গভীর রাতে মাইকিং-এর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। গ্রামে দিন-রাত যখন-তখন মাইকিং করতে কোন বিধি নিষেধ নেই। ঘুমানোর এক ঘণ্টা পূর্বে ঈদের ছুটিতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত শরীরে খুব দ্রুত শুয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মাইকের শব্দে জেগে শুনতে চেষ্টা করলাম আসলে কি বলা হচ্ছে। সিনেমার বিজ্ঞাপণের মতো দু’থেকে তিনবার করে বলা হচ্ছিল- ‘একটি আনন্দ সংবাদ’। ভাবলাম কিসের আনন্দ সংবাদ এত রাতে?
কোথায় ঘুমিয়েছি এটা বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো। বিছানায় উঠে বসলাম। মনযোগ দিয়ে যা শুনলাম তা হলো- ‘একটি বিশাল আড়িয়া গরু জবাই হবে। স্থানীয় ওকড়াবাড়ি হাটের পাশের মাঠে, ভোর পাঁচটায়। আগেভাগে না আসলে মাংস শেষ হয়ে যাবে।’
বলতে বলতে বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে অটোরিকশায় বয়ে নেওয়া মাইকের শব্দ দূরে গিয়ে মিলিয়ে গেল। আমি আবার ঘুমানোর চেষ্ট করলাম। বিদ্যুৎ চলে গেল। আইপিএস সংযোগ নিয়ে ফ্যানটা ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দ করে ঘুরতে থাকলো। এই বাড়ির আগন্তুক প্রায় সবাই শহুরে। বাড়িতে আসে কালেভদ্রে, ঈদ বা কোন অনুষ্ঠানে। মানুষ কম থাকায় এ ঘরে দীর্ঘদিন কেউ ঘুমায়নি। তাই আইপিএসের ব্যাটারিতে পানি-চার্জ নেই। দু’পাশের জানালা খুলে দিলাম। বাইরের বাতাস বেশ শীতল। ফজরের আযান হয়ে যাওয়ায় তাৎক্ষণিক আর ঘুমানো হলো না। নামাজ শেষে আমার পিতা, দাদি ও পাশাপাশি থাকা স্থানীয়দের কবর জিয়ারত করলাম। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে অনেকে এসে জড়ো হতে থাকলো।
মনে হলো আর কোন ক্লান্তি নেই। ঘুমের চেয়ে আজ গল্পই ভাল। কথা প্রসঙ্গে রাতের মাইকিং উঠে আসলো। বললাম, আগামীকাল ঈদ। তোমরা কেউ ‘আড়িয়া গরুর মাংস’কিনবে না? একজন বলল, এখন দু’একদিন পর পর বড় বড় আড়িয়া জবাই করা হয়। আমার কেনার ইচ্ছা আছে। তবে আজ নয়, ঈদের চাঁদ উঠলে সেইরাত ভোরে আরও বড়, আরও মোটাতাজা গরু জবাই হবে। তখন কিনবো। রোজার ঈদের সময় এটাই স্বাভাবিক। বাইরে চাকরি করা বহু লোক গ্রামে আসে ঈদ করতে। তাই এসময় বিক্রিও হয় প্রচুর। তবে কোরবানির ঈদে এটা নেই।
বুঝলাম, এটা এখন গ্রামের কৃষ্টিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ছোট্ট হাট অনেক বড় হয়েছে। অজো পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় দিনরাত অসংখ্য অটোরিকশা চলাচল করে। আমাদের ছোটবেলায় এই হাট সপ্তাহ দু’দিন বসলেও কখনও গরু-মহিষ জবাই করতে শুনিনি। আজকাল সপ্তাহে কমপক্ষে দু’টি গরু জবাই হয়। সব মাংস ফুরিয়ে যায়। কোন কোন দোকানে ডিপফ্রিজে সংরক্ষণ করে সার্বক্ষণিক বিক্রির ব্যবস্থা আছে। তবে গ্রামের মানুষ তাজা কিনে খেতে ভালোবাসে। তাই ক্রেতা আকর্ষণের জন্য ঘন ঘন গরু জবাই করার মাইকিং চলে।
এবার ঈদে রাজধানী ঢাকার আবহাওয়া বেশ উত্তপ্ত। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রিতে উঠেছে। খুলনা ও রাজশাহীতে আরও বেশি-৪২ ডিগ্রি ক্রস করেছে। কিন্তু উত্তরের হিমালয় সংলগ্ন জেলাগুলোতে বেশ শীতল আবহাওয়া। ঈদের রাতেও ফ্যান বন্ধ করে কাঁথা গায়ে দিতে হয়েছে।
ঈদের চাঁদ দেখা যাবার পর ঈদ জামাতের জন্য মসজিদ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। এরপর গভীর রাতে আবারো আনন্দ সংবাদ নিয়ে কয়েকবার মাইকের আওয়াজ শুনতে পেলাম। সেগুলো পাশের গ্রামের। অর্থ্যাৎ, প্রতিটি গ্রামে আলাদা আলাদা ভাবে ‘বিশাল আড়িয়া গরু জবাই হবে’ বলে রাতে প্রচারণার ধুম শুরু হয়ে গছে। ইন্টারনেটের সুবাদে আরবি গান বাজিয়ে মানুষের মনযোগ আকর্ষণ করা হচ্ছে।
চাঁদরাতে গ্রামের অনেককে কাছে পেলাম। স্থানীয় ঈদগাহ সাজানো হচ্ছে। পাশেই পুকুর ও স্কুলের ফুটবল মাঠ। সেখানে গোল হয়ে বসে গল্প-গুজব করার ফুরসত হলো। বাইরে থাকা অনেকেই গ্রামে হাজির হয়েছে। সবাই গ্রামের মানুষের কুশল জানতে বেশি আগ্রহী। বিশেষ করে গ্রামের পরিবর্তন নিয়ে। একজন জানালো- মাইকিং সারা বছর চলে। এখন ঈদ উপলক্ষে মাইকিং হচ্ছে। অন্যসময় বিয়ে, হালখাতা, ওয়াজ, যাত্রা-মেলা, সার্কাস সবকিছুর মাইকিং শুনতে হয়। তবে ষাঁড় জবাই সারা বছর চলে। ক্রেতার অভাব নেই। ঈদ ছাড়া অন্যসময় এই মাংসের প্রধান ক্রেতা অটোরিকশা চালক!
একজন অটোচালককে ওখানেই পাওয়া গেল। তাদের কোন চাষের জমি নেই। সে ছেলের বিয়েতে যৌতুক নিয়েছে এবং নিজেদের যা কিছু ছিল তা বিক্রি করে বাপ-বেটা দুটো অটোরিকশা কিনেছে। সেগুলো চালিয়ে যা আয় করে তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রতিদিন ভোরবেলা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অটো চালায় তারা। চালাতে চালাতে নিজ জেলা ছাড়িয়ে পাশের জেলায় চলে যায়, আবার ফিরে আসে এই পরিচিত ডেরায়। কারণ, নিজ বাড়িতে ফিরে এলে ঘর ভাড়া দিতে হয় না। মহাসড়ক ধরে লম্বা রুটে চালাতে পারলে আয় বেশি হয়।
ওদের দৈনিক আয় এক হাজার টাকা। দুজন মিলে গড়ে দু’ হাজার টাকা আয় হয়। এখন বৌ, নাতি-পুতি মিলে বড় সংসার। অনেক খরচ। দ্রব্যমূল্যের দাম খুব বেশি। তাই প্রতিদিন অটো নিয়ে রাস্তায় বের হতে হয়। বিশ্রামের জন্য আলাদা সময় নেই। তবে বয়স বেড়েছে। কোমর ও হাঁটুতে ব্যথা তাই মাঝে মাঝে অটো চালাতে খুব কষ্ট হয়। চিকিৎসা খরচ বেশি। অনেক ওষুধ খাই। বাজারে জিনিসের দাম বেশি তাই কোন জমা করতে পারি না। সারাদিন বাইরে থাকি। বাজারের হোটেলে দু’বেলা নাস্তা-খাবার কিনে খাই। ঘুম লাগলে গাছের নিচে অটো দাঁড় করে সিটে শুয়ে ঘুমাই।
বিনোদনের জন্য অটোর মধ্যে সাউন্ড বক্স লাগিয়ে নিয়েছি। সেটাতে নানা গান বাজাই। অনেক যাত্রী ওয়াজ শুনতে পছন্দ করে। গভীর রাতে একাকি ফেরার সময় রাস্তায় উচ্চস্বরে ওয়াজ বাজিয়ে বাড়ি ফিরি। আমার স্ত্রী, নাতি-পুতি সবাই মাছ-মাংস ছাড়া ভাত খেতে চায় না। তাই প্রতিদিন কিছু কিনতে হয়। বিশেষ করে গরুর মাংস ওদের খুব প্রিয়। কিন্তু এখন গরুর মাংসের দাম সাতশ’ পঞ্চাশ টাকা কেজি। তবুও হাফ কেজি বা বট-পায়া হলেও বাড়িতে নিয়ে আসি। যেদিন ভাল ভাড়া পাই না সেদিন বাকিতে হলেও কিছু মাংস নিয়ে আসি। কসাই জানে আগামীকাল আয় করে টাকা দিয়ে দেব আমি। আমার মত অনেকে মাংস কেনে বাকিতে। এখানকার অটোরিকশা চালকদের সবাই চেনে। তাদেরকে বাজার খরচও বাকিতে দেয়। বাকি শোধ দিতে না পারলে গাড়িতে চড়ে দাম শোধ করে নেয়।
যারা অটোরিকশা চালিয়ে কিছু অর্থ জমা করে তারা সেটাকে ভাল কাজে লাগায় না। তারা আয় করে ষাঁড়ের মাংস কিনে খায়, ঘুমায় আর বাঁশঝাড়ের মোড়ে দল বেঁধে বসা জুয়া, ডাব্বু, লুডু, তাস, ক্যারম ইত্যাদির আসরে টাকার বিনিময়ে বাজি খেলায় মেতে উঠে। গ্রামের কিছু জুয়াড়ি চক্র তাদের সর্বস্ব লুটে নেওয়ার ফন্দি আগেভাগেই গড়ে তুলেছে। আজকাল টাকার অঙ্কে বাজি ধরা ব্যতিরেকে গ্রামে কোন নির্মল আনন্দের খেলাধুলা হয় না। কোন কোন গ্রামে মসজিদের দেয়ালের পাশের দোকানগুলোতে নামাজের সময় গান বাজে, তাস-লুডুর আড়ালে জুয় খেলা চলে।
বন্যা ও শীতের সময় কি একই পরিমাণ আয় হয়? সে বললো না। অনেকে বন্যার আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও গাজীপুরে চলে যায়। সে আবাসনে একটি ঘর বরাদ্দ পেয়েছে। সেখানে স থাকে না। ওখানে অনেকেই অটো চালায় তাই সকালে ভাড়া জুটে না। একজন বললো সে আবাসনের ঘরটি ভাড়া দিয়েছে। কিন্তু সেটা জানতে চাইলে সে ঘোচমোচ করে, রাগ করে চলে যেতে উদ্যত হলো।
তাকে আবার বসানো হলে সে জানালো আবাসনের ঘরটা ভাল কিন্তু মুরগি-ছাগল কিছু পালা যায় না। ঘরের পাশে খোলা জায়গা নাই। প্রতিবেশীর সাথে হাঁস, মুরগি, চড়াই-ছাগল নিয়ে ঝগড়া বাঁধে। প্রতিবেশীরা সবাই নিজেকে সাড়ে তিনহাত মনে করে। অপরকে শ্রদ্ধা করে না। ওখানে একটা গাই-গরুও রাখার জায়গা নাই। তাই আমি এখানে থাকি।
ওদিক দিয়ে আবারো একটি অটো যাচ্ছে মাইক বাজাতে বাজাতে। আরবি-হিন্দি সিনেমার গানে ঝংকার তুলে আনন্দ সংবাদ দিতে দিতে। কার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো আর কার মনে কষ্ট বাড়ালো সেটা ঐসব মানুষের মনে দাগ কাটে না। মজার ব্যাপার হলো শুধু অটো চালকরা ভাল আয় করে, ভাল খায়। কিন্তু গ্রামের অন্যপেশার প্রান্তিক মানুষেরা কীভাবে চলছে?
ওরা নিশ্চয়ই আড়িয়া গরু জবাই করার মাইকিং শুনে আর আফসোস করে? কারণ সাতশ’পঞ্চাশ টাকা কেজি দামি মাংস তাদের জন্য আনন্দ সংবাদের পরিবর্তে কষ্টের আবহ নিয়ে আসছে। ওদের জন্য আনন্দ সংবাদের ব্যাপক প্রচারণা মনে সীমাহীন কষ্ট বাড়ায়। এজন্য সুগভীর মাঠ জরিপ ও সামাজিক গবেষণা চালানোর সময় হয়েছে।
এখন এই গ্রাম আর আগেকার সেই শান্ত সুনিবিড় গ্রামটি নেই। অনেকের অভিযোগ তাদের প্রতিবেশীরা অনেকটা পাষাণ হয়ে গেছে। কেউ কারো দুঃখ-কষ্টের ভাগিদার হতে চায় না। দলীয় রাজনৈতিক রেষারেষি প্রকট আকার ধারণ করেছে এদের চলন-বলনে। মানুষ বদলে গেছে। বদলে গেছে তাদের আনন্দ করার উপকরণ। ভোগবাদি চিন্তায় আনন্দ সংবাদের মাইকিংয়ে সবাই মাতোয়ারা হবে মনে করা হলেও সবার জীবনে ‘বিরাট আড়িয়া গরু জবাই’ হবার সংবাদ মনে খুশির ঝিলিক দেয় না। এ যেন পাড়গাঁয়ের বিত্তশালী ক্রেতাদের আনন্দ সংবাদ।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।