মংডুতে মডেল ভিলেজ: গরু মেরে জুতা দান

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-30 11:32:13

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রেহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চূড়ান্ত তারিখ নির্ধারণ করেছিল ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর। সেটা কার্যকরী হয়নি। এরপর চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালে ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের আন্তরিকতায় ঘাটতি অবলোকন ও রাখাইন রাজ্যের সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ে রোহিঙ্গাদের আপত্তির কারণে প্রত্যাবাসন শুরু করা হয়ে উঠেনি। একটি সুষ্ঠু পরিবেশ ও আস্থার অভাব ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর বিষয়টি এক সময় আন্তর্জাতিক আদালতের ফাইলের প্রক্রিয়ায় গতি আনতে তাড়া দেয়। এত নড়েচড়ে উঠে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সব উইং। শুরু হয়ে যায় রাখাইনে উভয় দেশের প্রতিনিধি পাঠানোর মাধ্যমে মডেল ভিলেজের সার্বিক অবস্থা পরিদর্শনের কাজ।

প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ পরিস্থিতি আছে কি-না তা দেখার জন্য গত ৫ মে ২০২৩ নাফ নদীর ওপাড়ে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ঘুরে এসেছে বাংলাদেশের ২৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল। রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলে ছিলেন ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) যিনি একজন যুগ্মসচিব, সঙ্গে ছিলেন টেকনাফের লেদা, শালবাগান ও জাদিমুরা আশ্রয়শিবিরের ২০ জন শরণার্থী। তাদের মধ্যে ৩ জন নারী সদস্যও ছিলেন। এই প্রতিনিধি দলকে সহায়তা করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার আরো সাতজন।

প্রতিনিধি দলটি দিনভর মংডুতে ছিলেন। তাঁদেরকে রাখাইনের ট্রানজিট কেন্দ্র এবং মংডু শহরও ঘুরে দেখানো হয়েছে। মংডু শহরে ৮০ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বসতি। শহর ছাড়াও তাঁরা কমপক্ষে ১৫টি গ্রাম ঘুরে দেখেছেন যেখানে মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় চলাফেরা করছে, রোহিঙ্গারা ব্যবসা বাণিজ্য করছে।

তবে প্রতিনিধিদলটির রেহিঙ্গা সদস্যরা টেকনাফে ফিরে অভিযোগ করেছেন, রাখাইনে প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ ও পরিস্থিতি কোনটাই নেই। রোহিঙ্গারা তাদের যে পৈত্রিক ভিটা থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন সেটা একনজর দেখার জন্য তাদের মন-প্রাণ আকুল হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাঁরা তাদের নিজ জন্মভিটার কোন নিদর্শন খুঁজে পাননি। তাদের ভিটায় গড়ে তোলা হয়েছে নতুন সেনা ব্যারাক, পুলিশ ফাঁড়ি, সীমান্ত চৌকি ইত্যাদি। রাস্তার দুপাশে আগে যেসব সুন্দর গ্রাম ছিল এখন সেসবের কোন চিহ্ন নাই। প্রতিনিধিদলের সদস্য মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতি কোনটাই নেই। বাংলাদেশে থেকে ফিরে আবার আশ্রয় শিবিরে কেন রোহিঙ্গারা থাকবে?’

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য যেখানে ‘মডেল ভিলেজ’ নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো আরসিসি খুঁটির উপর। মংডু শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে সেসব ভিলেজ নির্মাণ করা হয়েছে। মংডুর জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন রাখাইনে ফেরার পর রোহিঙ্গাদেরকে প্রথমে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট (এনভিসি) দেয়া হবে। এরপর যাচাই করে পর্যাক্রমে এনআইডি দেয়া হবে। তাদের প্রত্যেককে কৃষি আবাদ করার জন্য এক একর করে জমি প্রদান করা হবে।

কিন্তু রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্য আবু সুফিয়ান ও গোলবাহার বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিকত্ব প্রদানের পাশাপাশি নিজ জন্মভিটায় পুনর্বাসন করতে হবে। মডেল ভিলেজের মতো আশ্রয়শিবিরে কোন রোহিঙ্গা থাকতে রাজি হবে না।’ পরিদর্শনে গিয়ে নিজের বাড়িঘর দেখতে না পেরে মোটেও শান্তি লাগেনি বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন তারা। টেকনাফে ফিরে এসে রোহিঙ্গারা সাংবাদিকের নিকট তাদের নিজের জন্মস্থানের চিহ্ন দেখতে না পওয়ায় চরম অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে মাত্র এক হাজার ৮৭ জন রোহিঙ্গার জন্য মডেল ভিলেজ নির্মাণ করেছেন বলে জানা গেছে। এই নির্মাণে আর্থিক সহায়তা দান করেছে চীন, জাপান ও ভারত। পরে আরো কিছু দেশ এই প্রকল্পে সহায়তা করতে পারে।

তবে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হবার পর এই ‘মডেল ভিলেজ’ প্রকল্প কেন মাথায় আনা হয়েছে তা অনেকের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। কারণ, ২০১৭ সাল থেকে দশ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে। গত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে তাদের সংখ্যা বেড়ে সাড়ে বার লক্ষ পেরিয়ে গেছে। এতদিন পর এতগুলো উদ্বাস্তু মানুষকে ফিরিয়ে নেবার যে আগ্রহ মিয়ানমার দেখাচ্ছে সেটা এই ধীরগতিতে মডেল ভিলেজ বানিয়ে বাস্তবায়ন করতে হলে আগামী কয়েক যুগ লাগতে পারে। সেটা নির্ভর করবে দাতা দেশগুলোর বদান্যতার অগ্রগতির উপর। কারণ, মিয়ানমার নিজ ইচ্ছায় ও অর্থায়নে মডেল ভিলেজ তৈরি করে প্রত্যাবাসন করাতে ততটা আগ্রহী নয় বলে মনে করা হচ্ছে।

রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের বসতি। রোহিঙ্গারা সেখানে বসবাস করতে বেশি ভালবাসেন। কিন্তু মংডুতে বড় বড় সরকারি স্থাপনা তৈরি করে রোহিঙ্গা বসতি এলাকা সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। বার লক্ষ শরণার্থীকে ফেরত নিয়ে মডেল ভিলেজ তৈরি করে জায়গা দিতে হলে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সমতল জমি প্রয়োজন। প্রতিটি পরিবারকে এক একর আবাদী জমি বন্টন করে দিতে হলে বার লক্ষ একর আবাদী জমির প্রয়োজন। সেগুলো তাদের পরিকল্পনায় অর্ন্তভুক্ত করে মডেল ভিলেজ তৈরি করা হচ্ছে কি-না তা স্পষ্ট নয়। কতটি বসতি কোন ডোনার সংস্থা বা দেশের অর্থায়নে কতদিনে মডেল গ্রামে রুপান্তরিত হবে তা নিয়ে অনেকে হিসেব মেলাতে দুশ্চিন্তা করছেন।

অনেকে ভাবছেন মিয়নমারের বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর এত বিশাল প্রকল্পের বস্তবায়নে ধীরগতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রক্রিয়াকে যে কোন সময় থমকে দিতে পারে। মিয়ানমার হঠাৎ আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে যে নমনীয়তা প্রদর্শন শুরু করেছে সেটার স্থায়ীত্ব কতটুকু হবে তা এখনই বোঝা মুস্কিল।

যেমন, আমাদের দেশে ভূমিহীনদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্পে শুধু ঘর দেয়া হচ্ছে। তারা ঘর পেয়ে আপাতত: খুশি। কিন্তু গ্রামীণ জীবনে হাঁস, মুর্গী, গাভী, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদি পালন করে বহু ভূমিহীন মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তাই আবাসনের ঘর পেয়ে সেখানে ঘুমানোর পর তাদেরকে গবাদি পশু পালনের জন্য দূর-দূরান্তে খোলা খাস জায়গা, নদী তীর, চর ইতাদিতে যেতে হয়। যারা ক্ষুদ্র আবাসনের মধ্যে বদ্ধ জায়গায় হাঁস, মুর্গী, গাভী, ছাগল পালন করতে শুরু করেছেন তাদের প্রতিবিশীদের মধ্যে এসব নিয়ে ঝগড়াঝাটি করে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, মানুষ বসতে দিলে শুতে চায়। খেতে দিলে জীবনের প্রয়োজনে একটু আরাম করে শুয়ে ঘুমাতে চায়। এটাই সব মানুষের চাওয়া-পাওয়ার স্বাভাবিক স্বভাব। মংডুর মডেল ভিলেজ নিয়ে একই ধরণের সমস্যার উদ্রেক হবার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া যেসব রোহিঙ্গার পৈত্রিক ভিটায় বাড়ি, জমি, পুকুর, বাগান-বিলাস ইত্যাদি ছিল তারা কখনই মডেল ভিলেজের খুপরি ঘরে বসতি গড়তে আগ্রহী হতে চাইবে না। তাদের জীবনের স্বাধীনতা নিজস্ব অতীত ঐতিহ্য ও বড় ভাবনার নিপতিত হয়ে আছে। সেটাকে মডেল ভিলেজের বদ্ধ পরিবেশে বন্দী করে ফেলা খুব সহজ কাজ নয়।

রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস গুঁড়িয়ে দেবার ফলে মনের মধ্যে যে ক্ষোভ সঞ্চিত হচ্ছে তা যে কোন সময় ফুঁসে উঠতে পারে। যেটা তাদেরকে সামরিক জান্তার মুখোমখি দাঁড় করিয়ে ভবিষ্যতে আবারো নৃশংস গণহত্যার মুখে ঠেলে দিতে পারে। শুরুতেই তাদেরকে এনআইডি না দেয়ায় নিজ দেশে পরবাসী হবার হতাশাকে উস্কে দিতে পারে।

নিজের ভিটায় নিজের পৈত্রিক নিবাস ধ্বংস করে মডেল ভিলেজের মাধ্যমে আবারো ক্যাম্পের জীবনে ফিরে যাওয়াকে তারা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারছে না বলে প্রতিনিধি দলের পরিদর্শণ থেকে ফিরে অসন্তুষ্টির প্রকাশের মাধ্যমে সেটা হয়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এটাকে তারা নিজেরে আত্মমর্যাদার পরিপন্থী হিসেবে মনে করছেন। তাই এটাকে তারা ভালভাবে গ্রহণ না করে ‘গরু মেরে জুতা দান’ মনে করছেন। নিজ দেশে ফিরে আবারো পরবসীর মতো বেঁচে থাকতে আগ্রহী নন তারা।

এছাড়া মংডু এলাকার বাইরে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা কম বা না থাকায় মডেল ভিলেজ প্রকল্পে অবশ্যই ধরিগতি বা অসাড়তা তৈরি হয়ে যেতে পারে যে কোন সময়। এজন্য মিয়ানমারের উচিত শুধু মডেল ভিলেজ প্রকল্পের উপর জোর না দিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ বা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে শিক্ষা, কর্মদক্ষতা ও পারিবিারিক ঐতিহ্যকে যাচাই করে ক্যাটাগরি করা উচিত। এর মাধ্যমে নিজ নিজ পৈত্রিক ভিটায় বা আবাসে অতি দ্রুত ফেরার নিশ্চয়তা দেবার ব্যবস্থা করা উচিত। আর যাদের রাখাইনে তেমন কিছু বিত্ত-বৈভব ছিল না শুধু তাদেরকে আমাদের দেশের আবাসন প্রকল্পের মতো মডেল ভিলেজের ঘর বরাদ্দ দিলে তাদের অসস্তুষ্টি কম হবে। এভাবে সকল রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একটি মানসিক শান্তির আবেশ জাগিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে জোরদার করতে পারলে বিষয়টির ক্ষোভ নিষ্পত্তি সহজ হবে এবং বার লক্ষ উদ্বাস্তুকে দ্রুত ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা সহজ হবে বলে মনে করা যায়।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর