আমেরিকা অন্য দেশের সরকার বদলানোর শক্তি হারিয়ে ফেলছে?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 14:33:18

প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে এই লেখার যে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, তার উত্তর হলো, হ্যাঁ, আমেরিকা অন্য দেশের সরকার বদলানোর শক্তি হারিয়ে ফেলছে। অতএব, বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশেও আমেরিকার দিকে তাকিয়ে রাজনীতি করার দিন শেষ হয়েছে। আমেরিকার দয়ায় যারা রাজনীতি করতে বা ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায়, তাদের সে আশার গুড়েও বালি পড়েছে।

কেন এবং কীভাবে আমেরিকা অন্য দেশের সরকার বদলানোর শক্তি হারিয়ে ফেলছে, সবার আগে তা স্পষ্ট করা দরকার। তবে এটা ঠিক যে, একসময়, বিশেষত 'ঠাণ্ডাযুদ্ধ' বা 'কোল্ড ওয়ার' আমলে আমেরিকা অনেক দেশে নিজের পছন্দমতো সরকার পাল্টেছে। সিআইএ নামক ভয়ঙ্কর গোয়েন্দা বাহিনিকে ব্যবহার করে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় অসংখ্য অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে আমেরিকা। অপছন্দের সরকার প্রধানদের হত্যা করিয়ে নিজের বশংবদদের ক্ষমতায় আনিয়েছে আমেরিকা। এক্ষেত্রে সামরিক বাহিনির কোনো কোনো নেতাকে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে হাত করেছে কিংবা শাসক দলের মধ্যে যড়ষন্ত্রীদের দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটিয়েছে আমেরিকা।

সত্তর ও আশি দশকের এইসব চক্রান্তমূলক ঘটনা নব্বুই ও পরবর্তী সময়কালে ব্যর্থ হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানে বছরের পর বছর চেষ্টা করেও সফল হয়নি আমেরিকা এবং সেসব দেশ থেকে চপোটাঘাত সয়ে চরম অপমানিত হয়ে ফিরে আসতেও বাধ্য হয় মার্কিনিরা। এমনকি, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের ক্ষমতায় নিজের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে আমেরিকা যে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে, সেগুলোও গচ্ছা যায় কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের পকেটস্থ হয়। ফলে অন্য দেশের সরকার বা ক্ষমতা বদলানোর ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রত্যক্ষ ভূমিকার বিষয়ে নীতিগত পরিবর্তন ঘটেছে। বরং দেশটির রাষ্ট্রীয় নীতিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রাধান্য থাকায় আমেরিকা 'সাধুসন্ন্যাসী'র মতো তা প্রচার করছে মাত্র। কেবলমাত্র 'প্রচারক' না হয়ে 'সংরক্ষক' হলে ভারত ও তুরস্কের প্রতি আমেরিকার মনোভাব ভিন্ন হতো। তা হয়নি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ভারতীয় নেতা আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় সমাদর পেয়েছে এবং তুরস্ক বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে আমেরিকাকে।

আমেরিকা অন্য দেশের সরকার বদলানোর শক্তি যে হারিয়ে ফেলছে বা কৌশলগত ভুল করছে, তার প্রমাণ হলো তুরস্ক। বিষয়টি হয়েছে 'বাজে ঘোড়ার উপর বেট ধরে রেসে হারার' মতো ঘটনা। আমেরিকা প্রায়শই এমন ভুল করে এবং কিছু এনজিও, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া ও ব্যক্তিবর্গকে কাজে লাগায়। দক্ষতা ও যোগ্যতার দিক থেকে এইসব নিম্নস্তরের শক্তি নিজেদের আর্থিক বা বস্তুগত ফায়দা পেলেও আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করতে পারেনা। যে কারণে টানা তৃতীয় বার নির্বাচনে জয়ী হয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদে রয়ে গেলেন রিচেপ তাইপ এর্দোয়ান। আমেরিকার নিরলস প্রচার, তুরস্কের সমাজের আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতা-প্রাপ্ত উদারপন্থীদের আপ্রাণ বিরোধিতা, কিছুই তাঁর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন আটকাতে পারল না।তিনি এর আগে তিন বার দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে মোট ২০ বছর ধরে তিনি তুরস্কের শাসনক্ষমতা নিজের হাতে ধরে রেখেছেন। গণতন্ত্রে ২০ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকা কোনো কোনো রাজতন্ত্রের চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী। আমেরিকার নাক গলানোর কারণে তুর্কিরা এমনটিই বেছে নিয়েছে।

বলা হচ্ছে, আমেরিকার বিরোধিতার কারণেই জনসমর্থন পাচ্ছেন এর্দোগান। কিছু শক্তি আমেরিকায় বসে তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে সক্রিয় হয়ে তুরস্কের প্রধান শহরগুলোতে কিছুটা সফল হলেও গ্রামাঞ্চলের গরিব শ্রেণির মধ্যে, তুরস্কের সমাজের রক্ষণশীল অংশের মধ্যে, এবং বিশেষ করে নারীদের মধ্যে ইসলামি পরিচিতি ধরে রাখার টানে এর্দোগান এখনও আগের মতোই জনপ্রিয়। মূলত আশেপাশের মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমেরিকার কুকর্ম দেখে তুর্কিরা আমেরিকাকে তাদের ত্রিসীমায় ঘেষঁতে দিতে নারাজ। আর এজন্যই তুর্কি ভোটাররা এর্দোগানের প্রতি রয়েছেন, এমনকি, নতুন ভোটারদের (মোট ভোটদাতাদের ৮ শতাংশ) মধ্যে বেশির ভাগই তাঁকে সমর্থন করেছেন। কারণ, যে তুর্কি বালক দু’পয়সা বাড়তি রোজগারের আশায় লেমোনেড ও তিলের রুটি ফেরি করে বেড়াত, রাজধানী আঙ্কারায় তারই জন্য ৬১৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত ১১১৫ কামরার রাজকীয় প্রাসাদ এখন সাধারণ তুরস্কবাসীর কাছে সম্ভ্রমমিশ্রিত বিস্ময়ের ব্যাপার এবং ইউরোপ-আমেরিকার হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তুর্কি জাতীয়তাবাদের গৌরব স্বরূপ।

প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে উন্নয়নের উপর জোর দেওয়ায় তুরস্কের অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা হয়, এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্রের আওতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। তুর্কিদের তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন, ইসলাম এবং আর্থিক উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলতে পারে। এ ভাবেই আমেরিকার সমালোচনা ও বিরোধিতার বাস্তব জবাব দেন তিনি। অবশেষে আমেরিকা ২০১৬ সালে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলেও এর্দোগান তা ব্যর্থ করে দেন।

আমেরিকা ও পশ্চিমি দুনিয়ার বিরুদ্ধে এর্দোগান অব্যাহতভাবে বিজয়ী হচ্ছেন একজন ‘বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন নেতা’ হওয়ার কারণে। কারণ, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্কের ভূমিকা ইতিমধ্যেই বহু প্রশংসিত। ন্যাটো সদস্য হিসাবে একদিকে তুরস্ক ইউক্রেনকে শক্তিশালী ড্রোন এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে, অন্য দিকে রাশিয়ার সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। যুদ্ধের মধ্যেই যাতে ইউক্রেনের গম বিভিন্ন দেশে রফতানি অব্যাহত থাকে, সে ব্যাপারে তুরস্ক রাশিয়াকে বুঝিয়ে রাজি করেছ। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এখন তুরস্কে বড় মাপের বিনিয়োগ করছেন। ইতিমধ্যেই রাশিয়া সে দেশের প্রথম পরমাণুকেন্দ্র তৈরি করে দিয়েছে ২০০০ কোটি আমেরিকান ডলার ব্যয়ে। অন্য দিকে, তুরস্কও রাশিয়া থেকে সস্তা দরে তেল কিনে এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চালিয়ে গিয়ে রাশিয়াকে পশ্চিমি দুনিয়া আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করছে।

রাশিয়ার সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা এবং আরো অনেককিছু দেখে বিরক্ত হলেও আমেরিকার পক্ষে এই মুহূর্তে তুরস্কের বিষয়ে কিছু করার নেই, যেমন ভারতে যা হচ্ছে তার ব্যাপারেও আমেরিকা কিছুই করতে পারছে না। আমেরিকাই বরং তুরস্ক ও ভারতকে হাতে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টারত। এসব হচ্ছে এজন্য যে, দ্বিমেরুর বিশ্ব ভেঙে আমেরিকার নেতৃত্বে যে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তা আর নেই। বিশ্বের ক্ষমতা ও আর্থিক সঞ্চালন এখন বহু কেন্দ্রে বিভক্ত। আমেরিকার পক্ষে একচেটিয়া কিছু করার দিন বিগত। বরং আমেরিকা অন্য দেশের সরকার বদলানোর বা প্রভাব বিস্তারের শক্তি হারিয়ে ফেলছে। দেশপ্রেমিক, জনপ্রিয় ও বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন নেতৃত্বের সামনে আমেরিকার জুজু মুখ থুবড়ে পড়ছে।

তারপরেও আমেরিকা চুপ নেই। বৃদ্ধ সাপের মতো উদ্ধতস্বভাবে এদেশে-সেদেশে ছোবল দিতে চাচ্ছে। এতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নাম ব্যবহার করা হলেও সত্য হলো এই যে, কোনো দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন বাইরে থেকে আমদানির বিষয় নয়, ভেতর থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উত্থিত হওয়ায় বিষয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে বাইরের শক্তি তথা আমেরিকা বা অন্য কারো কিছুই করণীয় নেই। কোনো দেশের মানুষ যখন এই সারসত্য বুঝতে পারে, তখন হস্তক্ষেপ-আকাঙ্ক্ষী আমেরিকার ব্যর্থ হওয়া ছাড়া উপায় থাকেনা। আর কোনো দেশের মানুষ যখন এই সারসত্য বুঝতে না পারে, তখন সে দেশটি পাকিস্তান হয়, যেখানে আমেরিকা বছরের পর বছর নানা পক্ষকে খেলিয়ে খেলিয়ে দেশ ও জনগণের বারোটা বানিয়ে দেয়।

থ্যাঙ্কস গড। বাংলাদেশ ৫০ বছর আগেই পাকিস্তানকে পরিত্যাগ ও প্রত্যাখ্যান করেছে। পাকিস্তান এখন আর কোনো দিক থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনীয় হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা। দেশের ভেতরে ও বাইরের সবাইকে এ বাস্তবতা বুঝতে হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর