ডেঙ্গুতে রেকর্ড মৃত্যু: মশা নিয়ন্ত্রণে ম্যাজিস্ট্রেট!

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 21:59:49

এ বছর ডেঙ্গুর পিক সিজন না পেরুতেই দেশের ইতিহাসে এর কারণে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড তৈরি হয়েছে ০৩ আগস্ট, ২০২৩। এই দিনে এবছরের ডেঙ্গুমৃত্যু সংখ্যা ২৮৪ জনে পৌঁছেছে। এদিকে আগস্টের ১০ তারিখ সকাল পযর্ন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৫০ জন ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ চলতে থাকলেও রোগের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমার লক্ষণ নেই। রেকর্ড ভেঙ্গে আগামী দিনের জন্য বিরাট অশনি সংকেত নিয়ে এসেছে ডেঙ্গুর গণসংক্রমণভীতি। সারাদেশে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তবে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি কপোর্রেশনের চিন্তার অন্ত নেই। তারা এক অপরের সমালোচনা করতে পিছ্পা হচ্ছেন না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ‘এখন ডেঙ্গুর মহামারি চলছে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর হলো ডেঙ্গুর মৌসুম। তাই এখন থেকে মশক নিধন কার্যক্রম সত্যিকার অর্থে চালাতে হবে। নইলে মহামারী ভয়াবহ রূপ নেবে। ’প্রতিটি ঘরের ভিতরে, আঙ্গিনায় ও ভবনের ছাদের বাগানের মশা বাসিন্দাদের নিজ উদ্যোগে মারার ব্যবস্থা করতে হবে। আর ঘরের বাইরের মশা সিটি কর্পোরেশনকে মারতে হবে।

কেউ কেউ বলছেন, ‘কিন্তু সিটি কর্পোরেশন শুধুমাত্র ছবক দেয়, মশা মারে না। আগে মশা মারার কার্যক্রম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। তখন কার্যকরভাবে মশা মারা হতো। এখন দায়িত্ব পড়েছে সিটি কর্পোরেশনের উপর। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন মশা মারতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ’আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে মশা মারার কার্যক্রম দেওয়া উচিত বলে কীটতত্ত্ববিদরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এমন পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুরির মাঝে সামনের দিকে এক ভয়ংকর দিনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

কারণ, এমনিতেই ঢাকা পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ৪র্থ স্থান দখল করে আছে। এবারের ডেঙ্গু মাহামারির বাস্তবতা সকল গোপণীয়তার বেড়াজাল ছিন্ন করে বেসরকারিভাবে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়ে কখন ঘোষণা হিসেবে সামনে চলে আসবে তখন হয়তো আর পরস্পরকে দোষ দেবার ফুরসৎ থাকবে না।

এরই মাঝে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোর্রেশন থেকে মোট ভৌগলিক এলাকাকে ১০টি জোনে ভাগ করে ১০ জন নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে। তাঁদের মূল কাজ, ডেঙ্গুর বংশবৃদ্ধি রোধে গৃহীত নিয়ম অমান্যকারী ও অবহেলাকারীদেরকে জরিমানা করা। নয় নম্বর অঞ্চলে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাজলার পাড় এলাকায় ৪০টি বাসাবাড়ি ও স্থাপনায় অভিযান পরিচালনা করেন এবং একটি স্থাপনায় মশার লার্ভা পাওয়ায় তিন হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন।

ডিএসসিসির ধানমন্ডি, হাতিরপুল, তিলপা পাড়া, চকবাজার, উর্দু রোড, কোর্ট হাউস, তাঁতি বাজার, শাঁখারি বাজার, জুরাইন, কদমতলী, গ্রিন মডেল টাউন, ডেমরা ও কাজলার পাড় এলাকায় ০৩ আগস্ট, ২০২৩ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব অভিযান পরিচালনা করা হয়। এই অভিযানে সর্বমোট ৪৫৭টি বাসাবাড়ি ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়। এ সময় ৯টি বাসাবাড়ি ও নির্মাণাধীন ভবনে মশার লার্ভা পাওয়ায় ৯ মামলায় সর্বমোট ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।

এছাড়া প্রতিটি জেলায় ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এডিসের বিচরণ। চাঁদপুর জেলায় উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। শুধু জুলাই মাসেই সেখানে ৮১১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আগস্ট ০২ তারিখে চাঁদপুরে নতুন করে আরও ৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। জেলা সিভিল সার্জনের দাবি, ঢাকা থেকে লঞ্চযোগে এডিস মশা চাঁদপুরে আসতে পারে। কিংবা লঞ্চে এডিস মশা থাকায় অনেক যাত্রী আক্রান্ত হচ্ছেন। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোশনা বিবি নামক ১১ মাসের বাচ্চা ও চট্টগ্রামে ৩ মাসের শিশু ডেঙ্গুতে ‘শক সিনডো্রমে’আক্রান্ত হয়েছে। যশোরে হাসপাতগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসার পযার্প্ত ব্যবস্থা নেই। সেখানে কোন রোগীর প্লেটিলেট কমে গেলে আতঙ্কে দ্রুত ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। গরীব রোগীদের জন্য এটা চরম ভীতিকর। কারণ তারা অথার্ভাবে দ্রুত ঢাকায় যেতে অপারগ। মারাত্মক অসুস্থ রোগী ও তাদের আত্মীয়রা কোনমতে ঢাকায় এসে হাসপাতালে ঠাঁই না পেয়ে দ্বিগ্বিদিক ছুটাছুটি করে সময় পার করে রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

অনেকের ঢাকায় আত্মীয়—স্বজন আছেন। কিন্তু তারা নিজেদের ব্যস্ততা ও পরিবারের নিরাপত্তার কারণে বাইরে থেকে আসা ডেঙ্গু রোগীদের সেবা—সহায়তা কিছুই দিতে পারছেন না। তাই বাইরের রোগী ও তাদের স্বজনেরা ঢাকায় এসে সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে রোগীর সাথে বারান্দা, মেঝে, করেডোরে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকছেন। সেখানে মশার কামড়ে তারাও সংক্রমিত হবার ভয়ে ভীত।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন মশা মারুন, মানুষকে বাঁচান। চিহ্নিত শত্রু মশা। তাকে মারতে তো সমস্যা হওয়ার কথা না। মশা নিধনে গতানুগতিক কাজ করা হচ্ছে। এতে মশা নিধন হবে না। কন্ট্রোল রুম রাখতে হবে। তিনি বলেন, মশা মারা ও ডেঙ্গুর চিকিৎসা দুটিই আমাদের জানা আছে। হাসপাতালগুলোতে মশারির নেট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। মশা মারতে না পারলে অচিরেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কার্যকরভাবে মশা না মারার কারণে একদিনে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়তি চাপ পড়ছে চিকিৎসকদের উপরে। ইতিমধ্যে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তারপরও ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীরা বিরামহীনভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ডাক্তারদের বিশ্রাম নেওয়ার কোন সুযোগ নেই।

এই মুহূর্তে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মূল কাজ হলো মানুষকে সতর্ক করা ও আক্রান্তদের দ্রুত চিকিৎসা সেবা দেয়া। গণমাধ্যমের মটিভেশনাল কর্মসূচি মানুষ জানে। তবুও অবহেলা করে এডিসকে বংশ বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে একশ্রেণির উদাসীন মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, সকল মসজিদের ইমামরা যেন প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের খুতবার সময় মশা মারার ও ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেন।

তবে আজকাল মানুষ শুক্রবারে মসজিদে কোন বয়ান শুনতে যেতে চায় না। তারা বলে, এসব বয়ান ইউটিউবে দিনরাত শোনা যায়। বেশিরভাগ মুসুল্লি খুৎবা শুরু হবার পর মসজিদে ঢোকে এবং দুই রাকায়াত ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর সাথে সাথে দ্রুত বের হয়ে বাড়ি চলে যেতে পছন্দ করে। শহরের কমবয়সী মুসুল্লিদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা শতকরা নব্বইভাগের উপরে।

নিপসনের একজন কীটতত্ত্ববিদ বলেছেন, ‘আসলে মূল জায়গায় আঘাত করা হচ্ছে না, অর্থাৎ মশা মারা হচ্ছে না। যে পরিমাণ ওষুধ দিয়ে মশা মারা প্রয়োজন তা করা হচ্ছে না। এডিস মশার লার্ভাও ধ্বংস করা হচ্ছে না। এ কারণে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে।’ মশা মারার কার্যক্রমে পুরো কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা সহজ নয়।

এর বড় কারণ হলো, আজকাল রাজনৈতিক বিভাজন তুঙ্গে বিরাজ করে সামাজিক বিভেদ তৈরি করা হয়েছে। মানুষের নেতারা অনেকেই মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। পারস্পরিক হিংসা, হানাহানি, মামলা—মোকদ্দমার ফলে দেশের গ্রাম—শহরের প্রায় সকল কম্যুনিটিতে সামাজিক বিশৃংখলা ও অশান্তি বিরাজ করায় সেখানে কেউ নিজ এলাকার নেতাদের কথা শুনতে চায় না। তারা মনে করে গণবিরোধী সমাজ ও পুলিশী রাষ্ট্রের নিপীড়নের মধ্যে সরকারি মোটিভেশন মেনে চলা আমার কাজ নয়। সরকারও সারা দেশ থেকে মানুষ ডেকে এনে ডেঙ্গুর হটস্পট ঢাকায় মিছিল করাচ্ছে। এরা এডিসের জীবাণু সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। আজকাল কিছু মানুষ মনে করে আমরা কোনরকমে ‘মরে বেঁচে আছি।’এডিস মশা নিধন করা ব্যক্তিগত কাজ নয়। ‘এরপর ম্যাজিস্ট্রেট এসে জরিমানা করলে কিছু আসে যায় না।’

আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধরণের মানসিকতা দুই বছর আগেও ছিল না। এই প্রবণতা তৈরি হওয়াটা বেশ উদ্বেগের বিষয়। করোনার সময় উচ্চ আয়ের ভোগবাদী সমাজের মানুষেরা অবহেলায় অযত্নে নিজেদেরকে করোনার শিকার হতে সুযোগ করে দেয়ায় সেসব উন্নত দেশে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল। সেসময় আমরা বিধি—নিশেধ মেনে চলায় করোনায় প্রাণহানি কম হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সেভাবে এগিয়ে আসছে না। এমনকি বেসরকারি মটিভেশনাল কর্মসূচির ব্যাপারেও মানুষ বেশ উদাসীন।

সামাজিক সচেতনতার পক্ষে সরকারি শিথিলতা ও এর বিরুদ্ধে জনগণ বেপরোয়া হয়ে উঠলে এটাকেই বলা হয় নেতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন। বিশেষ করে গত দুই মাস ধরে ক্রমাগত ডেঙ্গুসংক্রমণ বেড়ে যাবার পর জনস্বাস্থ্যের দারুণ সংকট তৈরি হয়েছে। সেটাকে সরকারিভাবে স্বীকার না করে জাতীয়ভাবে গুরুত্বহীন মনে করায় আরো জীবন—সংকট প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এতদিন পর মেয়র বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে আরো ম্যাজিস্ট্রেট দরকার। এডিস মশার বংশ বিস্তারে অবহেলা করে কথা না শুনলে আরো জরিমানা করা হবে। চিকিৎসকরা বলছেন, মশা নিধন না করলে এত বেশি রোগীকে সামাল দেয়া খুব কঠিন। কীটতত্ত্ববিদ বলেছেন, এই পরিমাণ ওষুধ দিয়ে মশা মারা, এডিস মশার লার্ভাও ধ্বংস করা হচ্ছে না। এসব বয়ান শুনে ডেঙ্গু রোগীরা বলছেন, মশা নিধনে এরপর আর কে কে কামান দাগতে আসবে? আমরা দারুণ অসহায় অবস্থার মধ্যে জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছি।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর