নির্বাচনী ইশতেহারে ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্য নির্মূলের অঙ্গীকার চাই

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এস এম নাজের হোসাইন | 2023-08-23 09:15:26

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জনদরদী সকল প্রার্থীরা এখন মাঠে-ময়দানে জনগণের জন্য কাজ করতে হাজারো প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আর গণমাধ্যম কর্মীরাও সে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারে ব্যস্ত। পত্রিকা ও টেলিভিশনের পর্দায় নির্বাচনী খবরা-খবর এবং নির্বাচন উপলক্ষে যেমন পত্রিকাগুলো বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করছে, তেমনি টেলিভিশনগুলিও নতুন নতুন অনুষ্ঠান প্রচার করছেন। কিন্তু নাগরিকদের নিত্যদিনের সমস্যা সমাধানে তাৎক্ষণিক প্রতিকার ভোটের পরে আর পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে সংশয় থেকেই যায়। নাগরিক জীবনে এখন সবচেয়ে আলোচিত ও কঠিন সমস্যা হিসেবে আর্বিভুত সমস্যার নাম এখন ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্য এবং নামে-বেনামে বিভিন্ন ফিস আদায়ের যন্ত্রণা।

চট্টগ্রামে ২০১৬ সালে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে ভর্তি বানিজ্যে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমুহের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন ও জেলা শিক্ষা অফিসকে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দানে সফল হলেও বছর যেতে না যেতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন বছরে ভর্তিতে ঘুরে-ফিরে আবারও সেই ভর্তি বানিজ্য ও অতিরিক্ত ফি আদায়ের মহড়া, কেজি ও নার্সারী শ্রেণীতে ভর্তিতে লটারীতে নামে গোপনে লটারী দেখিয়ে পছন্দসই শির্ক্ষার্থী ভর্তি করানো, এসএসসি ও এইসএসসিতে শ্রেণী শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে টেস্ট (নির্বাচনী) পরীক্ষায় অকৃতকার্য করাসহ নানা ভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের মহোৎসব আবারও শুরু হয়েছে। নতুন বছরের শুরুতে ভর্তির মৌসুম শুরু হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অজুহাতে জেলা প্রশাসন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের নজরদারি ও তদারকির অভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আবারও নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারীকে আত্মহনণে বাধ্য করার পেছনে মূল কারণ ছিলো ভর্তি বানিজ্য ও অভিভাবকদের সাথে স্কুল কর্তৃপক্ষের অনিয়মিত সংলাপ। ক্যাব চট্টগ্রাম ২০১৬ সাল থেকে চট্টগ্রামে ভর্তি বানিজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকালে একাধিকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের সাথে মতবিনিময় সভায় স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে অভিভাবকদের সক্রিয় ও নিয়মিত মতবিনিয়ের ওপর অধিকগুরুত্ব প্রদান, নিয়মিত অভিভাবক সভা আয়োজন, ভর্তি বানিজ্য, অতিরিক্ত ফিস, উন্নয়ন ফিস আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম রোধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের নিয়মিত তদারকি ও নজরদারি না করে “অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে” এ ধরনের বক্তব্যের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি ভর্তি নীতিমালা ও নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ফিস আদায়, কোচিং বানিজ্যসহ নানা অনিয়মে জড়িত হলেও শিক্ষা প্রশাসন, মন্ত্রণালয় আজ পর্যন্ত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হয়নি।

চট্টগ্রামে ২০১৭ সালে ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিল করলে স্কুল কর্তৃপক্ষ মহামান্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তা স্থগিত করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আজ পর্যন্ত এ রিটের বিষয়ে কার্যকর কিছুই করতে পারেনি। অধিকন্তু এ প্রতিষ্ঠানগুলো দিব্যি একাডেমিক স্বীকৃতি ছাড়াও এখন নতুন নতুন বিভাগ সংযোজন ও পাঠদানের অনুমতি নিচ্ছেন। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়মের কারখানায় পরিণত হয়েছে। যার সর্বশেষ বলি হলো অরিত্রি অধিকারী। যেখানে শিক্ষার চেয়ে বানিজ্যই মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এগুলো তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্তারা দিবাস্বপ্নে বিভোর।

সে কারণে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলে চালের আড়ত, মাছের আড়ত, রিয়েলস্টেট, গার্মেন্টস ও অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও খুলে শিক্ষা ব্যবসায় নেমে পড়েছেন একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। আর তারা এসব শিক্ষা দোকান খুলে ভর্তিতে সরকারি নীতিমালাকে তোয়াক্কা না করে গলাকাটা ফিস আদায়সহ নানা নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায় করছে। আবার মধ্য সাময়িক পরীক্ষায় অনুপস্থিতি জরিমানা, পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহ করার সময় বিভিন্ন ফিস আদায় করছে। টিসি প্রদানে এক বছরের টিউশন ফিস আদায়সহ নামে-বেনামে  বিভিন্ন ফিস আদায়ে জড়িত। সেকারণে শিক্ষা এখন মানুষের মৌলিক অধিকারের চেয়ে অধিক ব্যয় নির্ভর পণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন এসব অনিয়ম দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন। এছাড়াও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের বেতন ও ফিসের উপর নির্ভর করে পরিচালনা করলেও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে অকার্যকর যোগাযোগ, অনিয়মিত অভিভাবক সভা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে সাক্ষাত দুরহ ব্যাপার। অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিচালনা পর্ষদে অভিভাবকদের সত্যিকারের অংশগ্রহণ যাচাই না করে শিক্ষা বোর্ড পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন করছে যার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অভিভাবকদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে না। অভিভাবকদের নামে যারা যুক্ত হচ্ছেন তারাও ভর্তি বানিজ্যসহ নানা অপকর্মে সহজে জড়িয়ে পড়ছেন।

তাই যেহেতু সংসদ সদস্যরা সরকারের আইন ও নীতি প্রণয়ণ ও একই সাথে স্থানীয় সংসদীয় এলাকার প্রশাসনিক মূল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে থাকেন সেকারণে ভর্তিতে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী নামে বেনামে অতিরক্তি ফিস আদায় বন্ধ করা, প্রাথমিক স্তরে ভর্তিতে লটারী হলে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও অভিভাবকদের উপস্থিতিতে লটারী অনুষ্ঠান, এসএসসি ও এইসএসসিতে শ্রেণী শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে টেস্ট (নির্বাচনী) পরীক্ষায় অকৃতকার্য করে নানাভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের ইশতেহারে ভর্তি ও কোচিং বানিজ্য নিমূলে অঙ্গীকার যুক্ত হওয়া জরুরি। কারণ ভর্তি ও কোচিং বানিজ্য এখন সাধারণ মানুষের জীবনে অত্যাবশ্যকীয় নাগরিক সমস্যা হিসেবে আর্বিভুত হয়েছে। সেকারণে এ বিষয়ে পরিষ্কার ঘোষণা না আসলে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ ও সরকার এ গুরুত্বপুর্ন নাগরিক সমস্যায় তাঁরা কী করবেন সেটা পরিস্কার না হলে নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগে প্রার্থীদের প্রতি সুবিচারে যুক্তিযুক্ত ও ন্যায় সঙ্গত হবে না।

এস এম নাজের হোসাইন: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর