জামাল ভূঁইয়াদের ‘অপমানে’ মার্তিনেজ দায়ী নন

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-09-01 03:55:56

তিন দশকের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা পর কাতারে তৃতীয়বারের মত বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ী আর্জেন্টিনা দলের গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ ঢাকা সফর করে গেছেন। গতকাল সোমবার (৩ জুলাই) ভোরে অনেকটাই চুপিসারে ঢাকা এসে পৌঁছান তিনি। দিনের একটা অংশ ঢাকায় কাটিয়ে বিকেলে চলে গেছেন তাঁর এই সফরের মূল কেন্দ্র ভারতের কলকাতায়। সেখানে আছে বিশাল আয়োজন। বাংলাদেশে বলতে গেলে কিছুই নেই। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা পরিবারসহ দেখা করেছেন তাঁর সঙ্গে। মার্তিনেজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছেন তাঁর অফিসে। প্রবল আকাঙ্ক্ষার ঢাকা সফরে এরবাইরে আর কোন স্মৃতি নাই আদতে মার্তিনেজের।

আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ ট্রফি পাওয়া এই গোলরক্ষক ঢাকা এসেছিলেন ব্যাপক আগ্রহ থেকেই। কাতার বিশ্বকাপ চলাকালে তাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের প্রবল ভালোবাসা দেখেছেন বিভিন্ন মাধ্যমে, শুনেছেন বিভিন্নজনের কাছ থেকে। তাইতো ভারত সফরের আগে দেড় দিনের বিমান সফরের পর প্রথমেই পা রেখেছিলেন বাংলাদেশে। এরপর বোতলবন্দি প্রায়। স্পন্সর প্রতিষ্ঠান নেক্সট ভেনচারসের কর্মকর্তা-কর্মচারী আর এক প্রতিমন্ত্রী ও এক সংসদ সদস্য ছাড়া দেশে কোটি আর্জেন্টিনাপ্রেমি থেকে দূরে থেকে গেলেন তিনি। বলা যায়, দূরে রাখা হয়েছে তাঁকে।

এমিলিয়ানো মার্তিনেজের ঢাকা সফর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের উদ্যোগে হয়নি। হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। অখ্যাত এক প্রতিষ্ঠান তাঁকে ঢাকায় এনেছে। তাদের দেওয়া সূচি অনুযায়ী তাঁরা তাঁকে পরিচালনা করেছে। এখানে সবটাই ছিল তাদের পরিকল্পনামাফিক, যার বাইরে তারা যায়নি। এমনকি মিডিয়াকেও কাছে যেতে দেয়নি তারা। কাছে গেছেন কেবল প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি, তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। সরকার ও সরকার-দল আওয়ামী লীগের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কীভাবে একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অংশ হয়ে পড়লেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। কারণ তাঁরা আর যাই হোক ফুটবল-সংশ্লিষ্ট কেউ নন। তবে কি তাঁরা নেক্সট ভেনচারস নামের প্রতিষ্ঠান কিংবা এর সহযোগী কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত?

মার্তিনেজের এই সফর ব্যক্তি কিংবা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের উদ্যোগে। এখানে অনেক বিধিনিষেধ থাকতে পারে, থেকেছেও। স্পন্সর প্রতিষ্ঠান কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। এমনকি মার্তিনেজের দেখা পাননি জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া ও গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকোও। তাঁরা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করে দেখা পাননি মার্তিনেজের। এনিয়ে সরগরম সামাজিক মাধ্যম।

এমিলিয়ানো মার্তিনেজ যখন বাংলাদেশে আসেন তখন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে ভারতে। দুপুরে ঢাকায় ফেরে ফুটবল দল। বিমানবন্দরে নেমে মার্তিনেজের দেখা পেতে অপেক্ষা করতে থাকেন জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াসহ কয়েকজন। কিন্তু তাঁরা সাক্ষাৎ পাননি। মার্তিনেজের ঢাকা ত্যাগের সময়ে সাক্ষাৎ পেতে বহির্গমনের দিকে যান জামাল ভূঁইয়া। মার্তিনেজকে স্বল্প দূরত্ব থেকে দেখলেও বাংলাদেশের অধিনায়ক ফ্রেমবন্দি কিংবা পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাননি। জাতীয় দলের টিম অ্যাটেনডেন্ট মো. মহসিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘অনেকে চলে গেলেও জামাল ভাই মার্তিনেজের সঙ্গে দেখা করার অপেক্ষায় ছিলেন। মার্তিনেজ যেখানে ছিলেন সেখানে কড়া নিরাপত্তা ছিল। আমি সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে জামাল ভূঁইয়ার দেখা করার ইচ্ছার কথা জানাই। কিন্তু কোনও সাড়া পাইনি।’

জামাল ভূঁইয়া বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেন। একটা অবস্থান আছে তাঁর। তিনি দেশের তারকা খেলোয়াড়। কেবল খেলোয়াড়ই নয়, স্প্যানিশ লা লিগায় কয়েক বছর আগে ফুটবল বিশ্লেষক হিসেবেও তাঁর ডাক পড়েছিল। সেই পর্যায়ের ব্যক্তিত্ববান হিসেবে তাঁকে দেখে থাকি আমরা। কী কারণে হঠাৎ তিনি ভুলে গেলেন নিজের অবস্থান? কেন তিনি এভাবে এত উদগ্রীব হলেন সাক্ষাতে? এমিলিয়ানো মার্তিনেজ আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য বলে তাঁর প্রতি আলগা অনুরাগ এখানে কাজ করল? ভুলে গেলেন নিজের অবস্থানটুকু? এছাড়া তাঁর কি মাথায় রাখা উচিত ছিল না মার্তিনেজের এই সফরে ফুটবল নেই, আছে ব্যবসায়িক ধারণা; যারা বিমান ভাড়ার টাকা দিয়েছে চলবে তাদের মর্জিমাফিক!

এছাড়া তুলনামূলক বিশ্লেষণে যদি যাই তবে বলা যায়, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কিংবা লিওনেল মেসির জন্যে জামাল ভূঁইয়ারা অপেক্ষা করতে পারতেন, কারণ তাঁরা সর্বকালের অন্যতম সেরাদের পর্যায়ের। তাঁরা বিরল প্রতিভার পাশাপাশি বিরল রেকর্ডের অংশীদার। কিন্তু এমিলিয়ানো মার্তিনেজ সে তুলনায় কিছুই নন। ফুটবল মাঠে অসংলগ্ন কিছু আচরণ দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ, আর বিশ্বকাপের কয়েকটি ম্যাচে দুর্দান্ত কয়েকটি সেভ ছাড়া আদতে সাদামাটা এক ফুটবলারই। প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব অ্যাস্টন ভিলার হয়ে খেলে এমন কিছু করতেও পারেননি যা দিয়ে সেরা গোলরক্ষকের তকমা মেলে। তাঁকে দেখতে জামাল ভূঁইয়ার মত ফুটবলারকে এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাটা তাই দৃষ্টিকটু।

পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান কি চাইলেই এখানে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে পারত? মনে হয় না! কারণ এখানে যেমন নিরাপত্তার বিষয় জড়িত, তেমনি জড়িত সূচি-বিষয়ক শৃঙ্খলার বিষয়ও। যদিও জামাল ভূঁইয়াদের পক্ষ থেকে মোটেও নিরাপত্তা পরিপন্থী কিছু ঘটত না, তবুও।

এমিলিয়ানো মার্তিনেজের জন্যে অপেক্ষা করার আগে জামাল ভূঁইয়াদের নিজেদের দিকে তাকানোর দরকার ছিল। তাঁর অপমানে আমরা ব্যথিত, কিন্তু এই অপমানটা কি তিনি নিজে ডেকে আনেননি? তিনি প্রফেশনাল ফুটবলার, কিন্তু এভাবে তাঁকে অতি-আবেগী হয়ে নিজের অবস্থান ভুলে যেতে দেখতে চাইনি।

জামাল ভূঁইয়া-আনিসুর রহমান জিকোরা এমিলিয়ানো মার্তিনেজের দেখা পাননি। অপেক্ষা করেও দেখা না পেয়ে অপমানিত হয়েছেন, যা তাঁদের মুখভঙ্গি দেখে পরিষ্কার। তবে এই অপমান কি তাঁরা নিজেরাই ডেকে আনলেন না? হ্যাঁ, প্রবল জাতীয়তাবাদী ধারণা নিয়ে আমরা এখানে মার্তিনেজকে দায়ী করতে পারি, কিন্তু এটা যৌক্তিক নয়। এখানে দায় নেই মার্তিনেজের। তাঁকে যেভাবে পরিচালনা করা হয়েছে তিনি সেভাবেই চলেছেন। ফুটবল মাঠের ৯০ মিনিট তাঁর যেমন বক্সের বাইরে যেতে মানা, তেমনি ঢাকায় থাকা ১১ ঘণ্টাও সূচির বাইরে যেতে মানা ছিল তাঁর!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
ইমেইল: kabiraahmed007@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর