চাকরির বয়সসীমা ও সনদ পোড়ানো

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 05:20:26

বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছে কষ্টার্জিত মূল্যবান সনদ পোড়ানোর ঘটনা। দীর্ঘসময় বেকারত্বের জ্বালা ও অপমান সইতে না পেরে কিছু সনদধারী শিক্ষিত মানুষ এসব অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে চাকরির সরকারি বয়সসীমা পেরিয়ে যাবার ফলে যারা নিজেকে বঞ্চিত মনে করছেন এবং যারা অচিরেই নিজের সরকারি চাকরি লাভের নির্ধারিত বয়সের গন্ডি পেরিয়ে যাবার আশঙ্কা করছেন তারা রাজপথে আন্দোলনে নেমেছেন।

গেল জুন মাসে রাজধানীর শাহবাগে এই ধরনের একটি আন্দোলনকে দাবি আদায়ের জন্য বেশ সোচ্চার হতে দেখো গেছে। ‘চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ’ নামক ব্যানারে শাহবাগে জড়ো হয়ে রাস্তায় বসে দাবি জানাচ্ছিল তারা। তাদের দাবি চাকরিতে আবেদনের জন্য ফি-এর পরিমাণ প্রথম শ্রেণিতে ২০০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১৫০, তৃতীয় শ্রেণিতে ১০০ এবং চতুর্থ শ্রেণিতে ৫০ টাকা করতে হবে। পুলিশ তাদেরকে লাঠিপেটা করে এবং ৯ জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। একদিকে সনদ পোড়ানো ও অন্যদিকে সনদধারীদের চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবি আমাদের দেশের শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর এক ধুসর দিকের নগ্নচিত্রকে জনসন্মুখে তুলে ধরেছে।

আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা নিজেই শিক্ষিত বেকার তৈরির একটা সচল কারখানা হিসেবে বিবেচিত। এর খারাপ দিক নিয়ে প্রতিনিয়ত নানা কথা বলা হচ্ছে। নীতিনির্ধারকগণ সেগুলো শুনেও না শোনার ভান করে রাতারাতি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিচ্ছেন। বিশেষ করে শহরের ঘনবসতিপূর্ণ, আঁটঁসাট ঘিঞ্জি এলাকায়, মার্কেটের ছাদে, একটি ভবনের মাঝে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দান এবং সেগুলোতে মানহীন শিক্ষক ও শিক্ষার পরিবেশ আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে একট ভয়ানক নাজুক অবস্থার মুখে ঠেলে দিয়েছে। পাশাপাশি রাজধানীসহ সব বড় শহরে মারাত্মক যানজট তৈরির বড় উপকরণ হিসেবে সহায়তা করে চলেছে। তবুও থেমে নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জন্য ডিও লেটার নিয়ে ব্যবসায়ী সাংসদ ও নীতিনির্ধারকদের এই হীন প্রচেষ্টা।

উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর তারা কি কাজ করতে তার কোন নিশ্চয়তা দেবার বাধ্যবাধকতা না থাকায় বন্যার জলের মতো এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গজিয়ে পাখা মেলে চলেছে। অপরদিকে সরকারি কলেজগুলোতে উচ্চতর ডিগ্রী প্রদানের নিয়ম চালু হলেও অভিজ্ঞ শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাবে সেখান থেকে ডিগ্রীধারীগণ অনেকে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ছেন।

এমন একটি ঘটনা ঘটেছে- নীলফামারী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক সম্মান ডিগ্রীধারী এক বেকার যুবকের বেলায়। তাঁর বয়স ৩১। তিনি ২০১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক সম্মান ডিগ্রী লাভ করেন। অর্থাভাবে তিনি মাস্টার্স পড়ার সুযোগ পাননি। তার পিতার সামান্য জমির ফসল দিয়ে কোনরকমে তাদের পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। তিনি সরকারি চাকরির জন্য বহু আবেদন করেছেন, পরীক্ষা দিয়েছেন। বহু জায়গায় ভাইবার জন্য ডাকা হলেও তার চাকরি মেলেনি। সরকারি চাকরির বয়সসীমা পার হয়ে গেলে তিনি ফেসবুক লাইভে এসে নিজের কষ্টার্জিত মূল্যবান সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেন।

সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলার পর রোজ নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি তাকে চাকরি দেয়। সেখানে তিনমাস চাকরি করার পর নিয়মিত বেতন না পেলে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর ডিমলা নির্বাহী উপজেলা কর্মকর্তা তাকে একটি কন্সট্রাকশন ফার্মের চাকরি দিয়ে ঢাকায় পাঠান। কিন্তু সেখানে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে সাধারণ কাজ দেয়ায় তিনি সেটা ছেড়ে চলে আসেন। এরপর হাতাশা থেকে তিনি ফেসবুক লাইভে সার্টিফিকেট ছিঁড়ে নিজের অবস্থা প্রকাশ করেন।
কিছুদিন আগে ইডেন কলেজের একজন শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেন। ফেসবুক লাইভে তার ভাষ্য ছিল, যে সার্টিফিকেট চাকরি দিতে পারে না তা রেখে কি লাভ? দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর কোথাও চাকরি প্রাপ্তির জন্য বয়সসীমা নেই। সাতাশ বছর পড়শুনা শেষ করে যদি একটি চাকরির জন্য আবেদন করতে না পারি তাহলে পড়াশুনা করে লাভ কি? তার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে একজন প্রতিমন্ত্রী তাঁকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের আইসটি বিভাগে ছয়মাসের চুক্তিতে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।

উপরের এ দুটি ঘটনা কেবল উদাহরণ মাত্র। দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপর পড়াশুনা শেষ করলেও আমাদের দেশে সে অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। অন্যান্য কর্মবিমুখ ডিসিপ্লিনের থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরো শোচনীয়। সেসব সনদধারীরা অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে চুপ করে থাকেন, মুখ খুলতে চান না।

উদ্দেশ্যবিহীনভাবে উচ্চতর পড়াশুনা করে পাস করা লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী রয়েছেন। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদার সাথে সঙ্গতিহীন পড়াশুনা কেবল হতাশা তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বলা হয়, হাতে কলমে শিক্ষাগ্রহণ দেশের কল্যাণে কিছু একটা কাজে লাগে। কিন্তু হাতে কলমে শিক্ষা গ্রহণ করার পরও দেশের সব জেলা-উপজেলা থেকে সবাইকে ঢাকায় দৌড়াতে হয় একটি চাকরি নামক সোনার হরিণ ধরার আশায়। গত পঞ্চাশ বছরেও দেশের এ অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি।

অপরদিকে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরির বহু পদ খালি পড়ে আছে। শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষকের হাজার হাজার পদ খালি। কলেজ, উচ্চবিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সময়মতো ও ঠিকমতো নিয়োগ-পদোন্নতি হলে শিক্ষকের অভাবে পাঠদানে হিমশিম খেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হবার উপক্রম হতো না। গত ১১ জুন ২০২৩ তারিখে দৈনিক পত্রিকার বড় খবর হলো- রাজধানীর পাশের জেলা গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জয়নাতলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ১৫৩ জন। সেখানে শিক্ষক মাত্র একজন। তিনি দুই শিফটে দৈনিক একাই ২২টি ক্লাশ নেন। অথচ, দেশে অনেক উচ্চশিক্ষিত যুবকরা ছোটখাটো চাকরি পেতে গিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নানা অজানা কারণে বিফল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আরেকটি মজার ব্যাপার হলো- রাজধানী ও বড় বড় শহর এলাকায় শত শত বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিত্তশালীদের সন্তানরা আয়েশ করে পড়াশুনা করতে ভালবাসে। টাকাওয়ালা মানুষের ভিড়ে শহর এলাকায় মানহীন বিশ্বিবদ্যালয় তৈরি করে সনদ বিক্রির মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শহুরে বিত্তশালগণ পক্ষান্তরে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। উপযুক্ত প্রার্থীর অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির মতো বিষয়ে আসন খালি থাকে। অথচ, মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে অখ্যাত প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি পড়ার লোকের অভাব হয় না। কারণ সেগুলোতে সহজে সনদ পাওয়া যেতে পারে এই অভিপ্রায় কাজ করে।

এভাবে বিখ্যাত ও সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে মানহীন শিক্ষা ও সনদবিক্রির ব্যবসা জমজমাট হয়ে দেশে গুণগত শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে।

ভয়াবহ আরেকটি বিষয় হলো- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্পুনফিডের ভয়াবহ আবহ ছড়িয়ে পড়ায় আজকাল কেউ আর ছাপানো বই পড়তে চায় না। অনলাইনে ডিজিটাল বইও পড়ে না, শুধু দেখে ও এক পলকে ভিন্নজগতে চলে যায়। শিক্ষার্থীরা শুধু প্রশ্নোত্তর পেতে চায় ও সেটাকে কপি করে বসিয়ে দিতে চায়। এসব শিক্ষার্থীরা কর্পোরেটের অধীনে বেড়ে উঠে বিধায় তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকগণ তাদের জন্য নিজেদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিতে পারে অথবা অন্যত্র চাকরি ক্রয় করে দেবার ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখে। ফলত: বঞ্চিত হচ্ছে প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা সব দিক থেকে।

এসব কিছু মিলে যে মারাত্মক পরিবেশ তৈরি হয়েছে তাতে কষ্টার্জিত শিক্ষাসনদ কোনভাবে কাজে লাগোনোর উপায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাদের চাকরির বয়সসীমা ও সনদ পোড়ানোর ঘটনা শুরু হয়ে এক ঘৃণ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার যুগের আগমন ঘটেছে। সনদ পোড়ালে মন্ত্রী চাকরি দেন এই উৎসাহে সকল হতাশাগ্রস্থ বেকাররা নিজেদের সনদ পোড়াতে শুরু করলে একজন মন্ত্রী কয়জনকে চাকরির যোগান দিতে পারবেন? এর উত্তর খুব জটিল। এজন্য সুদূরপ্রসারী অন্তর্দৃষ্টিমূলক নীতিনির্ধারণী জরুরি প্রয়োজন।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর