বন্ধু-শত্রু বিতর্কে কালযাপন কষ্টকর

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 09:09:58

 

ক’দিন ধরে আবারো আমপাকা গরম পড়েছে। তাপমাত্রা বেড়ে দিনের বাতাস তেতে উঠছে। তবে রাতের পরিবেশটা কিছুটা আরামদায়ক। কাজের চাপে সকালে ও দিনে বাইরে যাবার সময় বের করা খুব কঠিন। তাই দিনের পরিবর্তে রাতেই কিছুক্ষণ হাঁটার নিয়ম চালু করা হয়েছে। প্রতিদিনের মতো কয়েকজন মিলে হাঁটছি। ডুরি ও মুনিও ম্যাঁও ম্যাঁও বলে প্রায় নির্জন বাসার সামনের রাস্তায় আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। কিন্তু এক প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে আসতেই ওদের দিকে ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এলো সাতমাস বয়সী নতুন এক আগন্তক। ওর ক্ষ্যাপা চাহনি দেখে ডুরি ও মুনি ভয় পেয়ে অপর দিকের বাড়ির বাগানে লাফিয়ে ঢুকে লুকিয়ে পড়লো।

প্রতিবেশীর নতুন কুকুরটি শান্ত হলে ডুরি ও মুনিকে আড়াল থেকে বের করে আনতে বেশ বেগ পেতে হলো। একই বাড়িতে কুকুর-বিড়াল একসংগে বসবাস করে, খায়, ঘুমায়। কিন্তু নতুন কেউ সামনে এলে আর রক্ষা নেই। কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসবে এবং বিড়াল ভয়ে পালাবে-এটা যেন একটি চিরন্তন ব্যাপার। ওরা এক অপরের শত্রু হয় কেন তা বোঝা খুব মুষ্কিল। ডুরি ও মুনিকে রাস্তায় আর সামলানো যাচ্ছিল না। অগত্যা সেদিন হাঁটা বন্ধ করে ওদরেকে নিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরতে হলো।

হাঁটার সঙ্গী বন্ধুদের দু’জন আমার চায়ের আমন্ত্রণ পেয়ে আমার সাথে বাসায় এলো। রাত ন’টায় টিভিতে খবর হচ্ছে। আমি কিছু শুকনো খাবার সহ দ্রুত চা বানিয়ে নিয়ে ওদের সাথে বসে পড়লাম। ওইদিন সংসদের বিশেষ অধিবেশন শেষ হয়েছে। খবরে অনেক রাজনীতিবিদের বক্তব্য শোনা যাচ্ছিল। খুব গরম খবর। একটি পত্রিকা নিয়ে সেদিন সংসদে দেয়া বক্তব্য প্রচার শুরু হলে একজন মুখে আঙ্গুল দিলে সবাইকে চুপ করতে বললেন। আমরা শুনলাম, ...‘নাম তার ...বাস করে অন্ধকারে। এরা এই দেশে কখনও স্থিতিশীলতা দেখতে চায় না।’আমি তাঁর বক্তব্যের আগের কথাগুলো ভালমতো শুনতে পাইনি। তাই আরেকটি চ্যানেলে গিয়ে পুরোটা শোনার চেষ্টা করলাম। খবরে বলা হয়েছে, ‘পত্রিকাটি ... শত্রু, দেশের শত্রু, দেশের মানুষের শত্রু’ইত্যাদি। বিষয়টি ছিল মহান স্বাধীনতা দিবসে সেই পত্রিকায় প্রকশিত স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করে বলা একজনের বক্তব্য ছাপানোর বিষয়ে। এ নিয়ে অবশ্য স্বাধীনতা দিবসের দিন থেকে দেশের মিডিয়া জগতে তোলপাড় চলছে। এজন্য সেই সাংবাদিক প্রেপ্তার হয়েছেন। প্রধান সম্পাদককে অবশ্য আগাম জামিন দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি মহান সংসদ পর্যন্ত গড়াবে তা অনেকটা অবাক করার মতো মনে হলো বন্ধুদের কাছে।

সেই দৈনিকটি দেশের প্রথম সারির হার্ড ও অনলাইন পত্রিকা। প্রচার সংখ্যার শীর্ষে এই দৈনিকের নীতিমালা স্বাধীনতার সপক্ষে কাজ করে থাকে। সে হিসেবে বর্তমান সরকারের সংগে শুরু থেকেই সুসম্পর্ক রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। আমরা জানি, পত্রিকাটি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মেধার সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম যা দেশের বর্তমান সরকার ও তাদের উন্নয়ন কর্মসূচিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

মাঠ পর্যায়ের একজন সাংবাদিক অপরাধ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। তবুও তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তিনি জেল খেটেছেন, কিছুদিন পর ছাড়া পেয়েছেন। তবুও বিষয়টি নিয়ে এত তোলপাড় করা নিজেদের মধ্যে আরো বেশী ফাটল তৈরী করছে বলে মন্তব্য করলেন একজন।

আরেকজন বললেন, এর পিছনে আরো বেশী হেতু আছে, গভীরতা আছে। যা হয়তো আমরা জানি না।

হয়তো বা তাই। কিন্তু ভেতরে বা গভীরে কি এমন ঘটেছে যে, একজন প্রধান নেতা মহান সংসদে দাঁড়িয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা নিয়ে এমন বক্তব্য দিতে আগ্রহী হলেন। এই বক্তব্য তাঁর স্ট্যাটাসের সংগে যায় কি? এরুপ বক্তব্য কোন একজন জুনিয়র সাংসদ দিতে পারতেন।

সংসদে দেয়া এই বক্তব্যের সূত্র ধরে যে কোন সংস্থা তদন্ত করতে পারে। পত্রিকাটিকে পছন্দ করে না এমন যে কেউ সুযোগ নিতে পারে। এছাড়া যেহেতু পত্রিকাটিকে দেশের সব মানুষের শত্রু হিসেবে বলা হয়েছে সেহেতু সতের কোটি মানুষের শত্রু এখন সেই পত্রিকা! বিষয়টি মোটেও ফেলনা নয়। তাহলে পত্রিকাটির বন্ধু সভা নামে সারা দেশে যে বিশাল পাঠক মহলের নেটওয়ার্ক তৈরী হয়েছে তাঁরা বিষয়টিকে শত্রু হিসেবে নেবেন কীভাবে? চা খেতে খেতে আরো অনেক আলোচনা সামনে চলে আসতে থাকলো।

সবার জীবনে সবসময় বন্ধু প্রয়োজন। যার একজন ভাল বন্ধু থাকে তার জীবনে কোন অভাববোধ নেই, যার একাধিক ভাল বন্ধু আছে তার কোন বিপদ নেই। বন্ধুহীন মানুষ হঠাৎ বিপদে পড়ে থাকে।

প্রতিটি বন্ধুর জন্য ভালবাসার প্রতিদান দিয়ে বন্ধুত্ব টিকে রাখতে হয়। বহুদিরে প্রচেষ্টায় তিলে তিলে গড়ে উঠা বন্ধুত্ব একটি ঘটনার জেরে বেঙ্গে যাবে এটা কীভাবে সম্ভব? অনেকটা গম্ভীর হয়ে বললো আরেকজন।

তবে পরম বন্ধু একদিন চরম শত্রুতে পরিণত হতে পারে। সেটা কেন? এই ধর, আমরা তিনজন আরো অনেকের সাথে একটু আগে হেঁটে এলাম। এখন একসংগে চা খাচ্ছি, গল্প করছি, আনন্দ করছি, কতকিছু শেয়ার করছি। আমরা কিভাবে চরম শত্রুতে পরিণত হতে পারি?

পরম বন্ধু চরম শত্রুতে পরিণত হলে মহাবিপদ ঘটতে পারে। এটা কখন হয়? কেন জানিস না? প্রবাদে অনেক সুন্দর কথা আছে। সেগুলো না-ই বা বললাম। একদল বন্ধুর মধ্যে কেউ অনেক বড় হয়ে গেলে সে নিজেকে দূরে রাখতে পছন্দ করে। ফোনও ধরতে চায় না। কিন্তু এখানে তো তেমন কোন বিষয় জড়িত নেই বলে মনে হয়। এখানে কেউ ছোট-বড় নয়। এখানে তো সবাই মহান, সবাই জ্ঞানী, সবাই সেলিব্রেটি, বিত্তশালী ও সম্মানিত বিখ্যাত মানুষজন।

পরম বন্ধু চরম শত্রুতে পরিণত হলে শুধু চোখের সামনে শত্রু নয়- সেটা যে কারো জন্যে মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে ওঠে। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর শত্রু হলে সেট সেই বন্ধুরা মোটেও মেনে নিতে পারে না। উভয় বন্ধুক সেই যন্ত্রণা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়, তিলে তিলে দগ্ধ করে ফেলে। এজন্য আত্মহত্যাও ঘটেতে পারে। একজন কেড়ে নিয়ে বললো, তুমি কি প্রেম- ভালবাসার কথা বলছো? তা তো বটেই। বন্ধুত্রে মধ্যে প্রেম-ভালবাসা না থাকলে সেই বন্ধুত্ব টিকে থাকে কিভাবে?

তাহলে- এর পিছনে কলকাঠির কথা ভাবছো? হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এখানে তো তেমন কোন বিষয় জড়িত নেই বলে মনে হয়। তবে...

তবে কি? এরূপ সমস্যার একটি কুলক্ষণ থাকে। তিলকে তাল কার, হাম্বরা হয়ে উষ্মা করা, জেদ করা ইত্যাদি ভাল নয়। এগুলো মানুষকে ভালবাসাহীন করে তোলে, অপরের ভালবাসা হারালে মানুষ দিক্বিদিক হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। বাদ দে এসব। কিছুদিন আগে ঘুসের দশ লক্ষ টাকা সহ কর-উপকমিশনার গ্রেপ্তার হয়েছে। সেসময় রমজান মাস ছিল। সে বলল, রমজান মাসে কর উপ-কমিশনারকে রোজায় ধরেনি, বদ নজরে ধরেছিল।

আরে বদ নজর, কুলক্ষণ, এগুলো তো শয়তানের নজর। রমজান মাস ছিল তো কি হয়েছে? সে সময় কি মানুষের মধ্যে এসব খারাপ বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে না? না, নির্দেশ অনুযায়ী পারে না। কারণ, রোজা শুরু হবার সাথে সাথে ইবলিস শয়তান হয়ে যায় শেকল বন্দি!

না রে বন্ধু! ইবলিস শয়তান শেকল বন্দি থাকলেও সবাই তো ইবলিসকে শয়তান ভাবে না। তারা ইবলিসের কর্মকান্ডকে পছন্দ করে। এই ধরো, ঘুস খায়, মিথ্যা বলে, চুরি-ডাকাতি করে, ইত্যাদি। এগুলো যারা চর্চ্চা করে তাদের মধ্যে ইবলিস ঢুকে রক্ত ও নার্ভাস সিস্টেমে তড়িৎ গতিতে দৌঁড়াতে পারে। অনলাইনের চেয়ে দ্রুত গতিতে কুমন্ত্রণা দিতে পারে। ইবলিস রমজানে বন্দি থাকলেও মানুষের মজ্জার ভেতরের মধ্যে ঠাঁই নেয়া তার শিষ্যরা তো সক্রিয়!

তা হলে তো মহাবিপদ! হ্যা, তাই। সেজন্য আমরা মহা জেদ করি। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে ভুলে যাই। মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটা ক্ষণিকের। জেদ করে ভালটাকে খারাপ বলি। আমার মন্দ-খারাপকে ভাল বলে চালাতে তৎপর হই। এসময় আমার পরম বন্ধু যদি নীতিবান হয় সে আমার চরম শত্রুতে পরিণত হতে পারে। কারণ তার সাথে আমার মন্দ স্বভাবের কারণে মানসিক দূরত্ব আগেই তৈরী হয়ে যেতে পারে!

আমি বললাম, রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল। আরেকটু বস, তোদেরকে খাবার দিতে বলি।  ফ্রিজে সব খাবার রান্না করা আছে। আমি গরম করে টেবিলে দিই। একজন বলল থাক্ আজ আর নয়। ওরা ঘর থেকে বের হতে উদ্যত হলে আমিও ওদের সাথে বাইরে বের হয়ে মেইন গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসলাম। একা ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, ঘনিষ্টজনকে নিয়ে বন্ধু-শত্রু বিতর্ক করে কালক্ষেপণ ও দীর্ঘকালযাপন করাটা কষ্টকর, ক্ষতিকর ও  বোকামী। আমার বন্ধুরা যদি কখনও আমার শত্রু হয়ে যায় তাহলে আমি মনের ভাব প্রকাশ করবে কাদের কাছে, আর মন খুলে কথা বলতে না পারলে পেট ফুলে যাবে, রাতে ঘুম হবে না । তোদের মতো দিলখোলা বন্ধু না থাকলে  সুস্থ শরীর-মন নিয়ে আমার বেঁচে থাকার উপায় কি হবে?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর