গরুর জ্বর ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ঈদ স্বপ্ন

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 22:07:26

সেদিন তার নিকট থেকে কয়েকটা ফোন এসেছিল। কিন্তু পরীক্ষার কারণে নেটওয়ার্কের জটিলতায় সংযোগ পাওয়া যায়নি। পরের দিন কলব্যাকে জানা গেল উদ্বেগের আসল কারণ। কন্ঠস্বরে তার অনেক জড়তা লক্ষ্য করলাম। তবুও বোঝা গেল বিপদটা তার জন্য অনেক বড়। কান্নাস্বরে বলল, বাবা-ছোট গরুটার আজও ভীষণ জ্বর। খড়, ঘাস কিছুই খায় না, মুখ দিয়ে লালা পড়ে। সমস্ত গায়ে গুটি গুটি চাকা উঠে ফুলে গেছে। কাঁপুনির জন্য ঠিকমতো হাঁটতেও পারে না। শুকিয়ে পাঁজরের শরীরের হাড্ডি বের হয়ে পড়েছে। এখন কি যে করি !

কবিরাজি চিকিৎসা করালাম কিছুই হলো না। শহরের পশু ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি লক্ষণ শুনে বলেছেন লাম্পিং অসুখ না কি জানি হয়েছে। কয়েকটা ইন্জেকশন কিনে দিতে বলেছেন। সেগুলোর অনেক দাম। সেজন্য তোমাকে ফোন করেছি।

সামনে কোরবানির ঈদের জন্য হাটে তোলার কথা ছিল। ঋণের টাকায় কেনা গাইটার একটাই বাছুর। একবছর হয়ে গেল তাই এবার ঈদের হাটে বিক্রি করে ঋণ শোধ করে দিতাম। আর গরু-বাছুর পালবো না বাবা। এগুলা খুব ঝামেলা আর বিপদ।

একটানা কথা শুনে বুঝলাম আজকাল গবাদি পশুর লাম্পিং স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) নিয়ে বেশ লেখালেখি হচ্ছে। আক্রান্ত পশুর ছবিসহ পত্রিকায় ছবি দেখা যাচ্ছে। গরুর শরীরে গোটা উঠে ফুলে যাওয়ায় এটাকে গো-বসন্ত বলা হয়। এটা পশুর জন্য ভয়ংকর পক্স ভাইরাস। এটাকে খুরা রোগের চেয়ে ভয়ংকর হিসেবে ধরা হয়। এই ভাইরাস দ্রুত এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়ে। বসন্তের শুরু এবং বর্ষার শেষে মশা-মাছির অধিক বংশবিস্তার হলে এই ভাইরাস বেশী ছড়ায়। তবে এবছর মে মাসের শেষে সাতক্ষীরা, যশোরে এর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে।

শুধু তাই নয়, দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম ও পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার সর্বত্র এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। মে ৩১ তারিখে কুড়িগ্রাম জেলায় একটি এলাকায় কৃষকদের ১০টি গরু লাম্পিং স্কিন ডিজিজে মারা যাবার সংবাদ বের হয়েছে। কেন্দুয়া উপজেলার পাইকুড়া ইউনিয়নের বৈরাটি গ্রামে এক ব্যক্তির তিন লাখ টাকা মূল্যের ষাঁড় এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। জুন ০২, ২০২৩ সেখানে এক রাতে পাঁচটি গরু মারা গেছে। এই রোগের সরাসরি কোন প্রতিশেধক নাই তাই সাধারণ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

বিপদের কথাটা সেখানেই। কারণ, কোন কঠিন রোগের প্রতিশেধক সহজলভ্য হলে সেটাকে কোন ভয়ংকর বলে বিবেচনা করা হয় না। যেমন কলেরা, বসন্ত, করোনার টিকা আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ এগুলোকে খুব ভয় পেত। এখন আর ততটা ভয় পায় না। স্যালাইন আবিষ্কারের পূর্বে মানুষের জন্য ডায়রীয়া একটি ভয়ংকর অসুখ বলে বিবেচিত হতো। গরুর লাম্পিং স্কিন ডিজিজ প্রায় শত বছর পূর্বের পুরনো রোগ হলেও অদ্যাবধি এর কোন টিকা আবিষ্কৃত হয়নি।

জানা গেছে, গরুর লাম্পিং স্কিন ডিজিজ নামক এই রোগটি ১৯২৯ সালে সর্বপ্রথম আফ্রিকার জাম্বিয়ায় ধরা গড়ে। এরপর ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সব এলাকায় এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে সাধারণত: সঙ্কর জাতের গরু বেশী আক্রান্ত হয়।

আমাদের দেশে কোরবানির ঈদে এক কোটি পঁচিশ লাখ গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর এই চাহিদা অনেকটা বেড়ে যায়। ফলে বাজারে কোরবানির পশুর দাম বৃদ্ধি পায়। আমাদের অর্থনীতিতে কোরবানির পশুর ভূমিকা বড় হয়ে দেখা দেয়ায় অল্প সময়ে পশু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প হাতে নিয়ে লাভবান হবার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এই প্রকল্পে দ্রুত বর্ধনশীল সঙ্কর জাতের বিদেশী গরু বেশী পালন করা হয়। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে ঋণ দেবার নিয়ম চালু হওয়ায় দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা এই লাভের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে।

পাশাপাশি এটাকে বড় লাভের উৎস হিসেবে বিবেচনা করে বিত্তশালী লোকেরা নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছে হাজার হাজার পশুর খামার। সেগুলোতে ছোট ছোট উন্নত সঙ্কর জাতের গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, দুম্বা, উট ইত্যাদি সংগ্রহ করে বড় ও মোটাতাজা করে প্রতিবছর কোরবানি ঈদের আগে হাটে বিক্রির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গ্রাম-শহর সব জায়গায় এই প্রবণতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে লাম্পিং স্কিন ডিজিজ বা গো-বসন্তে আক্রান্ত হবার প্রবণতাও অধিক হচ্ছে।

বিশেষ করে গত তিন বছর থেকে প্রতিবেশী দেশ কর্তৃক স্থল সীমান্ত পথে গরু বিক্রির ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের দেশে নিজস্ব উদ্যোগে পশু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প বেগবান হয়েছে। এতে কৃষক ও অন্যান্য সৌখিন উদ্যোক্তাগণ বেশ লাভবান হয়ে থাকেন। অনেকে এজন্য সারা বছর ধরে কোরবানি ঈদের চাঙ্গা বাজার ধরতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন।

মন একটি অধীর অপেক্ষা নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন আমাদের পরিচিত একজন। তার একটি মাত্র গাভী এবং একটি মাত্র বাছুর। যেটি এবছর কোরবানির ঈদের হাটে বিক্রির জন্য মোটাতাজা করা হচ্ছিল। এর সংগে সেই পরিবারের নানা স্বপ্ন-সাধ জড়িত আছে। কিন্তু হঠাৎ লাম্পিং স্কিন ডিজিজ বাছুরটিকে আক্রান্ত করে ফেলায় দেখা দিয়েছে নানা দুশ্চিন্তা।

বাছুরটির কিছু হলে ওদের পরিবারের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। সাথে যুক্ত হয়ে পড়বে ঋণ শোধ দেয়ার যন্ত্রণা। এরপর পরিবারটির আশা ভরসা ভেঙে চুরমার হয়ে পথে বসে গেলে সামনে কি ভয়াবহ অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে সেটা শুধু তারাই আঁচ করতে পেরে চরম উৎকন্ঠিত হয়ে পড়েছেন তিনি। এই ভয়াবহ অনাগত ভবিষ্যতের কথা তিনি গ্রামের আর কাউকেই শেয়ার করতে না পেরে আমাকে ফোন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলেন। কারণ, গ্রামের ব্যস্ত মানুষেরা আজকাল কেউ কারো বিপদের কথা শুনতে ভালবাসেনা। বরং কেউ অভাবী হয়ে ধনীদের নিকট গিয়ে হাত পাতলে তারা জমিজমা, গহনা, গরু-বাছুর ইত্যাদি উচ্চসুদে বন্দক নিতে বা কিনতে ভালবাসে। আজকাল গ্রামে বিনাসুদে কোন সাহায্য পাওয়া কঠিন। আমাদের পরিবর্তিত গ্রামীণ সমাজের এই দিকটির ঘৃণ্য পুনর্জাগরণ ঘটে চলেছে। যা গ্রাম উন্নয়নের নীতিনির্ধারকসহ অনেকের নিকট অজানা।

তাই একদিকে যেমন গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কর্মনিরাপত্তা নেই, অন্যদিকে তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ছোটখাটো ব্যবসা ও কৃষিপ্রকল্পের ঝুঁকি অনেক। কিন্তু সেজন্য কোন কৃষিবীমা নেই। এর ফলে ঋণের টাকায় একটি গরু কিনে তার অসুখ হলে বা মারা গেলে তাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তারা।
ইতোমধ্যে ২০২৩ আগামী অর্থবছরের জন্য নতুন বাজেট পেশ করা হয়েছে। সেখানে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এই সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দের কিছু অংশ কি একটি বাছুরের লাম্পিং ডিজিজ হওয়া একজন অসহায় প্রান্তিক কৃষকের ঘরে পৌঁছুবে? এই ভাবনা আমাদের অর্থনৈতিক সূচকের মধ্যে কোন প্রভাব ফেলবে না বলে হেসে উড়িয়ে দেবার জন্য অনেকে প্রস্তুত হয়ে আছেন। তাদের অনেকে রথী-মহারথী হয়ে রাজধানীতে বসে খাতা-কলমে হিসেব করে বাজেট তৈরী করে থাকেন।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘এই বাজেট গরীববান্ধব। এ দেশের মানুষকে ঠকাবে না সরকার। সরকার কাউকে গরীব করে কিছু অর্জন করতে চায় না।’কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা ও সেবার আওতাভূক্ত প্রান্তিক কৃষক ও জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মনিরাপত্তা ও সামজিক বীমার কোন দিকনির্দেশনা এই বাজেটে নেই। ফলে ঋণ নিয়ে ছোট কাজ করতে গিয়ে নানা ঝুঁকির মধ্যে হঠাৎ নিপতিত হয়ে তারা আরো বেশী গরীব হয়ে পড়ছে। এসব প্রান্তিক মানুষ একসময় বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। এজন্য শহরে ভাসমান মানুষ ও ক্রমবর্ধমান ভিক্ষুকের চাপ বেশী লক্ষ্যনীয়। এদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে সরকারের পক্ষে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে সামাল দেয়া কঠিন।

আরেকটি বিষয় হলো কোন ধরণের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই সীমান্তে চোরাই গরুর প্রবেশ। এসব চোরাই গরু সংক্রামক রোগ বহন করে আনে। রাতের আধারে চোরাই গরু এনে অসতর্কভাবে কৃষকের সুস্থ গরুর গোয়ালে রাখা হয়। এতে গবাদি পশুর লাম্পিং স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) ছড়িয়ে পড়ে সীমান্ত জেলার প্রান্তিক কৃষকদের জন্য অভিশাপ বয়ে এনেছে। অতীতে এসব অসুখের এত বিস্তার ছিল না।

ক্ষুদ্র উদ্যেক্তা ও প্রান্তিক চাষী এবং ঋণ নিয়ে কাজ করে বেঁচে থাকার জন্য যারা দু’একটি গরু মোটাতাজাকরণের মতো ছোট প্রকল্প নিয়ে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের জন্য বিশেষ সামাজিক বীমার ব্যবস্থা করা দরকার। সামাজিক বীমা হলো সামাজিক নিরাপত্তাদানের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। ডিজিটাল যুগে মানুষের চিরায়ত সামাজিক বন্ড ও আস্থা শিথীল হওয়ায় সামাজিক ভাঙ্গন দ্রুততর হচ্ছে। এটা ঠেকাতে বাজেটের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের যৌক্তিক ব্যবহার করে হতাশ প্রান্তিক উদ্যেক্তাদের সমস্যার দ্রুত সুরাহা হওয়া উচিত।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর