৫৪ বছর আগে মানুষের সেই ছোট পদক্ষেপ

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 09:34:37

আজ (২১ জুলাই) থেকে ঠিক চুয়ান্ন বছর আগে, আমেরিকান মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রেখেছিলেন। তারপর একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন: ‘মানুষের জন্য এটি একটি ছোট পদক্ষেপ, মানবজাতির জন্য একটি বিশাল লাফ।’ (‘That’s one small step for man, one giant leap for mankind.’)

তারপর মহাকাশের রহস্যঘন চাদর আস্তে আস্তে খুলে গিয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য মানবজাতির সেই প্রথম ও সফল মহাকাশ ভ্রমণ ক্রমশ বিশ্বে প্রত্যাশার আকার ধারণ করেছে। জুলাই ১৯৬৯ এবং ডিসেম্বর ১৯৭২ সালের মধ্যে, অ্যাপোলো প্রোগ্রাম ১২ জন মহাকাশচারীকে চন্দ্রপৃষ্ঠে রেখেছিল।

আর্মস্ট্রং যখন চাঁদে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তিনি পৃথিবীর দিকে ফিরে তাকালেন, একটি সুন্দর নীল গ্রহ এবং সমস্ত মানুষের বাসস্থান গভীর আবেগে তাকিয়ে দেখলেন। এটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি মহাকাশযান সভ্যতা হওয়ার দিকে মানবতার প্রথম দৈত্য লাফ এবং একটি পথ ধরে এমন একটি পদক্ষেপ, যা একদিন আমাদের মঙ্গল গ্রহে এবং তার বাইরে নিয়ে যাবে - এবং এটি শেষ পর্যন্ত একটি প্রজাতি হিসাবে আমাদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে বহুদূরগামী পথ দেখাবে। আমাদের সঠিক সংকল্প থাকলে, চন্দ্রপৃষ্ঠে মহাকাশচারীরা ভবিষ্যতের আরও অনেক অকল্পনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন।

ঐতিহাসিকভাবে, অ্যাপোলোর সাফল্য নিশ্চিত করেছিল, যা মহাকাশ অনুসন্ধান অব্যাহত রেখে গ্রহগুলোতে রোবোটিক অনুসন্ধানের পথ উন্মোচিত করে। ১৯৮১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মার্কিন মহাকাশ শাটল মিশনগুলিতে লো-আর্থ কক্ষপথে (LEO) স্থায়ী উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন নির্মাণ।

অবশেষে, নারী-পুরুষ এখন চাঁদে ফেরার পরিকল্পনা করছেন। NASA 2024 সালে আর্টেমিস II তে চারটি নভোচারীকে চাঁদের চারপাশে উড়ানোর জন্য এবং তারপর 2025 সালের শুরুর দিকে আর্টেমিস III-তে চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ করতে প্রস্তুত রয়েছে৷ আরও আর্টেমিস মিশন পরিকল্পনা করা হয়েছে যা অবশেষে সেখানে একটি স্থায়ী মানুষের উপস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে।

চীনও স্থির হয়ে বসে নেই, এবং তার প্রস্তাবিত অবতরণকে ২০৩৪ থেকে ‘২০৩০ সাল নাগাদ’ এগিয়ে নিয়ে এসেছে। এজেন্সির বাজেট নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে NASA-এর পরিকল্পনা বিলম্বিত হলে, চন্দ্রপৃষ্ঠে হাঁটার জন্য চীনা টাইকোনটরা পরবর্তী হতে পারে।

মহাকাশে অন্বেষণের পরবর্তী পর্যায়ের ফোকাস হল সম্পদের ব্যবহার, বিশেষ করে চন্দ্রের দক্ষিণ মেরুতে। এটি 'সিসলুনার স্পেস'-এ চাঁদের পৃষ্ঠে এবং চারপাশে একটি স্থায়ী উপস্থিতির দাবি করবে, একটি এলাকা যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইউএস সিসলুনার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কৌশলটি যুক্তি দেয় যে এটি মানুষের কার্যকলাপের একটি নতুন ক্ষেত্র, বাকি সৌরজগতের প্রবেশদ্বার এবং অংশীদারদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য একটি মূল্যবান অবস্থান

চন্দ্রযান-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে সফল ভাবে সফ্‌ট ল্যান্ডিং করতে পারলে এই অতিজটিল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সফল দেশ হিসাবে আমেরিকা, রাশিয়া, এবং চিনের পরে চতুর্থ নামটি হবে ভারত। সফ্‌ট ল্যান্ডিং-এর পরে চন্দ্রযান চাঁদ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এবং উপাত্ত সংগ্রহ করবে, যা মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিশা খুলে দেবে। মহাকাশবিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণায় ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীদের কাজ বিশ্বের দরবারে সমাদৃত।

বিশ্বের অগ্রসর দেশগুলোর চন্দ্রযানসমূহের সাফল্য যখন মহাকাশবিজ্ঞানীদের টুপিতে আর একটি নতুন পালক যোগ করছে, তখন বিজ্ঞানের আলোকিত অঙ্গনে পড়ছে কুসংস্কারের কিছু আবছা ছাড়া। যুক্তিবাদের চর্চাকে কোনও দিনই তেমন উৎসাহ জোগায়নি বিশ্বের গুরুবাদী সমাজ। যদিও বিজ্ঞানমনস্কতা যুক্তিবাদের নিয়ন্ত্রিত চর্চা বই কিছু নয় এবং বিজ্ঞানচর্চার আলোচনায় আমরা বিজ্ঞান সাধনাকে শুধুমাত্র এক ধরনের পেশা ভেবে নেওয়ার ভুলটা নিয়মিত করে থাকি, তথাপি বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্তিবাদের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামায় না অনেকেই। সমাজ প্রগতি ও সভ্যতার অগ্রগতিতে এসব বিঘ্ন বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশকেই পিছিয়ে রাখছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্ব পায় না। পাঠক্রমে আমরা বিজ্ঞানীদের জীবনী পড়াই— বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা করেছেন যাঁরা, সে রকম মানুষদের জীবনী পৌঁছয় না শিশু-কিশোরদের হাতে। প্রকৃত বিজ্ঞানিদের নাম কার্যত অপরিচিত থেকে যায়। যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানচেতনার যে দীপটি বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানিরা জ্বালিয়েছিলেন, তার আলোয় চেতনা আলোকিত করতে পারিনি আমরা তাই। বরং এশিয়া ও আফ্রিকার বহুদেশে সেই অকালে নিবে যাওয়া বিজ্ঞানচেতনার দীপশিখা শাসককে সাহায্য করেছে সমাজের অজ্ঞতাকে মূলধন করে রাষ্ট্রের হাত শক্তিশালী করতে, শোষণ ও নির্যাতনকে প্রলম্বিত করতে।

এজন্যই যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবী ও প্রকৃত বিজ্ঞানির অভাব উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি মৌলিক সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতা রূপে চিহ্নিত করা যায়। সামান্য যে কয়জন বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞানী আছেন, তারাও কুসংস্কার ও সামাজিক-রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করাতে সাহসী হন না। বরং তাঁরা ‘অরাজনৈতিক’ হয়ে থাকার ভঙ্গিটি বজায় রাখেন, অথবা কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ ভবিষ্যৎ যাতে বিঘ্নিত না হয়, তা আগে নিশ্চিত করে ছদ্ম প্রগতিশীল ভূমিকা নেন রাষ্ট্রকে না চটিয়ে এবং সীমিত ভাবে ‘প্রতিবাদী’ হয়ে।

সমকালেরপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত নোম চমস্কি বলেছিলেন, মানুষকে বশে রাখার বিচক্ষণ পন্থাটি হল, গ্রহণযোগ্য মতামতের কঠোর সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া, কিন্তু সেই সীমার ভিতরে ‘তীব্র বিতর্ক’ চালু রাখতে দেওয়া— এমনকি, সেই সীমার মধ্যে কঠোর সমালোচনায় উৎসাহ দেওয়া, বিরোধী মতামতের জায়গা করে দেওয়া। আমাদের তথাকথিত বিদ্বৎসমাজকে দেখলে বোঝা যায়, গণ্ডির মধ্যে মতপ্রকাশের পুতুলখেলা ঠিক কতখানি হাস্যকরভাবে করছেন তাঁরা।

উন্নয়নকারী দেশগুলোর যথার্থ বাস্তবতা হলো এই যে, সেসব দেশে লক্ষ লক্ষ শিশুর মৃত্যু হয় অপুষ্টিতে, মাত্র এক থালা ভাতের বিনিময়ে বিকিয়ে যায় নারীশরীর, অথচ সামাজিক বিধান ও ধর্মের পাণ্ডাদের তাণ্ডবে হাজার হাজার লিটার দুধ প্রাণহীন পাথরের টুকরায় ঢালা হতেই থাকে, সাম্প্রদায়িকতার নামে মানুষের রক্ত ঝরতেই থাকে। যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরু এবং তাঁদের চেলাদের কথাই দেশ ও মানুষের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণে জবরদখলী ভূমিকা পালন করে, সেসব দুর্ভাগা দেশে বিজ্ঞানকে পেশামাত্র হিসাবে দেখাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের মধ্যে প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে আলোকায়নের বিস্তারের গুরুত্ব এসব দেশে কেউই অনুভব করবেন না।

৫৪ বছর আগে মানুষের সেই ছোট পদক্ষেপ বিশ্ব বদলে দিলেও আমরা অতলেই পড়ে থাকছি এবং ক্ষেত্র বিশেষে আরও পিছিয়েই যাচ্ছি। নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রেখেছিলেন বলে বিশ্ব যখন আনন্দময় উদযাপনে ব্যস্ত, আমাদের তখন অন্ততপক্ষে সততার সঙ্গে আত্মসমালোচনায় লিপ্ত হয়ে সমাজ ও জীবনে অন্ধকার-বিস্তারী ভুলগুলো খুঁজে বের করা কর্তব্য হওয়া উচিত।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ (সিসিআরএস)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর