সম্প্রতি বঙ্গবাজারে ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি তাৎক্ষণিক সহানুভূতি দেখানোর সময় দাতাদের ব্যাপক সাড়া দেখা যাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্তরা অনেকেই ঋণের টাকা বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারিয়ে অকুল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন, কেউ শিশুর মতো হাঁউমাউ করে কান্নাকাটি করছেন ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আহাজারি করে চলেছেন। একজন টিভিতে সেদিন বলেছেন, ‘তার পকেটে একটি টাকাও নেই। শুধু পানি দিয়ে তিনি ইফতার করেছেন। গতকাল কোটি টাকার মালিক ছিলেন তিনি আজ পথের ফকির বনে গেছেন।’ এটাই আমাদের দেশের মতো উঠতি অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত চিন্তা ও ব্যবস্থা না করে আমাদের দেশে অগোছালো উন্নয়ন চলতে থাকায় ‘উন্নয়ন বিপর্যয়ের’ সময় সেটার দায় নেয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা গড়ে উঠেনি। তাই কোন বড় বিপর্যয় ঘটলে তার দায় ও চাপটা সবসময় সরকারের ঘাড়ে এসে ভর করতে বাধ্য হয়। এজন্য কোথাও পর্যাপ্ত না হোক, নূন্যতম বীমা ব্যবস্থাও নেই যে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যেতে পারে। সেটা সড়ক দুর্ঘটনা, শিল্প দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ড যাই হোক না কেন।
বঙ্গবাজারে ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের শুধু পানি দিয়ে ইফতার করার সংবাদে বিচলিত হয়ে তাদের প্রতি তাৎক্ষণিক সহানুভূতি জানিয়ে আমাদের বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান তাঁর ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি ইফতারের জন্য বিশ হাজার টাকা প্রদানের কাথা ব্যক্ত করেছেন। এটা একটা অনুপ্রেরণামূলক ঘোষণা। এটা জানিয়ে তিনি তার সতর্থী ক্রিকেটারদেরকে সহানুভূতি জানাতে এগিয়ে আসারও আহবান জানিয়েছেন।
কিন্তু এই অর্থ প্রদানের ঘোষণাটি ভিন্নভাবে নিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তদের একজন। বোঝা যাচ্ছিল যে, টাকার অঙ্ক কম হওয়ায় তিনি সেটাকে টিভি ক্যামেরার সামনে ‘সাকিবের টাকায় থু দিই’ বলে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে প্রকাশও করেছেন। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে সেটা নিয়ে শিরোনাম হয়েছে। সেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিটির বলার ভঙ্গি ও আচরণ এমন খারাপ ছিল যে ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি একটি বড় বিপদে পড়েছেন। অথবা তিনি যাকে নিয়ে এই বিদ্রুপ করছেন তাতে তিনি শুধু তার নিজেকে নয় দেশবাসীকে ছোট করেছেন ও সারা পৃথিবীর ক্রিকেট সমর্থকদেরকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করছেন।
আরেকজন বলেছেন, তাদের নাকি অনেক আছে। তিনি সাকিবের যদি লাগে তার কাছ থেকে আরো বিশ হাজার নিয়ে ৪০ হাজার দিয়ে সাকিবকে ইফতার করতে বলেছেন। এই বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল, সাকিব বানরের গলে মুক্তার হার দিতে চেয়ে আসলেই ভুল করেছেন। কারণ তারা দানের মর্যাদা বুঝে না। দান যে শুধু কাড়ি কাড়ি টাকার অঙ্ক নয়, মণিমানিক্য নয়, বরং এটা একটা দোয়া। সেটা সাকিবকে হেয় করে বক্তব্য দেয়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিটি বা তাদের অনেকেই অনুধাবণ করার যোগ্যতা রাখেন না।
কারণ তাঁর খোলা মন নিয়ে শুধু ইফতার করার জন্য বিশ হাজার টাকার কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি তো বলেননি যে তিনি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের পুণর্বাসনের জন্য এ সামান্য অর্থ দিবেন। পুণর্বাসনের জন্য তার পরবর্তী ঘোষণা জন্য সেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিটি সাকিবকে বা সাকিবের মাধ্যমে ধনাঢ্য দানশীল ব্যক্তিদেরকে এগিয়ে আসার আহবান জানাতে পারতেন।
এটাই হলো আমাদের অজ্ঞতা। এটাই আমাদের জাতিগত দুর্বলতা। একজন সেদিন বলেছেন, ‘আমরা এতটাই অজ্ঞ ও অকৃতজ্ঞ যে কোনকিছু ঠিকমত বলতেও জানি না, চাইতেও জানি না, পাইতেও জানিনা।’ তার কথাটা বহুলাংশে সঠিক।
এছাড়া সব জায়গায় আমাদের সন্তুষ্টির অভাব রয়েছে। বিদেশে চাকুরি করতে গিয়ে বিশেষ করে সৌদি আরবের পবিত্র স্থানে বেতনের টাকায় বহু শ্রমিকের সন্তুষ্টি নেই। তারা অনেকেই ভাল বেতন পান তবুও কাজের মধ্যেই সুযোগ পেলে কাজ ফাঁকি দিয়ে মানুষের কাছে হাত পাতেন। অনেকেই দান-খয়রাত, জাকাতের অর্থ গ্রহণ করেন নানা অজুহাতে দেশের দরিদ্রদের কল্যাণে ব্যয় করবেন বলে। সেসব অর্থ অনেকই দেশে গরীব মানুষকে প্রদান না করে নিজের বাইক, গাড়ি কিনেন, বাড়ি বানান, নিজ ব্যবসায় লগ্নি করেন।
অথবা, পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদেরকে দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দেন। সেসব দানের অর্থ গ্রহণ করে নৈতিকতার বালাই খুঁজে পাওয়া যায় না অনেকের কাজে কর্মে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরেও অনেক ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ লক্ষ্যণীয়। তাইতো দেশের মধ্যে উন্নয়নের বরকত উধাও হয়ে যায়। তাদের লাভের গুঁড় পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলে। সেটা অনেকেই অনুধাবনও করতে পারেন না। কাজের মধ্যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও কপটতা থাকায় আমারা বহু ক্ষেত্রে উন্নয়নের বরকত খুঁজে পাই না। বরং প্রত্যহিক জীবনে হতাশা ও দুর্দশা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
তাইতো সাকিবের ইফতারের বিশহাজার টাকা দানকেও আমরা থুথু দিতে একবারও ভাবি না। অন্যদিকে এমন একটি খারাপ কথা বিনা সেন্সরে গণমাধ্যমে দ্রুত প্রচার করা হয়ে যায়। বিশ হাজার টাকা ইফতারের জন্য দিতে চেয়ে সাকিব কি কোন ভুল করেছেন? দান কম হোক বেশী হোক এটা বলা কি দাতার জন্য কোন অন্যায়? সাকিবের ঘোষণার আগে দেশের কোন কোটি কোটিপতিরা তো এ বিষয়ে সমানুভূতির ঘোষণা দিতে এগিয়ে আসার সৎসাহস দেখাননি । তাহলে সাকিবের মহৎ ঘোষণাতে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে কেন?
এটা আমাদের বড় অজ্ঞতা। এটা অনেক বড় অকৃতজ্ঞতা। খাই খাই স্বভাবে মানুদের কখনও পেট ভরে না। তারা কোন কিছুতেই কখনও সন্তুষ্ট নয়।
আর হ্যাঁ, খাই খাই স্বভাবের মানুষেরা যেন-তেন প্রকারে সবকিছু অর্জন করে ফরতে চায়। সবকিছুকে নিজের মনে করে দখলে নিয়ে চলতে চায়। কিন্তু সবার জীবনে একসময় খারাপ খরা সময় আসে। সেই দারুণ সময় ও কৃতকর্ম তাদেরকে ক্ষমা করে না। এটাই তাদের নিয়তি।
দান-খয়রাত, সাদাকা, যাকাত ইত্যাদি ইসলাম ধর্মের অন্যতম বড় রীতি। দান-সাদাকাকে সসম্মানে পবিত্র মনে করতে হয়। যাকাতের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাপের উল্লেখ থাকলেও দানের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্টতা নেই। দান দাতার যেমন সামর্থ্য বা যিনি যেমন পারবেন তেমন দান-খয়রাত করবেন। দান চাওয়ার আরেক অর্থ সহযোগিতা কামনা করা, দোয়া চাওয়া, বরকত ও রহমত অনুসন্ধান করা। আমরা কেউ দান প্রদান করি, কেউ সেটা গ্রহণ করি।
মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ‘উপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম।’এর অর্থ- দান গ্রহীতার চেয়ে দান দাতাই উত্তম। আমাদের সমাজে দান দাতার সংখ্যা কম। দান গ্রহীতার সংখ্যা অনেক বেশী। তার প্রধান কারণ, পার্থিব ভোগবাদীতার নীতি মানুষের মধ্যে দিন দিন বেড়েই চলেছে। ধনী ও সম্পদশালীরা সব জায়গায় বেশি সুবিধা ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে আকাশচুম্বি ভবন ও অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে সেগুলোতে তালা-চাবির ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে বদ্ধদুয়ার নীতির ব্যাপকতা ছড়িয়ে দিয়েছে। ফলে, দানগ্রহীতারা সেখানে প্রবেশাধিকার হারিয়ে ফেলছে। এজন্য দান দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হওয়ায় অকৃতজ্ঞতা ও অসন্তুষ্টির ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এই অসস্তুষ্টি থেকে মানুষের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানুষ পড়াশুনা করতে চায় না। বর্তমানে কৃত্তিম বুদ্ধিতে লেখাপড়ার জন্য চ্যাটের উপর ধর্ণা দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। তারা ধর্মীয় পড়াশুনাও ভুলে গেছে। নৈতিকতার কথা শোনালে ‘খ্যাত’ বলে উড়িয়ে দেয়। এসব কথা জাতি হিসেবে আমাদের দ্রুত ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। এ যুগে প্রায় সবাই সামান্যতেই ধৈর্য্যহারা হয়ে তেড়ে আসে। পরিণাম না ভেবে অহেতুক অন্যায়ভাবে ভাল কথার উপরও প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব হয়। এভাবে মানব আচরণের চিরায়ত গুণ শালীণতা দিন দিন উবে যাচ্ছে। এই শিক্ষা নতুন করে আর কে দেবে?
মহানবী (সা:) বলেছেন, ‘সুন্দর আচরণই নেক আমল’ (সহীহ মুসলিম)। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা দান কর প্রকাশ্যে- যা উত্তম, এবং দান কর গোপনে- যা শ্রেয় এবং অভাবীদের জন্য। এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের পাপ মোচন করে দিবেন’। (সুরা বাকারা: আয়াত ২৭১)। অথচ, আমরা পাপ-পূণ্যের মধ্যে পার্থক্য করার শিক্ষা ভুলে যাচ্ছি দিন দিন। এজন্য পাপ বা খারাপ কাজের জন্য মনের মধ্যে কোন ভয় ও ধিক্কার সৃষ্টি হয় না। এটা মুমিনদের জন্য অন্ধকার সময়ের নমুনা।
আমাদের দেশে দিন দিন মানুষ মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। কারণ, কেউ কারো আত্মমর্যাদাকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। সবাই নিজেকে বড় ভাবে। শৃংখলা মানতে গিয়ে শৃংখলিত হবার ভয়ে চুপ করে সটকে পড়ে। পুলিশের কাজকে ভাল মনে বিশ্বাস করে না- সন্দেহ করে, ফায়ার ব্রিগেডের লোকেরা জীবন বাজি রেখে আগুন নেভাতে এলেও তারে উপর কৃতজ্ঞতা না দেখিয়ে উল্টো তাদের গাড়ি ভাংচুর করা হয়।
সাধারণ জনগণের এই মানসিকতা একদিনে তৈরী হয়নি। জনগণ দেশের মাথার পচন, চুরি-ডাকাতি, ঘুস, দুর্নীতির ফলে বার বার নিজেদের অধিকার খর্ব হবার ভয় থেকে দিনে দিনে এসব শিখে ফেলেছে। তাই তারা সবাইকে সন্দেহ করে। যে কোন বিপদে নিজেরা আগুয়ান না হয়ে সামান্যতেই ধৈর্য্যহারা হয়ে বিগড়ে উঠতে শিখেছে। এই নাজুক অবস্থার জন্য আমাদের গোট সিস্টেম দায়ী।
তাইতো আজকাল ভিক্ষুককে দশটাকা দান করলে খুশি হয়ে আগের মতো দোয়া করে না। সাকিবের মতো কেউ বিশ হাজার টাকা ইফতারের জন্য দান করতে চাইলে ন্যাক্কারজন উক্তি করে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বরেণ্য মানুষের চরিত্র হনণ করতে মোটেও দ্বিধা করে না। প্রযুক্তির মহা-বিপ্লবের এই যুগে এসেও কি আমাদের নৈতিক বোধোদয় হবে না?
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd