জাতীয় পার্টি মানেই বাণিজ্য, বিনোদন আর বিভ্রান্তি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-28 14:07:51

জাতীয় পার্টি যে সত্যি সত্যি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাত্রা পার্টির ভূমিকায় নেমেছে তা প্রমাণিত হলো আরেকবার। এরশাদ আবারও প্রমাণ করলেন, তিনি নিছক একজন রাজনৈতিক ভাড়। এরশাদ আছেন বলেই, রাজনীতিতে এখনও বিনোদন আছে। মাত্র ৫ দিন আগে জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল রুহুল আমিন হাওলাদারকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মনোনয়ন বাণিজ্যের। অবশ্য মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল দলের চেয়ারম্যান এরশাদের বিরুদ্ধেও। মনোনয়নের মূল সময়টা এরশাদ পালিয়ে ছিলেন সিএমএইচে। আর মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ থেকে নিজে বাঁচতে এরশাদ বলির পাঠা বানান রুহুল আমিন হাওলাদারকে। তবে আমার ধারণা হাওলাদারের অপসারণটা আপসেই হয়েছিল। যাতে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা কাউকেই ধরতে না পারে। এরশাদকে ধরলে বলতেন, মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণেই তো রুহুল আমিন হাওলাদারকে বের করে দিয়েছি। আর হাওলাদারকে ধরলে তিনি বলতে পারেন, আমি তো কিছু জানি না। সব জানেন চেয়ারম্যান। আমি তো এখন দলের কেউ নই। দুই জনের এই টানা হ্যাচড়ায় বঞ্চিতই থেতে যেতেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।

তবে শেষ পর্যন্ত মনে হয় আপস হয়েছে। পদ হারানোর ৫ দিনের মধ্যে রুহুল আমিন হাওলাদার আরো বেশি ক্ষমতা নিয়ে ফিরে এসেছেন। তার নতুন পদের নাম বিশেষ সহকারী। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে তিনি সার্বিক সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করবেন। পদের নাম যাই হোক, জাতীয় পার্টিতে রুহুল আমিন হাওলাদারের পদমর্যাদা হবে চেয়ারম্যানের পরেই, দ্বিতীয় স্থানে। ৫ দিন আগে যাকে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগে অপসারণ করা হলো, যার বিরুদ্ধে তদন্তের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন নতুন মহাসচিব; সেই তাকেই কোন মুখে দলের সেকেন্ড ম্যান বানানো সম্ভব? আচ্ছা রুহুল আমিন হাওলাদার যদি পার্টির সেকেন্ড ম্যান হন, তাহলে পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের পদমর্যাদা কী? পার্টির আরেক কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বা নতুন মহাসচিবের পদমর্যাদা কী? এরা সবাই কি রুহুল আমিন হাওলাদারের পরে? জাতীয় পার্টি নিয়ে এমন হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর দেওয়ার কেউ নেই।

জাতীয় পার্টি আসলে এরশাদের 'যেমন ইচ্ছা লেখার কবিতার খাতা'। এরশাদের যা ইচ্ছা, তাই করেন। এখানে কোনো নিয়ম, কোনো গঠনতন্ত্র, গণতন্ত্র কিচ্ছু নেই। কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য এখন এরশাদকে পাওয়াই দায়। নির্বাচন এলেই তিনি রহস্যজনক আচরণ করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের রহস্যজনক অসুস্থতার কথা নিশ্চয়ই আপনারা ভুলে যাননি। তখন নাকি তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিএমএইচে নেয়া হয়েছিল। তবে এবার বোধহয় তিনি নিজেই পালানোর জন্য সিএমএইচকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি কখন বাসায় থাকেন, কখন সিএমএইচে; সেটাই জানাই প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। অন্তত মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দরকারের সময় তাকে পাননি। এরশাদ নাকি ভয় পেলে বা একা থাকলে সিএমএইচে ভর্তি হন। মনোনয়নের ঝামেলা মিটে যাওয়ার পর এরশাদ উকি-ঝুঁকি মারা শুরু করেন।

জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছেন, মনোনয়ন বাণিজ্যের যে অভিযোগ এবং যে বিস্তার; তাতে সামাল দেয়া যাবে না। তাই তারা রীতিমত মনোনয়নের বাধ খুলে দিয়েছে। মনোনয়ন বিলি করেছে মুড়ি মুড়কির মত।

এরশাদ শুরু থেকে বলছিলেন, এবার তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ৩০০ আসনেই নির্বাচন করবেন। পরে জানালেন, মহাজোটের সাথেই নির্বাচন করবেন। মহাজোটের সাথে আসনের দর কষাকষি শুরু করেন ১০০ আসন থেকে। সেটা ৮০, ৭০, ৫০ হয়ে ৪০ আসনে এসে ঠেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা ২৯ আসনে নেমে আসে। তবে তাও টেকেনি। জাতীয় পার্টি আসলে পেয়েছে ২৬টি আসন।

১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের দিনেও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙার বিভ্রান্তিই কাটেনি। এমনকি তিনি জানান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও নাকি জানেন না, জাপা কয়টি আসন পাচ্ছে মহাজোট থেকে। রাঙা জানান, আগে শুনেছি ৫০, পরে ৫৪, ৩৪, ৩৬, ৩০ হয়ে এখন শুনছি ২৯ আসন। কিন্তু জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব অন্তত ২০০ আসনে মনোনয়ন বাণিজ্য করেছে। তাহলে বাকিদের কীভাবে বোঝাবে। তাই জাতীয় পার্টি খাজাবাবার দরবার হয়েছে। তবে বিভ্রান্তি এখানেও। ৯ ডিসেম্বর বনানীর কার্যালয়ে টানানো হয় মোট ১৬১ জনের তালিকা। নির্বাচন কমিশনে তালিকা পাঠায় ১৭৪ জনের। পরদিন আরো ১৫ জনের নাম যুক্ত করে পাঠানো হয় মোট ১৮৯ জনের তালিকা। তবে এই তালিকা নিয়েও একেক নেতা একেক কথা বলছিলেন। তার মানে ১৮৯ জন লাঙ্গল নিয়ে লড়বে। এরমধ্যে ২৬ জন লড়বেন মহাজোটের হয়ে। বাকি আসনগুলো থাকবে ওপেন। আসলে কাউকে না করার উপায় ছিল না জাতীয় পার্টির।

এরশাদের যা বয়স, তাতে অসুস্থ তিনি হতেই পারেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে আগে বারবার অসুস্থ হওয়াটা যে রাজনৈতিক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ আত্মহত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন। এবার হুট করে একদিন কার্যালয়ে এসে জানিয়ে গেলেন, তাকে বিদেশে যেতে দেয়া হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত উদার হাতে মনোনয়ন বিলিয়ে তিনি সিঙ্গাপুরে উড়ে গেলেন। প্রতীয় নিয়ে সবাই যখন নির্বাচনী প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তখন তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রধান উড়ে গেলেন সিঙ্গাপুরে। হাস্যকর রাজনীতি। জাতীয় পার্টি অফিসে যারা যান, তারা প্রতিদিন প্রচুর বিনোদন নিয়ে আসেন। প্রকাশ্যে নেতাদের গালাগাল তো আছেই, নেতারাও একেকজন একেক কথা বলেন। ১০ ডিসেম্বর মনোনয়ন তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তিকর নানা তথ্য দিতে গিয়ে হাসতে হাসতে মসিউর রহমান রাঙা বলেন, আমি আর বেশি কথা বলবো না। তাহলে মানুষ বলবে, আমিও এরশাদ সাহেবের মত সকাল-বিকাল কথা পাল্টাই। হা হা হা। রাঙা তার চেয়ারম্যানকে চিনতে পেরেছেন সঠিকভাবে।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণআন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের সময় কেউ ভাবেননি এই স্বৈরাচার আবার রাজনীতি করবে, ক্ষমতার সিড়ি হবে। কিন্তু এরশাদ কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপির সাথে জোট বেধে নিজেকে জায়েজ করে নিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাঁধে ভর করে স্বৈরাচারের পুনর্বাসিত হওয়া আমাকে বেদনার্ত করে। আমাদের যৌবন যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কাটিয়েছি, তাকে আবার মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হতে দেখলে লজ্জা লাগে। কিন্তু একসময়কার প্রবল প্রতাপের স্বৈরাচার এখন রাজনৈতিক ভাড়ের চেয়ে বেশি কিছু নন।

মনে আছে, ২০১৪ সালে নির্বাচন শেষে বঙ্গভবন শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছিল। নির্বাচনে অনিচ্ছুক এরশাদ সিএমএইচে থেকে নির্বাচিত হয়ে সেখান থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে যান। এরশাদ বঙ্গভবনে ঢোকার পর উপস্থিত সবাই যেভাবে স্বতস্ফুর্তভাবে বিদ্রুপের হাসি হেসেছিলেন, তা আমাকে পুলকিত করে।

একসময়কার বাঘ এরশাদ এখন পোষমানা বিড়াল। এরশাদের যেটুকু জনপ্রিয়তা ছিল, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চাওয়ার কারণে তা দ্রুত কমছে। আশা করি একদিন তা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির মত দল আর এরশাদের মত নেতার উপস্থিতি রাজনীতিবিদদের জন্যই লজ্জার।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর