ডেঙ্গুর গণসংক্রমণভীতি ও চিকিৎসার গতিপ্রকৃতি

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 05:51:03

একসময় বষার্কালকে ডেঙ্গু রোগের আড়ৎ বলা হলেও এখন সারা বছর ডেঙ্গুর মৌসুম। বছরজুড়ে বংশ বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও আশ্রয়স্থল সহজে খুঁজে পাবার নিশ্চয়তা পেয়ে ডেঙ্গু বারোমাসী রোগের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এডিস মশা এই রোগটির বাহক হয়ে পানির মধ্যে ডিমপেড়ে ও ছানা ফুটিয়ে মানুষের বসতবাড়ি, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, রাস্তাঘাট, যানবাহন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট সবকিছুতেই অতি সহজে তাদের বিচরণ ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছে।

এডিসের দাপট এখন সব জায়গায়। দেশের ৬৪ জেলার সবগুলোতে এরা সংক্রমণ ছড়িয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। এরা মরণঘাতী। দেশে এদের হুলের বিষে তথা সংক্রমণে দিন দিন মৃত্যুর রেকর্ড বেড়ে চলেছে। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী জনস্বাস্থ্যের জন্য ডেঙ্গু একটি বড় হুমকি হিসেবে আবিভূর্ত হয়েছে। তাই মানুষ খুব উদ্বিগ্ন হয়ে এক অজানা ভীতির মধ্যে বাস করছে।

অপরদিকে ডেঙ্গু সংক্রমণ ক্রমাগত বিস্তার লাভ করায় ডেঙ্গু চিকিৎসা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। সারা দেশের মুমূর্ষু ডেঙ্গু রোগীরা উন্নত চিকিৎসা নিয়ে জীবন বাঁচানোর আশায় রাজধানী ঢাকায় ছুটে আসছে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বেড খালি নেই। বারান্দা, করিডোর, সিঁড়ি ও মেঝেতে শুয়ে রেখেও চিকিৎসার স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক রোগী হন্যে হয়ে ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে সারা ঢাকা শহরে। এতে মৃত্যুর সংখা আরো বেড়ে যাচ্ছে।

গত ১৭ জুলাই জেলা শহর থেকে ৪৫ বছর বয়সী এক রোগী ৩১ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারী হাসপাতালে ওয়ার্ডে ভর্তির সুযোগ পেলেও পরদিন তার প্লাটিলেট ১১ হাজারে নেমে আসে। কোন ডাক্তারের অধীনে তাঁকে ভর্তি করানো হয়নি বিধায় তার চিকিৎসা হয়নি, আইসিইউ—তে নেয়া হয়নি। ভর্তিরত অবস্থায় মাত্র একদিনের ব্যবধানে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে তারপর সেই মৃত ব্যক্তিকে আইসিইউ—তে ভর্তি করা হয়েছে বলে রোগীর আত্মীয়রা গণমাধ্যমের সামনে অভিযোগ কার কান্নাকাটি করেছেন! রাজধানীতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মারা যাওয়া রোগীর সংখ্যা বেশি। জুলাই ২৩, ২০২৩ একদিনে ২,২৯২ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ০৯জন মারা গেছেন। জুলাই ২৪, ২০২৩ সকাল পর্যন্ত মোট মারা গেছেন ১৫৭ জন।

এছাড়া ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্যে গড়মিল নিয়ে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। রাজধানীর মুগদা এলাকার আরেকটি বেসরকারী হাসপাতালে গত কয়েকদিনে ৩০ জন ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুবরণ করলেও হিসেবের তালিকায় ২৫ জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বলে রোগীর আত্মীয়—স্বজনরা অভিযোগ করেছেন। মাত্রাতিরিক্ত রোগীর স্থান সংকুলান না হওয়া ও চিকিৎসা নিয়ে ডাক্তারগণ হিমশিম খাচ্ছেন অথচ, মন্ত্রীরা হাসপাতাল কতৃর্পক্ষের উপর দায় চাপাচ্ছেন ও চিকিৎসকদেরকে সুচিকিৎসা না দেবার অভিযোগ এনে অনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

এমন নাজুক অবস্থায় দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে মানুষ সংক্রমিত হতে থাকলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের অধিকার আদায়ে রাজপথের একপার্শ্ব দখল করে সোচ্চার হওয়া শুরু করলে সরকারী কতৃর্পক্ষ সেই আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো কাজ শুরু করেছে। সরকারী দলও মানুষের বিপদে সেবা দেবার কথা ভুলে গিয়ে বিরোধীদের পিছু পিছু রাস্তায় নেমে অবিবেচকের মতো বাকী রাস্তাঘাট দখল করে উল্লম্ফন শুরু করে দিয়েছে। এসময় বিপদের সময়ে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিএনপি—র পিছু পিছু হাঁটা সরকারের জন্য কি খুব জরুরী? এ্যম্বুলেন্সে ডেঙ্গু রোগী নিয়ে রাস্তার জ্যামে পড়ে স্বজনদেরকে কান্নাকাটি করতে দেখা গেছে।

জুলাইয়ের গত তিন সপ্তাহ যাবৎ ডেঙ্গু সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বেশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। উত্তরের তুলনায় দক্ষিণ ঢাকা শহরে ঘিঞ্জি, নিচু ও অপরিচ্ছন্ন এলকা বেশি হওয়ার সংক্রমণের হার বেশি। এক হিসেবে দেখা গেছে মানিকনগর, শাহজাহানপুর, গেন্ডারিয়া, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীর চর প্রভৃতি এলাকা থেকে হাসপাতালে আসা রোগী ভর্তির হার বেশি। এসব এলাকা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত। শিশু, বয়স্ক ছাড়াও ১৮—৪০ বছরের রোগীরা এবছর বেশি ভর্তি হচ্ছেন।

আমাদের দেশে প্রতিবছর ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে চলেছে। এদেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৭৯ জন মারা গিয়েছিলেন এবং ২০২২ সালে ২৮১ জন মারা যান। এবছর জুলাই মাসের মাঝামাঝি না পেরুতেই ১৭৬ জন মারা গেছেন। এবারে নতুন ভেরিয়েন্টের কারণে ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রবণতা খুব বেশি। কারণ ডেঙ্গুর এই নতুন ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকার মাধ্যমে চিকিৎসাব্যবস্থা এখনও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি।

ডেঙ্গু একটি হাজার বছর আগের প্রাচীন রোগ। চীনে ৯৯২ খৃষ্টাব্দে এই রোগটি শনাক্ত করা হয়েছিল বলে তাদের প্রাচীন নথিপত্রে জানা যায়। এই জ্বরকে শনাক্ত ও ডেঙ্গুজ্বর বলে নামকরণ করা হয় ১৭৭৯ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব মেডিসিন বলেছে, আঠারো ও উনিশ শতকের দিকে বিশ্বব্যাপী জাহাজ শিল্পের প্রসার ও সমুদ্র বন্দরের ব্যবহার বাড়তে থাকলে ডেঙ্গুর জীবানুবাহী ভেক্টর ও এডিস ইজিপ্টি ছড়ানোর মতো আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়। তবে ১৭৭৯ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগ ধরা পড়লেও তখন এর এতটা ভয়াবহাতা ছিল না বিধায় চিকিৎসা নিয়ে মাথা ঘামানো হয়নি। পরবতীর্তে গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও ভয়াবহতা বিবেচনায় এই রোগ প্রতিরোধে টিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। সেসব টিকা ২/১ ধরণের লক্ষণে কার্যকর ছিল। বর্তমান ডেঙ্গুর চারটি ভেরিয়েন্ট সক্রিয় রয়েছে। এসব ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে আমাদের দেশজ ডেঙ্গু চিকিৎসার গাইডলাইন হালনাগাদ নয়।

আমাদের দেশে ডেঙ্গুর বর্তমান ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ওষুধের সঠিক কার্যকারীতা গবেষকদের নিকট জানা নেই। এজন্য এখনও গবেষণা চলছে। তাই টিকা তৈরির ক্ষেত্রে ঝামেলা রয়েছে। এছাড়া পরিবেশের ভিন্নতা ভেদে ডেঙ্গু ভেরিয়েন্টের ভিন্নতা লক্ষণীয় হওয়ায় আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নতুনভাবে টিকা তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।

ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিসকে বলা হয় গৃহপালিত মশা। এ্যনোফিলিস, কিউলেক্স মশা ঝোঁপ—ঝাড় জঙ্গলে থাকলেও এডিসরা মানুষের কাছে ঘরে, বসতবাড়ির আশেপাশে বাস করতে পছন্দ করে। বাড়ির পাশের নালা, ডোবা, পানির ট্যাংক, মসজিদের খোলা চৌবাচ্চা, অব্যবহৃত মাছের অ্যাকুরিয়াম, ছাদবাগানে, বারান্দায় বা ঘরের ভেতর পাত্রে বা ফুলের টবে, গাড়ির টায়ারে, ডাবের খোসায়, খুকুর পরিত্যক্ত খেলনায় তিন—চারদিনের বেশি জমে থাকা পানিতে সুযোগ পেলেই এডিস মশা ডিম পাড়ে। আমাদের দেশে ছাদবাগান তৈরি করে অনেকে অযত্ন, অবহেলায় প্লাষ্টিক টবসহ বিভিন্ন পাত্র—সামগ্রী ফেলে রেখেছেন। শুধু বষার্কালে নয়— পানির পাইপে লিক থাকা, অসচেতনতা ও বিভিন্ন কারণে সারাবছর জুড়ে সেগুলোতে পানি জমে থাকার সুযোগ পায়। সকল সৌখিন ছাবাগান মালিককে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে অতি সচেতন হতে হবে।

তবে বর্তমানে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ডেঙ্গু সংক্রমণের সবচেয়ে বড় কারণ হলো, সারা বছর জুড়ে নির্মাণ কাজ চালানো। নির্মাণ কাজে পানির ব্যবহার বেশি। খোলা ট্যাংক, ড্রাম, বালতি, পাইপ ইত্যাদিতে দীর্ঘদিন পানি জমিয়ে রেখে নির্মাণ কাজ চালানো হয়। মজার ব্যাপার হলো এতদিন বলা হতো— এডিস মশা পরিস্কার পানিতে ডিম পাড়ে। এখন জানা গেছে ওরা পরিস্কার, ময়লা, নোনা, ঠান্ডা, গরম সব পানিতেই ডিম পাড়ে। উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে সেই ডিম থেকে বাচ্চা বের হতে মাসের পর মাস দেরী হতে পারে।

অথার্ৎ, এডিস মশার ডিম যে কোন পানিতে বহুদিন বা ছয়মাস পরেও বেঁচে থেকে সুবিধা পেলে লাভার্ ফুটে বের হয়ে যায়! তাই কোথাও অহেতুক খোলা পানি জমিয়ে রাখা বিপজ্জনক। কিন্তু সেই ভয়ংকর কাজটি লালন করে চলেছে আমাদের দেশে সারা বছরজুড়ে চলতে থাকা নির্মাণকাজে জড়িত লোকেরা। তাদের নির্মাণ স্পটে হাজার হাজার খোলা চৌবাচ্চা, ড্রাম, ট্যাংক ইত্যাদি রয়েছে। যার ফলশ্রম্নতিতে বড় বড় শহরে ডেঙ্গু মশার সংক্রমণ বেশি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই মুহূর্তে আমাদের দেশে ডেঙ্গু ‘এন্ডেমিক’ বা স্থানীয় চরিত্র ধারণ করে জনমনে ভয়বহতা ছড়াচ্ছে। তবে সংক্রমণ ও মৃত্যুর এই ঊর্ধ্বগতির হার চলতে থাকলে অচিরেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘প্যান্ডেমিক’ বা সমগ্র দেশে বড় মহামারি রূপ নেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সামনে তেমন কোন পরিস্থিতি দেখা দিলে হাসপাতালগুলোতে করোনার মতো বিষেশ শয্যাব্যবস্থা তৈরির মাধ্যমে ডেঙ্গু মোকাবেলায় বিষেশায়িত চিকিৎসা সেবা চালু করে জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু, বয়স্ক, কিডনি—হার্ট—লিভারের রোগীকে ঘরে বসিয়ে রাখলে ‘শকড্ সিনড্রোম’ সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। এটাতে অঘটন ঘটতে পারে।

ফিবছর ডেঙ্গুর ভয়াবহ সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সবাইকে নড়েচড়ে উঠার সময় এখন। দেশের গ্রামাঞ্চলের কম্যুনিটি হাসপাতালগুলো কাজের অভাবে বেশিরভাগ সময় দরজা বন্ধ করে রাখে। রাজধানীকেন্দ্রিক চিকিৎসাসেবাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে এসব কম্যুনিটি হাসপাতালের কর্মীদেরকে মটিভেশনাল কর্মসূচি নিয়ে মানুষকে ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য ডেঙ্গু যেহেতু একটি বড় হুমকি সেহেতু দ্রুত ডেঙ্গুর প্রতিশেধক বা টিকা আবিষ্কারের জন্য তৎপর হতে হবে।

করোনার মতো নিজস্ব অথার্য়নে টিকা ক্রয় করে সব মানুষকে দ্রুত ডেঙ্গুর টিকার আওতায় আনতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু ডেঙ্গুর কার্যকরী টিকা যেহেতু হঠাৎ বিদেশ থেকে ক্রয় করা সম্ভব নয় তাই পরমুখাপেক্ষী হয়ে সময় ক্ষেপণ না করে অচিরেই গবেষণা কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের নিজস্ব অথার্য়নে ও দেশীয় স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় দেশজ যথার্থ তথ্যভিত্তিক (ভ্যালিড ডাটা) বহুমুখী গবেষণা চালানো ছাড়া বড় কোন বিকল্প নেই।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর