জলের জন্য যুদ্ধ!

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 00:55:21

যুদ্ধ ও সংঘাত হয় সম্পদের জন্য, ক্ষমতার জন্য, অর্থ-বিত্ত-প্রেয়সীর জন্য। অতীতের যুদ্ধগুলোর কার্যকারণসূত্র পর্যালোচনা করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। কিন্তু ভবিষ্যতে যুদ্ধ হবে জলের জন্য। পৃথিবীর জলপ্রবাহ কমে যাওয়ায় এমনই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। তাদের শঙ্কা যে অমূলক নয়, সে প্রমাণও দেখা যাচ্ছে।

কয়েকদিন আগের কথা। নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ এবং জলের অধিকারকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল আফগানিস্তান ও ইরান। ঝলসে উঠেছিল আগ্নেয়াস্ত্র। প্রাণ হারিয়েছিলেন বেশ কিছু মানুষ। এই সংঘাতকে বিশ্বের প্রথম ‘জল-যুদ্ধ’ (Water War) হিসাবে অভিহিত করেছিলেন বিশ্বের কূটনীতিবিদদের একাংশ। আগামীদিনে এই ‘জল-যুদ্ধ’ অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠতে চলেছে গোটা বিশ্বজুড়ে, বিশেষত আফ্রিকায়, এমনকি এশিয়াতেও।

অনেকের নজর এড়িয়ে গেলেও বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যেই জলসংকট নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে আফ্রিকার ৯২ কোটি মানুষ। গবেষকদের আশঙ্কা, ২০৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকার জনসংখ্যা ছুঁতে পারে ৪০০ কোটির গণ্ডি। যার মধ্যে এক পঞ্চমাংশ বা ৯২ কোটি মানুষ তীব্র জল-সংকটের শিকার হবেন। তাঁরাই মূলত জড়িয়ে পড়বেন সংঘাতে। উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার পর, সংখ্যাটা ৫৩.৬ কোটিতে নেমে আসলেও সম্পূর্ণভাবে এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব-- মনে করা হচ্ছে এমনটাই। সবমিলিয়ে জলকে কেন্দ্র করেই যেন বৃহত্তর এক যুদ্ধের প্রমাদ গুনছে আফ্রিকা।

এসব তথ্যের জোগান দিয়েছে ‘দ্য কনভারসেশন’ নামের একটি পত্রিকা। পত্রিকার পক্ষে পরিচালিত এই সমীক্ষাটির নেতৃত্বে ছিলেন আমস্টারডামের ব্রিজ ইউনিভার্সিটির গবেষক সোফি ডি ব্রুইন। তাছাড়াও এই গবেষণায় জড়িত ছিলেন আইএইচই ডেলফট, ইউট্রেচ বিশ্ববিদ্যালয় ও ওয়াগেনিঞ্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা।

গবেষকদের এ-ধরনের দাবির ফলে একটা গোটা মহাদেশের মানুষদের জল-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় উদ্বেগও বাড়ছে। অবশ্য জাতিগত সংঘাত আফ্রিকার বৈশিষ্ট্য হলেও সেখানে জল নিয়ে সঙ্কট রয়েছে। এমনটি স্পষ্ট হয়েছিল যখন নীল নদের ওপর গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য বিশেষ ঘোষণা করেছিল ইথিওপিয়া। আর এই প্রকল্প ঘিরেই বিতর্কে জড়ায় মিশর এবং সুদান।

নীল আফ্রিকার দীর্ঘতম নদী। নীল প্রবাহিত হয় উগান্ডা, সুদান, দক্ষিণ সুদান ও মিশরের ওপর দিয়ে। কিন্তু নীলের শাখানদীগুলো ইথিওপিয়া অতিক্রম করে মেশে নীল নদে। ফলে, ইথিওপিয়ায় দৈত্যাকার বাঁধ নির্মিত হলে নীল নদের প্রবাহ প্রভাবিত হতে পারে, এমনটাই আশঙ্কা মিশর ও সুদানের। কারণ, এই দুই দেশে পানীয় এবং সেচ প্রকল্পে ব্যবহৃত জলের প্রায় ৯৭ শতাংশ আসে নীল থেকে।

দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনা চললেও এই সমস্যার কোনো সমাধানই খুঁজে পায়নি আফ্রিকার তিন দেশ। অন্যদিকে গত বছর থেকেই এই বাঁধ তৈরির কাজ শুরু করেছে ইথিওপিয়ার প্রশাসন। সবমিলিয়ে ক্রমশ বেড়ে চলেছে তিন দেশের উত্তেজনা। পরবর্তীতে যা যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাতের কারণ হয়ে উঠতে পারে বলেই ধারণা গবেষকদের।

তবে এখানেই শেষ নয়। আফ্রিকার বেশিরভাগ নদী অববাহিকাই কোনো নির্দিষ্ট দেশের মধ্যে অবস্থিত নয়। বরং, কোনো নদীর অধিকার দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বণ্টিত। ভৌগোলিক মানচিত্র অনুযায়ী, আফ্রিকার ৬৬টি দেশের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকা রয়েছে। যার মধ্যে নীল নদের অববাহিকা ছাড়াও আছে হর্ন অফ আফ্রিকার জুবা-শেবেল এবং লেক তুরকানা অববাহিকা। উল্লেখ্য, এই অববাহিকার জলের অধিকার এবং বণ্টনের হার নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থার ওপর। আর সেটিই হয়ে উঠতে চলেছে সংঘাতের কারণ।

একদিকে যেমন দ্রুত জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে আফ্রিকায়, তেমনই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমশ বদলাচ্ছে আফ্রিকার বৃষ্টিরেখা। দেখা দিচ্ছে চরম জলাভাব। ফলে নদীর ওপর নির্ভরতা বাড়ছে মানুষের। অন্যদিকে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের মাধ্যমে শক্তি সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে চলেছে তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বচ্ছল দেশগুলো। পরবর্তীতে এই ঘটনাই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে।

জল সঙ্কটের নেপথ্যে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট তাণ্ডবের জন্য দায়ী করা হয় বৈশ্বিক 'উষ্ণায়ন'কে। অতি গরম, প্রচণ্ড দাবদাহ, তীব্র শৈত্য কিংবা মারাত্মক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস অথবা প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প এজন্যই এসে হানা দিচ্ছে বার বার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। আফ্রিকার মতো সঙ্কট তৈরি হচ্ছে এশিয়াতেও। কারণ, হিমালয়ের বরফ গলে যাচ্ছে হু হু করে। বিজ্ঞানিরা আশঙ্কা করছেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে হিমালয়ের হিমবাহগুলো ৮০ শতাংশ আয়তন হারাবে। তাতে অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে ওই এলাকা থেকে উৎপন্ন অন্তত ১০টি প্রধান নদী এবং তাদের যাবতীয় উপনদী ও শাখানদী। তার মানে হলো জল সঙ্কট কবলিত হবে এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়াও।

গবেষকরা তাদের সরজমিন পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জানিয়েছেন যে, হিমালয়ে হিমবাহগুলোর গলনের তেজ এতটাই যে, একের পর এক হিমবাহ উধাও হয়ে যাচ্ছে। এই সংক্রান্ত বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্ট দেখে বিজ্ঞানি মহল চরমভাবে চিন্তিত। তাঁদের দাবি, গত দশকে অর্থাৎ ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে হিমালয়ের বরফ যে গতিতে গলেছে, তা পূর্ববর্তী দশকের তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, বরফ গলনের গতি এক দশকে ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে পাহাড় পর্বতে জমে থাকা বরফ গলবে, এতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। বরং, বরফ গলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু হিমালয়ের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে চিন্তার, তা হল গলনের এই গতি। এত দ্রুত এত বরফ হিমালয় থেকে গলে যাবে, তা ভাবনাচিন্তার বিষয়। ফলে এ বিষয়ে এখন থেকেই সতর্ক হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তাঁরা।

উল্লেখ্য, হিন্দুকুশ-হিমালয়ের হিমবাহগুলো সরাসরিভাবে দক্ষিণ এশিয়ার কমপক্ষে ২৪ কোটি মানুষের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জলের চাহিদা মেটায়। এ ছাড়া, বিভিন্ন নদী উপত্যকায় বসবাসকারী অন্তত আরো ১৬৫ কোটি মানুষ পরোক্ষ ভাবে এই হিমবাহগুলোর উপর নির্ভরশীল।

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই শতাব্দীর শেষে হিমালয়ের হিমবাহগুলো ৮০ শতাংশ আয়তন হারাবে। তাতে অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে ওই এলাকা থেকে উৎপন্ন অন্তত ১০টি প্রধান নদী এবং তাদের যাবতীয় উপনদী ও শাখানদী।

গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, মেকং, ইয়েলো, ইরাবতীর মতো ভারত ও চীনের বহু গুরুত্বপূর্ণ নদীর জলের উৎস হিমালয়ের হিমবাহ। সেগুলো গলে গেলে এই নদীতে প্লাবন দেখা দেবে। নদীর উপত্যকায় বসবাসকারী বহু মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়ে উঠবে তাতে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ (সিসিআরএস)

এ সম্পর্কিত আরও খবর