বিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধ, অভিভাবকদের চাহিদা এবং সামাজিক মর্যাদা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-25 14:41:27

ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস, ফসল তোলার মাস, শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার মাস। সাথে সাথে নতুন ক্লাসে ওঠা ও নতুন বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ারও মাস। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে আর তার সাথে শুরু হয়েছে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা, তাদের সন্তানরা তথাকথিত নামকরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে তো? ’সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির নীতিমালা-২০১৮ প্রণয়ন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীতিমালা ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে সব মহনগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা সদরেও কেন্দ্রীয় অনলাইন পদ্ধতিতে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগরীতে সরকারি বিদ্যালয়ে ওই এলাকার ৪০ শতাংশ কোটা রেখে অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে মোট আসনের ১০ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা সন্তানদের ছেলে-মেয়ের জন্য ৫শতাংশ, প্রতিবন্ধীদের জন্য ২ শতাংশ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তান এবং সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য আরও ২শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে।

বিদ্যালয়গুলোর অবস্থান, শিক্ষার্থীদের সুবিধা, অসুবিধা বিবেচনা করে পরীক্ষা কমিটি বিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন ক্লাস্টারে বিভক্ত করতে পারবে। আবেদন ফরমে পছন্দক্রম উল্লেখ করে দেবে। ভর্তির ফরম বিদ্যালয়ের অফিসে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ডিসি অফিস, বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। এবার ভর্তির আবেদন ফরমের মূল্য ধরা হয়েছে ১৭০ টাকা। সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ফি থেকে বেশি হবে না। শিক্ষা অধিদপ্তর ১৭, ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর তিনটি ভাগে ভাগ করে রাজধানীর ৪১টি স্কুলের ভর্তি পরীক্ষা নির্ধারণ করেছে। আর প্রথম শ্রেণিতে লটারি অনুষ্ঠিত হবে ২০ ডিসেম্বর।

এবার ঢাকার ৩৮টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১২ হাজার ৩৬৬টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ১ হাজার ৯৬০টি আসন রয়েছে। এর বাইরে আরও তিনটি বিদ্যালয়ে এবার প্রথমবার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৮৪৯টি, তৃতীয় শ্রেণিতে ২ হাজার ১২৬টি, চতুর্থ শ্রেণিতে ৮২২টি, পঞ্চম শ্রেণিতে ৮৪৯টি, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৩ হাজার ৫৫৭টি, সপ্তম শ্রেণিতে ৭৩৮টি, অষ্টম শ্রেণিতে ৯৯৭টি এবং নবম শ্রেণিতে ৪৬৮টি আসন রয়েছে। এবার নবনির্মিত হাজী এমএ গফুর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সবুজবাগ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং শহীদ মনু মিঞা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থী ভর্তির লক্ষ্যে হেল্প ডেস্ক খোলা হচ্ছে।

এ বছরও রাজধানীর সরকারি বিদ্যালয়গুলো তিন গ্রুপে ভাগ করে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ৪১টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ’ক’ও ’খ’গ্রুপে ১৪টি করে এবং ’গ’গ্রুপে ১৩টি হাইস্কুল আছে। এবার রাজধানীর মোট ১৭ হাইস্কুলের প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। বাকিগুলোর কোনোটি দ্বিতীয়, আবার কোনোটি তৃতীয় বা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করবে।

সরকারি হাইস্কুলগুলোর গড় মান বেসরকারি হাইস্কুলগুলোর চেয়ে ভাল হওয়ায় অভিভাবকদের একটি বড় অংশ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের ভর্তি করাতে চান। তাছাড়া সরকারি স্কুলে টিউশনি ফিও অনেক কম, শিক্ষার্থীদের টিফিনের ব্যবস্থা থাকে। ধারে কাছের শিক্ষার্থীদের জন্য ৪০ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে দেওয়ায় অন্তত ৪০ শতাংশ অভিভাবক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে রেহাই পাবেন।

শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনা-নেওয়ার কারণে নগরজুড়ে যানজট সৃষ্টির আশঙ্কা কিছুট হলেও কমেছে। এই চমৎকার উদ্যোগ এবং সিদ্ধান্তটির জন্য শিক্ষা অধিদপ্তর ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আমরা এমন অনেক কাজ করতে পারি যেুগলোর জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না, শুধু উদ্যোগ নিলেই হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হতে পারে। কিন্তু সেটিও আমরা অনেক ক্ষেত্রে করতে যাই না।

ঢাকার শীর্ষ বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ উপরের দিকে। এই বিদ্যালয়টিতে প্রতি বছরই ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তবে এবার আরো গুরুতর অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে সরকারের তদন্ত কমিটি। এক অভিভাবক দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ফেব্রুয়ারি -২০১৮ মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়য়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। শোনা যায় যে, এই প্রতিষ্ঠানটির বাংলা ও ইংলিশ ভার্সনে জনপ্রতি তিন লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়ে একশত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। অর্থাৎ তিন কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। উত্তরপত্রে ঘষামাজা করে নম্বর দিয়ে তাদের পাস করানো হয় অর্থের বিনিময়ে। ঢাকার আরও দু একটি নামকরা বিদ্যালয় যেমন রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজ, সাউথপয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির চাপ থাকে প্রচুর অথচ ভর্তিতে জালিয়াতি বা দুর্নীতির কথা খুব একটা শোনা যায়না। এজন্য প্রতিষ্ঠান দুটোর কর্তৃপক্ষ ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। তবে, ভিকারুন্নেছার দুর্নীতি নাকি আলাদ ধরনের।

অভিভাবকদের অনেকেই মনে করেন যে, তার মেয়ে যদি ভিকারুন্নেছায় ভর্তি হতে না পারে তাহলে বোধ হয় জীবনের অনেক কিছুই মিস হলো। ভিকারুন্নেছায় মেয়ে পড়ানো মানে একটা সামাজিক মর্যাদারও ব্যাপার। রাজউক কলেজে বা আইডিয়াল স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারা মানে জীবনের অনেক কিছু পাওয়া হয়ে গেল। হাঁ, একটি বড় প্রতিষ্ঠানের পড়ানোর মানে ধরেই নেওয়া হয় যে অনেক উন্নত, অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষক সেখানে আছেন, শিক্ষার্থী অনেক কিছু জানতে পারে সেখানে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানে কী হয়?

এসব নামকরা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাছাই করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। তারপর শুরু হয় তাদের ওপর পড়াশুনার অমানবিক চাপ। ক্লাস পরীক্ষা, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, মাসিক পরীক্ষা, টার্মশেষ পরীক্ষা ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জীবন বিষিয়ে তোলা হয়। শিক্ষার্থীদের জীবনের অফুরন্ত আনন্দ চাপা পড়ে যায় এসব পরীক্ষার চাপে। শুধু কি পরীক্ষা? কোনো ক্লাস মিস করা যাবে না। একদিন ক্লাস মিস করলে শারীরিক শাস্তি ও অর্থনৈতিক দণ্ড দুটোই শিক্ষার্থীদের ভোগ করতে হয়। যেখানে প্রয়োজন ছিল শিক্ষার্থী দৌডে ক্লাসে আসবে, সবকিছু ফেলে স্কুলে ও ক্লাসে আসবে। তার পরিবর্তে যেটি হয় তা হচ্ছে জোর করে , শাস্তি দিয়ে, ভীতি প্রদর্শন করে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে রাখা হয়। আর বিভিন্ন পরীক্ষা, প্রাইভেট পড়িয়ে, কোচিংএ পড়িয়ে পাবলিক পরীক্ষার গৎবাঁধা প্রশ্ন অনুযায়ী বছরের পর বছর তাদের প্রস্তুতি নেওয়ানো হয়, ফলে পাবলিক পরীক্ষায় তারা ভাল করে, জিপিএ-৫ পায় আর সবাই বিদ্যালয়গুলোকে বাহবা দিতে থাকে। বিদ্যালয়গুলো তখন আরও দ্বিগুণ উৎসাহে শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেয় পরীক্ষা, ক্লাস আর প্রাইভেট পড়া।

সকল ধরনের অভিভাবকগণও ছুটতে থাকেন এর পেছনে আর বিদ্যালয়গুলো শুধু ক্রেডিট নিতে থাকে। বিষয়টি তলিয়ে দেখে না কেউ। অথচ এইসব ছেলেমেয়েরা প্রচণ্ড রকমের সৃজনশীল। কিন্তু বিদ্যালয়গুলোর ট্রাডিশনাল চাপে তাদের সব সৃজনশীলতা চাপা পড়ে যায়, প্রকাশের কোনো সুযোগ তারা পায় না।

আর একটি বড় সমস্যা হচেছ এসব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সাধারণত কোনো প্রশিক্ষণ গ্রহন করে না। কারণ সবাই মনে করে তারা তো এমনিতেই অনেক কিছু জানেন, তাদের আবার প্রশিক্ষণ কি? অথচ আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান, চঞ্চল শিক্ষার্থীদের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হবে, প্যারেন্টিং স্কীল, কাউন্সেলিং এগুলোর উপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এসব বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ চান না ক্লাসবাদ দিয়ে শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুক। হয়তো যে প্রশিক্ষণে কিছু না শিখেও একটি সার্টিফিকেট পাওয়া যায় কিংবা সরকারি চাপ থাকলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ নামমাত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এটি নামকরা বিদ্যালয়গুলোর আর একটি নেগেটিভ দিক।

নামের আশায় দূর দুরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। অথচ এসব বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য আলাদা কোনো বাস নেই। নির্ভর করতে হয় পাবলিক বাস কিংবা রিক্সার উপর। দুটোই অনিশ্চিত, দুটোই সময় সাপেক্ষ এবং অনিয়মে ভরা। এখানেও শিক্ষার্থীদের দুর্গতি। কারণ সব সময় তারা সঠিক সময়ে ক্লাসে পৌঁছাতে পারে না অথবা সঠিক সময়ের অনেক আগে বাসা থেকে রওয়ানা দিতে হয়। ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না, নাস্তা খেতে পারে না। আর যাদের গাড়ী আছে তারা গাড়ীতে এসে বিদ্যালয়ের চারপাশে যানজট সৃষ্টি করে আর শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের বৈষম্য প্রদর্শন করে। একদল হেঁটে, পাবলিক বাসে বা রিকসায় বিদ্যালয়ে আসছে আর একদল ড্রাইভার ও কাজের লোক ও মাসহ গাড়ীতে বিদ্যালয়ে আসছে। এটি শিশুমনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় যার উত্তর সমাজ দিতে পারে না। বিষয়টি আমাদের ভেবে দেখতে হবে।

এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে রীতিমতো মাইকিং করা হয়। উদ্দেশ্য কি? প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় না আসা শিশুদের শিক্ষাদানের প্রতিশ্রুতি? অবশই না। ছোট ছোট উদ্যেক্তা শিক্ষা নামের ছোট ছোট বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বানিয়েছেন। সেসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে তারা কাষ্টমার সংগ্রহ করার জন্য মাইকিং করছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে না আছে শিশুদের উপযোগী শ্রেণিকক্ষ, না আছে খেলাধুলার সামগ্রী আর খোলা জায়গার তো প্রশ্নই ওঠে না। কর্তৃপক্ষ এগুলো দেখেও না দেখার ভান করে কেন? বেকার ছেলেমেয়েরা কিংবা পার্টির ছেলেমেয়েরা এগুলো করেছে কিছু একটা করে খাবে তাই। তাই বলে প্রাথমিক শিক্ষাকে আমরা এভাবে ছেড়ে দেব? এখানে যারা পড়াচ্ছেন তাদের নিজেদের পড়াশুনার মান নিয়ে রয়েছে হাজারো প্রশ্ন ও যথেষ্ট সন্দেহ। তারা শিশুদের পড়াশুনার ঊষালগ্নে কী ভুল শিক্ষা দিচ্ছেন তা বোধ করি অভিভাবক, কর্তৃপক্ষ এবং সরকার মোটেই চিন্তা করে দেখছে না।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর