‘তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়’

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-27 00:54:00

"তুমি আসবে ব'লে হে স্বাধীনতা/ সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল/ সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।" কত শত সাকিনা, হরিদাসীর কপাল ভাঙল তার কোনও ইয়ত্তা নেই। অবশেষে স্বাধীনতা মিলল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। ব্রিটিশরাজ কায়েম হয়েছিল প্রায় ২০০ বছর আগে। তারপর ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন-শোষণ।

যদি প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়, তা হলে দেখা যাবে ১৭০০ শতাব্দীতে ইউরোপীয় বণিকরা ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করতে শুরু করে। ১৮০০ শতাব্দীতে অপ্রতিরোধ্য সামরিক শক্তির বলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থানীয় রাজ্যগুলিকে পরাজিত করে ভারতে নিজেদের শাসন কায়েম করে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর, ভারত শাসন আইন ১৮৫৮ সালে পাশ হয় এবং ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতবর্ষের প্রত্যক্ষ শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয়। তার পর থেকে শুরু হয় শাসন ও শোষণ।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দিয়ে যার শুরু, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে তার শেষ। দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এ স্বাধীনতা নিছক ঘরে বসে পাওয়া যায়নি। পেতে হয়েছে দীর্ঘ লড়াই করে। হারাতে হয়েছে দেশের অনেক বীর সন্তানকে।

আজ সেই ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বর। আজ প্রতিটি অফিস-আদালত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওঠবে জাতীয় পতাকা, রাজধানী থেকে শুরু করে গোটা দেশে চলবে কুচকাওয়াজ, দেশাত্মবোধক গান। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। শোনাবেন বীর শহীদদের ইতিহাস। কিন্তু তাঁদের আদর্শে চলার মানসিকতায় কোথাও যেন ছেদ পড়ছে। পাকিস্তানপন্থীদের বিষদাঁত এখনও ভেঙ্গে ফেলা যায়নি। কিছু তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় আজও দেশবিরোধী শক্তি তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশকে অস্থিতিশীল করা উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয়ার সাধনায় মশগুল একটা বিশেষ শ্রেণি তাদের অপতৎপরতা চালিয়েই যাচ্ছে। বিস্ময়কর রকমভাবে তারা কিছু মানুষের সমর্থনও পাচ্ছে।

স্বাধীনতা দিবস মানে কি শুধু একটা ১৬ ডিসেম্বরের সকাল? স্বাধীনতা দিবস মানে কি দেশের স্বাধীনতার জন্য, বিদেশি শাসকের হাত থেকে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল উন্মোচনের জন্য, যে সমস্ত দেশনায়ক জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে হাসিমুখে জীবনোৎসর্গ করেছিলেন, সেই সব বীর সেনানীর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান শুধু? এই কি তাঁদের প্রতি, তাঁদের অভীপ্সার প্রতি, তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি এবং সর্বোপরি, আমাদের অর্জিত স্বাধীনতার প্রতি প্রকৃত ও যথার্থ ন্যায়বিচার?

না; স্বাধীনতা দিবস মানে, আরও বেশি কিছু। স্বাধীনতা দিবস মানে, একটা শপথ গ্রহণের দিন। স্বাধীনতা দিবস মানে, একটা সংকল্প, একটা অঙ্গীকার গ্রহণের দিন। স্বাধীনতা দিবস মানে, তুমি ‘মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়’। হ্যাঁ, সে বলতে চায়— দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চায়— বাংলাদেশ আজও স্বাধীন হয়নি, আমরা এখনও পরাধীন। এই পরাধীনতা শোষণ ও বঞ্চনার, এই পরাধীনতা দুর্নীতি আর কালোবাজারির, এই পরাধীনতা অন্যায় ও অবিচারের, এই পরাধীনতা অশিক্ষা ও অন্ধকারের, এই পরাধীনতা দারিদ্র্য ও অপুষ্টির, এই পরাধীনতা অসাম্য ও সাম্রাজ্যবাদের, এই পরাধীনতা এ দেশের মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার, জীবনযন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে যাওয়ার। স্বাধীনতার এত বছর পরেও, দেশের মেয়েদের নিরাপত্তা তলানিতে। ফতোয়া জারি। সালিশি সভা। চুল কেটে ঘোরানো। নির্যাতন। দীর্ঘ সময় ধরে সেই নির্যাতনের ছবি তুলে দানবীয় উল্লাস। ধর্ষণ। খুন। এ শুধু প্রান্তিক নিরক্ষর মেয়েদের বেলাতেই নয়, সমাজের উচ্চশিক্ষিত উপরতলার মেয়েদের ওপরেও সুযোগ পেলেই এই অত্যাচার, এই অসম্মান সমান তালে চলছে। নারীর প্রতি পুরুষের বিকৃত অসুস্থ কামনার আগুনে দাউদাউ জ্বলছে স্বাধীনতা। জ্বলছে আমাদের লাল-সবুজ পতাকার অন্তরাত্মা।

কালো টাকায় দেশ ভরা। অর্থনৈতিক দুর্নীতি আর কেলেঙ্কারিতে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে বার বার আমাদের নাম আসে। বিপন্ন দেশের অর্থনীতি। অথচ কেলেঙ্কারিতে জড়িত তথাকথিত উচ্চশ্রেণির মানুষ বিপুল ক্ষমতা আর অর্থের জোরে অন্ধকার থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে এসে আবার রচনা করছে নতুন কেলেঙ্কারির বুনট। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে! তাদের অপকীর্তির ফলে নষ্ট হচ্ছে অর্থনৈতিক ভারসাম্য। মুদ্রাস্ফীতি। বাজারে আগুন। মুখ থুবড়ে পড়ছে গরিব মানুষ। দিনগুজরান করতে হিমশিম খাচ্ছে। অপুষ্টি। অনাহার। অকাল মৃত্যু। যে সমাজে শিশুরা খেতে পায় না পেট ভরে, অপুষ্ট শীর্ণ দেহে একমুঠো ভাতের জন্য লাঠি ঝাঁটা খেয়ে কাজ করে মিষ্টির দোকানে কিংবা বড়লোকের বাড়িতে, সেই সমাজে স্বাধীনতা ঢুকবে কি করে? ফলত শোষণ, বঞ্চনা, বাল্যবিবাহ-.. পক্ষাঘাতগ্রস্ত একটা সমাজ। ভোটের জন্য সামান্য টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া হয় এদের, ভোট পেরোলে ক্ষমতায় আসা দল আর ফিরেও তাকায় না এ দিকে।

এই আমাদের স্বাধীনতা। তাই মাইকে দুই ডজন দেশাত্মবোধক গানের সুরে গুনগুন করে সময় কাটানোর দিন ১৬ ডিসেম্বরের সকাল নয়। স্বাধীনতার জন্য আমাদের এখনও অনেক যুদ্ধ বাকি আছে। দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের দামামা তো আমাদেরই বাজাতে হবে। সেই যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় এই ১৬ ডিসেম্বর। সেই যুদ্ধের শপথ নেওয়ার সময়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংকল্প গ্রহণের সময়, ১৬ ডিসেম্বর।

অন্যায়-অবিচার-শোষণ-বঞ্চনা-দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষ-অশিক্ষা-দুর্নীতি-কালোবাজারি-ব্যভিচার-ধর্ষণ-অগণতন্ত্র ও সমস্ত রকম অনাচারের হাত থেকে দেশকে প্রকৃত স্বাধীন করার এই সংকল্প তথা অঙ্গীকারের মধ্যেই দেশের জন্য প্রাণ বলিদান দেওয়া মহান শহিদদের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ নিহিত থাকবে। যে মানুষ গান গাইতে জানে না, যখন প্রলয় আসে সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়। তাই প্রলয় আসার আগেই গান-না-জানা প্রান্তিক বাংলাদেশের মানুষকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রলয় এলে, সে বোবা আর অন্ধ না হয়ে,। ঝড়ঝাপটার উপযুক্ত মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। ১৬ ডিসেম্বরের সকাল মানে তাই প্রকৃতার্থেই ‘তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে। তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর