয়া মুক্তি পাবেন। যেন সব ছক তৈরি আছে। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব?

এটাও ঠিক যে, আমাদের দেশে অসম্ভব বলে কিছু নেই। অসংখ্য নদীবাহিত পলিমাটির এই বাংলাদেশে তিনটি জিনিস খুব ভালো জন্মে এক, অতি অল্প পরিশ্রমে সোনার ফসল। দুই, মানুষ। আর তিন মিরজাফর। এদেশে মিরজাফরের অভাব নেই। যুগে যুগে নানা সময়ে তাদের আবির্ভাব লক্ষ করা গেছে। এই মীরজাফররা অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে!

তবে একথা অনস্বীকার্য যে, আপাতত বিএনপি নামের ‘প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানী’র ভবিষ্যৎ কি বা জিয়া পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে-তা অনেকটাই অষ্পষ্ট। তারেক রহমান এবার স্কাইপে-ভাইবার প্রভৃতি ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের অ্যাপস ব্যবহার করে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নিয়েূছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতায় লন্ডনে বসে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেয়া আদৌ কি সম্ভব?

বিএনপি দলের প্রতিষ্ঠাতা সামরিক শাসক জিয়া যেমনভাবে বলতেন,মানি ইজ নো প্রবলেম’ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার এই আপ্তবাক্য ‘মানি’ই যে তার স্ত্রী-পুত্রের জন্য প্রোবলেম তৈরি হবে তা কি তিনি আদৌ জানতেন? তিনি আরও বলেছিলেন,আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ান’ আজ তার রাজনীতিক স্ত্রী-পুত্রের জন্য পলিটিক্সই শুধু নয়, সত্যিই তাদের জীবনযাপনই ডিফিকাল্ট হয়ে গেছে। আর এটাই হচ্ছে নির্মম নিয়তি!

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর