কোরবানি ঈদের পুত-পবিত্র বোধন

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 13:28:34

কোরবানির ঈদ প্রতিবছর আসে যায়। একটি মহান শিক্ষা রেখে যায়। তা হলো কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে মানব মনের সোচ্চার হবার জাগরণী শিক্ষা। মহান আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে শয়তানের শত কুমন্ত্রণা ডিঙ্গিয়ে ত্যাগ স্বীকার করে খোদাপ্রীতি অটুট রাখা হচ্ছে কোরবানির মূল নিয়ামক। নিজের প্রাণপ্রিয় পুত্রকে উৎসর্গ করার চেষ্টার মাধ্যমে যাবতীয় কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে সৃষ্টি হয়েছে এই কোরবানি ঈদ। যদিও কোরবানি শুরু হবার ইতিহাস হযরত আদম (আ:) এর প্রথম দুই পুত্রের কৃতকর্মের সাথে জড়িত তবুও এর বহু শতাব্দী পরে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর স্বপাদৃষ্ট হয়ে মহান আল্লাহর আদেশে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি করার ঘটনার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজড়িত।

কোরবানি হযরত ইব্রাহীম (আ:) তাঁর প্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি চালানোর সময় মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ফেরেশতার মাধ্যমে শুভেচ্ছাস্বরুপ পশু কোরবানি করার সুযোগ করে দিয়ে মানব মনের এই বিজয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তখন থেকে ইসলামের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে এই কোরবানি ঈদ, এই মহান ত্যাগের শিক্ষা।

একজন নবী হিসেবে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর জীবন সংগ্রামের সেই সততার শক্তি এতটাই পরীক্ষিত যে, সারা বিশ্বের ঈমানদার মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় মহান আল্লাহর নৈকট্য খুঁজে পেতে ও নিজের অন্তরকে শক্তিশালী করার মানসে ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে প্রতিবছর ঈদুল আজহার এই দিনটি পালন করতে উদ্যত হয়ে থাকে। একমাত্র মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভে কোরবানির এই দিনটি পালনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট কোরবানির পশুর রক্ত-মাংস পৌঁছায় না, পৌঁছায় আল্লাহর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে আল্লাহ্ভীতি। সবার কোরবনি গ্রহণীয় নয়, আল্লাহ্ভীরুদের কোরবানিই কেবল গ্রহণীয়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুত্তাকীদের নিকট থেকে তা গ্রহণ করেন (সুরা মায়েদা, আয়াত-২৭)। আর মুত্তাকী তারাই যারা নিজেদের সকল কাজকর্মে আল্লাহ ছাড়া কাউকে শরীক করেন না, সবসময় আল্লাহকে ভয় করেন, স্মরণ করেন ও কোনরুপ অন্যায় কাজে লিপ্ত নন।

কোরবানির মাধ্যমে সারা বিশ্বের মুসলমানেরা মনের কালিমা ও পশুত্বকে বিলীন করার জন্য ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করে থাকেন। এর মাধ্যমে পিতা-পুত্রের চমৎকার সুসম্পর্কের উদাহরণ রয়েছে। একজন ঈমানদার পিতার ইচ্ছার প্রতি একজন বাধ্যগত সন্তান অসীম ধৈর্য্যশীলতার পরিচয় দিয়ে নিজেই ধারালো ছুরির নিচে গলা পেতে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন তা আজও বিস্ময়কর ব্যাপার মনে হয়। পিতার আদেশ পালনে নিজের জীবনের সবকিছুকে তুচ্ছ মনে করে উৎসর্গ করার মাধ্যমে হযরত ঈসমাঈল (আ:) পরবর্তীতে নবুয়ত লাভের পথকে প্রশস্থ করেছিলেন। এই বাধ্যগত ও ধৈর্য্যশীল সন্তানের কথা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে (সুরা সাফফাত, আয়াত-১০২-১০৯)। যার ফলশ্রুতিতে কোরবানি ঈদের গুরুত্ত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

কোরবানির মাধ্যমে মানব মনের পঙ্কিলতার সাথে অহংকার দূর হবার সুযোগ ঘটে। নির্দিষ্ট বয়সের দামি, কমদামি সুস্থ-সবল সব ধরণের পশু কোরবানি করা যায়। অসহায়, দরিদ্রদের মাঝে কোরবানির গোশত্ ও চামড়া বিক্রির অর্থ দান ও ভাগাভাগি করা এক ধরণের সহমর্মিতা। এতে সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়।

কোরবানি নিছক পশু হত্যা নয়। ভীরু, দো-মনা ও অবিশ্বাসীদের উদ্দেশ্য করে কবি নজরুল লিখেছেন, “ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন; দুর্বল! ভীরু! চুপরহো ওহো খামাখা ক্ষুব্ধ মন, এয় ইব্রাহীম আজ কোরবানি করে শ্রেষ্ঠ পুত্রধন; ... আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পুত বোধন, ‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।”

এই কোরবানির মাধ্যমে শুধু পিতা-পুত্রের সুসম্পর্কের শিক্ষাই নয়, বিশ্ব মানবতা লাভ করেছে খোদা প্রেমের আনুগত্যের মহান ব্রত। জারি হয়েছে মোনাফিক ও জালিমের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা। এক শ্রেণির ভোগবিলাসীদের নিকট কোরবানি রীতিমতো অপ্রীতিকর বিষয় মনে হলেও তারা পশুর মাংস ছাড়া একদিনও রসনা তৃপ্তিতে মোহ কাটাতে পারে না। জীব হত্যা মহাপাপ বলে যেসব দেশে অহিংস কথা বলা হয় সেসব দেশেও গরু, ঘোড়া, শূকর, ভেড়া, মুর্গী, হাঁস ইত্যাদি বেশী উৎপাদন ও ভোগ করা হয়। এমনকি তারা সর্বপ্রাণিভূক মানুষ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। তাদের দেশ থেকে বিদেশে মাংস রপ্তানী করার জন্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাজার হাজার।

কিন্তু ইসলাম ধর্মে কোন ভণিতা নেই। এখানে কোরবানি ঈদের ত্যাগ শুধু পশু জবাই করা নয়। এটা এক ধরণের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য শুধু আদি পিতা ইবাহ্রীম-ই নন, মা হাজেরা তার বুকের ধনকে সাজিয়ে গুছিয়ে খোদার রাহে উৎসর্গের জন্য নির্জন মরু এলাকায় পাঠিয়েছিলেন আরো কঠিনভাবে সংকল্পবদ্ধ মন নিয়ে। কবি নজরুলের কথায় তাই যথাথভার্বে ফুটে উঠেছে, ‘এ ত্যাগে যুদ্ধ মম’; তাই ‘জননী হাজেরা বেটারে পরালো বলির পুত বসন!’

খোদাদ্রোহী সমাজের মানুষের জন্য কোরবানির ঈদ নয়। খোদাভীতি ছাড়া কোরবানি হলো লৌকিক, রসনা পূজা করার নামান্তর। ইসলামকে যারা দিনরাত জবেহ করে তাদের কিসের কোরবানি? তারা বেদ্বিন। এই কথাটির ওপর জোর দিয়ে কবি নজরুল কোরবানির আসল শিক্ষাকে উজ্জলভাবে প্রস্ফুটিত করেছেন।

দুর্বল ঈমান, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য সর্বপোরি হালাল-হারামের পার্থক্য বুঝে চলার চেষ্টা না করা মুসলমান আজকের ডিজিটাল বিশ্বে কোরবানিকে গুলিয়ে ফেলেছে লক্ষ লক্ষ টাকা দামি পশু কোরবানি করে লৌকিকতা দেখানোর প্রতিযোগিতায়। তাদের অহংকারের লিপ্সা মেটাতে গড়ে উঠেছে জিএম, ইএম প্রযুক্তি দিয়ে দৈত্যাকার পশু বানিয়ে এবং স্টেরয়েড দিয়ে কৃত্রিমভাবে দ্রুত পশু মোটাতাজা অনৈতিক ব্যবসা চালু করার প্রবণতা।

অতিরিক্ত হরমোন ও স্টেরয়েড ব্যবহার করা একটি দৈত্যকার গরু গত বছর গাবতলী হাটে বিক্রি হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত হাঁতে না পেরে মৃত্যুবরণ করেছিল। পশুর প্রতি এ ধরণের অবিচার ও অনৈতিক আচরণ কিছু মানুষকে আরো বেশী লোভী ও অমানুষ বানিয়ে ফেলেছে। এসব করে তাদের জীবন সংগ্রামে সততার শক্তি বিলীন হয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা, ধৈর্য্য ইত্যাদিও উবে গেছে।

বর্তমান অস্থির বৈশ্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। বিত্তশালীদের বাসার গেটে ডিজিটাল তালাচাবি ও কোরবানির মাংস ফ্রিজে ঢুকানোর কৃষ্টি ব্যাপকভাবে চালু হওয়ায় কোরবানি করা মাংসের বন্টন-ব্যবহার নিয়ে নানা ফতোয়া প্রদান শুরু হয়েছে। যত রেফারেন্স দেয়াই হাক না কেন, সেসব বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা, দয়া ও সহমর্মিতার লেশমাত্র নেই। বরং তাতে সমাজের অসহায়, ভূখা, দরিদ্র মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে কোরবানির মাংসের ভাগ থেকে।

একদিকে আয় বৈষম্য অন্যদিকে সার্বিক অধিকারহারা মানুষেরা শুধু কোরবানির ত্যাগের মহিমার গল্প শুনে দিনাতিপাত করে যাবে- এটা আসল কোরবানি ঈদের পরিচয় বহন করে না। মহান আল্লাহ্র নামে জান কোরবান করে আল্লাহর নির্দেশিত পথে তার সঠিক ব্যবস্থাপনা করাই প্রকৃত ত্যাগ হতে পারে। সেই মহান ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে কোরবানি ঈদের পুত-পবিত্র বোধদয় জাগিয়ে উঠুক সকল বিপথগামী ও ভুলুন্ঠিত মানব হৃদয়ের মাঝে, দিকে দিকে।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর