সত্তরের মতোই আরেকটি নির্বাচন সামনে

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) | 2023-08-21 21:20:10

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবি থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রামের পথে যে সব গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মাইলফলকসম ভূমিকা রাখে তার মধ্যে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অন্যতম বড় ঘটনা। একবার ভেবে দেখুন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন যেভাবে হয়েছে সেটি যদি না হতো এবং সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনী আসনের ১৬২টির মধ্যে ১৬০টি আসন না পেত তাহলে কি বাংলাদেশে স্বাধীন হতো? সব বিশ্লেষণ বলে হতো না। আর একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আজও বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কিনা তা নিয়ে অনেকেরই প্রবল সন্দেহ আছে।

বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি এবং রাজনৈতিক সাহস ও আত্মবিশ্বাসের ফলে সময়মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬০টি জাতীয় সংসদের আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ পুরো পাকিস্তানের মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের একক দাবিদার হতে সক্ষম হয়। তখন মাওলানা ভাসানীর মতো বড় নেতাসহ তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের অনেক বাঙালি সিনিয়র রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচন বয়কট করেন। তাদের যুক্তি ছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক এলএফও জারি বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন করে কোনো লাভ হবে না। এলএফও এর জোরে ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের ফল বাতিল করে নিজেই ক্ষমতায় থাকবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, নির্বাচনের পর এলএফও আমি টুকরা টুকরা করে ছিড়ে ফেলে দেব। দীর্ঘ সংগ্রামের পথে সাড়ে সাত কোটি মানুষের হৃদয় বঙ্গবন্ধু স্পর্শ করেছিলেন। তাতে তিনি বুঝেছিলেন, নির্বাচনে সমগ্র বাঙালি জাতি তার সঙ্গে থাকবে এবং অকাতরে দু’হাত ভোট দেবে। এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন যা অগ্রাহ্য করলে পাকিস্তানই ভেঙে যাবে এবং সে পথ ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত সেটাই ঘটেছে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ম্যান্ডেটের অপরিসীম গুরুত্বের কথা আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা সাংস্কৃতিক, সামাজিক, পেশাজীবী, শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠনগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সকলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে কাজ করলেও যেহেতু আদর্শগত লক্ষ্য ছিল এক, সে কারণে সকলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে প্রত্যেকটি সংগঠন একযোগে মাঠে নেমে পড়ে এবং বঙ্গবন্ধু ও নৌকার পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য মানুষের কাছে আবেদন জানায়।

সমস্ত সংগঠনের পক্ষ থেকে ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে বোঝানো হয় নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে গিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট দেয়াটা কতো জরুরি। সে সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওই সমস্ত অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোও বঙ্গবন্ধু ও নৌকার পক্ষে একযোগে মাঠে না নামলে এতবড় বিজয় অর্জন সম্ভব হতো না।

আজকে স্বাধীনতার ৪৭ বছরের মাথায় এসে আসন্ন ২০১৮ সালের নির্বাচনটি ঠিক একইভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন এই নির্বাচনটিকে আমরা সত্তরের নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি তার কিছুটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন, যদিও একটি কলামে তার পূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে প্রথম সরকার গঠনের পরপরই এক ভাষণে বলেছিলেন, স্বাধীনতা অর্জন করা যতো কঠিন তার চাইতে বহুগুন কঠিন স্বাধীনতা রক্ষা করা। বঙ্গবন্ধুর এই কথাটি যে বেদবাক্য স্বরূপ হয়ে যাবে তখন হয়তো কেউ তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পরে বঙ্গবন্ধুর ওই কথার সত্যতা বাঙালী জাতি নিজেদের চোখেই দেখতে পায়। যখন বাঙালি দেখল পঁচাত্তরের পরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সব কিছু বাতিল ও ধ্বংস করে দিচ্ছিলেন তখন নিজেদের চোখেই তা দেখার পরেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এটাও কি সম্ভব? শুধু তাই নয়, নিষিদ্ধ স্বাধীনতাবিরোধী জামায়তসহ সকল পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলকে মুক্ত করে পুনরায় তাদের বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন জিয়াউর রহমান।

বাহাত্তরের সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাতিল, জামায়াত, মুসলিম লীগের পুনরুত্থান এবং সেই পথ ধরে তাদের সকল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শুধু নামেই বাংলাদেশ থাকল, কার্যত এবং মতাদর্শগতভাবে এখানে আরেকটি পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে গেল। বঙ্গবন্ধুর সতর্কবাণী সত্ত্বেও আমরা স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারলাম না। জাতির পিতা ও একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া বিএনপির তো কোনো বিরোধ থাকার কথা নয়। কিন্তু জন্ম থেকে বিএনপি সেটাই করে আসছে এবং এখনো সেখানেই অটল আছে। সুতরাং জামায়াত থেকে বিএনপির পার্থক্য করবেন কী করে? তাই ১৯৭৫ সালে হাতছাড়া হওয়া মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সম্বলিত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা একটা যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি।

গত প্রায় দশ বছর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতের সকল সূচকে বাংলাদেশ যেমন অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে, তেমনি রাজনৈতিকাবেও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও দর্শনের রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে ফিরে আনার পথে অগ্রগতি অনেক। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনে যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি জয়ী হতে না পারে তাহলে আবার আমাদের পেছনের যাত্রা শুরু হবে এবং সংগ্রামের একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও পঁচাত্তরের হারানো স্বাধীনতাকে অদূর ভবিষ্যতে আর উদ্ধার করা সম্ভব হবে না।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী এবং তার পথ ধরে একাত্তরের যুদ্ধে বিজয়ী না হলে যেমন আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না, তেমনি ২০১৮ সালের নির্বাচনটিও একই গুরুত্ব বহন করে যে কথা উপরে উল্লেখ করলাম। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ বিএনপি-জামায়াত আজ সঙ্গত কারণেই পর্যুদস্ত ও বিপর্যস্ত। সুতরাং তাদের অনুসৃত পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি বাংলাদেশে আর চলবে না সেটা প্রমাণ করার সর্বোত্তম সময় এখন বাংলাদেশের মানুষের সামনে উপস্থিত। তাই এখন এটা স্পষ্ট যে আসন্ন নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিজয়ী হলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ধারাতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী জামায়াত-বিএনপির রাজনীতি বাংলাদেশে আর টিকবে না। তখন রাজনীততে নতুন মেরুকরণ এবং সমীকরণ হবে। তার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে আরেকটি শক্তিশালী রাজনৈতিক পক্ষের আবির্ভাব হবে। তখন মানুষের বহুল প্রত্যাশিত সুস্থ ধারার রাজনীতি ফির আসবে। সরকারি দল, বিরোধী দল সবাই হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। এই বিজয় অর্জনের পথে আপতত দু’টি চ্যালেঞ্জ আমাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান।

জামায়াত-বিএনপির যে ভোটব্যাঙ্ক আছে তা সকলের জানা। আমি এটাকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছি না। প্রত্যেকট দলের সুনির্দিষ্ট সমর্থক গোষ্ঠীর বাইরে বড় অংকের একটা সুইং বা দোদুল্যমান ভোটার আছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষ-বিপক্ষের তাৎপর্য, ফল ও পরিণতিগুলো তাদের উপলব্ধিতে আসা এবং আনাটাই হবে প্রথম চ্যালেঞ্জ। আমার বিশ্বাস এই দোদুল্যমান গ্রুপের ভোটারগণ ২০০১-২০০৬ মেয়াদের জামায়াত-বিএনপি সরকার এবং বিগত দশ বছর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পারফরমেন্স ও বৃহৎ সব অর্জনের একটা তুলনামূলক বিশ্বেষণ করলেই সঠিক চিত্রটি পাবেন। তাতে নি:সন্দেহে আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্কোর হবে অনেক বেশিই হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে এটা স্থানীয় সরকারের নিবার্চন নয়, এটা জাতীয় নির্বাচন। এখানে ব্যক্তির চাইতে দলের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। একটি সংসদীয় আসনে জয়-পরাজয়ের ব্যবধানে যেমন বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে, তেমনি বিপরীতে দেশকে নিয়ে যেতে পারে আবার সেই অন্ধকারের দিকে যে অন্ধকারের স্বরূপ আমরা বিগত দিনে দেখেছি। দেশ ও রাষ্ট্র সঠিক রাজনীতিতে ফিরে এলে ব্যক্তি সে যেই হোক না কেন, তাকেও সরল-সোজা পথে ফির আসতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ড. কামাল হোসেন, আ.স.ম আবদুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, তারা সকলেই এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের মানুষ ছিলেন। তারা আজ নিজেদের সমস্ত স্বকীয়তা, নিজস্বতা, আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা সব বিসর্জন দয়ে ঐক্যফ্রন্ট নামে একটা ধুম্রজাল সৃষ্টি করে জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে একাকার হয়ে ধানের শীষ নিয়ে মাঠে নেমেছেন। জামায়াত ও ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করছেন।

সুহৃদয় পাঠকগণ, একবার ভেবে দেখুন তাহলে দাঁড়ালটা কি? তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন এই বলে যে, যেহেতু আমরা এদের সঙ্গে আছি তাই জামায়াত-বিএনপিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। তারা জামায়াত-বিএনপিকে মু্ক্তিযুদ্ধের সনদ দিচ্ছেন। পথভ্রষ্টতা ও পদস্খলনের একটা সীমা থাকে। দেখুন, ঐক্যফ্রন্টের নামে কতবড় একটা জগাখিচুড়ি তারা তৈরি করেছেন!

নির্বাচনের পর মানুষ কাকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান সেই বিবেচনাটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সবচাইতে বড় বা ভাইটাল ফ্যাক্টর। কারণ দেশের নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা বিগত দিনে দেখেছি সব সংকটের শেষ ভরসা হন প্রধানমন্ত্রী। অথচ বিএনপি-এক্যফ্রন্ট বলতে পারছে না তারা জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। সুতরাং, এ রকম অস্পষ্টতা ও জগাখিচুরি, দ্বিচারিতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতির কবল থেকে স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রকে মুক্ত করার জন্য ২০১৮ সালের নির্বাচনটি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের চাইতে কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.): কলামিস্ট এবং ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর