রাজনীতিতে যখন বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করে

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 12:48:13

ভারতীয় ‘হিন্দু’ রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রায়-একা লড়াই করে ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য জিন্নাহ পাকিস্তান ছিনিয়ে এনেছেন, এ ব্যাপারে অধিকাংশ উগ্র পাকিস্তানিই সন্দেহশূন্য। তাদের চোখে জিন্নাহর ইমেজ ‘নব্য সালাউদ্দিন আইয়ুবি'র মতো ক্রুসেডারের। কিন্তু আজকের পাকিস্তান যে এক জটিল সংকটাবর্তে নিক্ষিপ্ত, তার মুখ্য কারণ কারো অজানা নয়। পাকিস্তানের যে অবক্ষয়, তার অন্যতম কারণ রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ। পাকিস্তানের সদ্য-প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ক্ষমতা হারানোর কারণ লুকোনো রয়েছে এতে।

গণমাধ্যমে একটি কূটনৈতিক ‘সাইফার’ বার্তা প্রকাশ পেয়েছে। খোদ আমেরিকার একটি সংবাদ সংস্থার রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, গত বছর ওয়াশিংটনের অঙ্গুলি হেলনেই ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল ইমরানকে। তার প্রমাণ রয়েছে ওই গোপন বার্তা ‘সাইফার’-এ।

পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে হারের পরে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান। তিনি সে সময়ে দাবি করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে থাকতেই তিনি সাইফার-এর কথা জানতে পেরেছিলেন। এ-ও দাবি করেছিলেন, তাঁকে সরানোর জন্য আমেরিকাই ষড়যন্ত্র করেছিল। পাক সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর সাহায্যে তাঁকে সরিয়েছিল আমেরিকা।

তিনি এ-ও দাবি করতে থাকেন যে, তাঁর উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও সেনাবাহিনীকে নিয়ে চক্রান্ত করে তাঁকে পদ থেকে সরিয়েছে আমেরিকা। বর্তমানে তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলবন্দি ইমরান। তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। অন্তত পাঁচ বছর রাজনীতি থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে ইসালামাবাদ হাই কোর্ট। ইমরান তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, নির্বাচনে তিনি যাতে অংশ নিতে না পারেন, তার জন্যই এই ‘ব্যবস্থা’ করা হয়েছে আমেরিকার ইঙ্গিতে।

বুধবার (৯ আগস্ট) একটি আমেরিকান সংবাদ সংস্থার রিপোর্টে উঠে এসেছে ‘ষড়যন্ত্র’ প্রসঙ্গ। ওই রিপোর্টে ‘সাইফার’-এ থাকা আমেরিকায় পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত আসাদ মাজিদ ও আমেরিকার ‘ব্যুরো অব সাউথ অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স’-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু-র কথোকথন প্রকাশ করা হয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইমরানের মস্কো সফরের দু’সপ্তাহ পরে ওই বৈঠক হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ২৪ ফেব্রুয়ারিই ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেছিল রাশিয়া। মস্কোর ইউক্রেন-আক্রমণ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন ইমরান। শোনা যায়, এই দুই ঘটনায় ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়েছিল আমেরিকা। পাকিস্তানের উদ্দেশে গোপনে বার্তা গিয়েছিল, যেন তেন প্রকারে ইমরানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। লু ও মাজিদের বৈঠকে আমেরিকান কর্তা বলেছিলেন, ‘‘ইমরানের রাশিয়া সফর ও ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানের একরোখা নিরপেক্ষ অবস্থান দেখে আমেরিকা ও ইউরোপ খুবই চিন্তিত।’’

সূত্রের খবর, লু-র সঙ্গে হওয়া কথাবার্তা ‘সাইফার’-এ করে ইসলামাবাদে পাঠিয়েছিলেন মাজিদই। সেটি ফাঁস হয়ে যায়। ইমরানের মুখেই প্রথম সাইফার-এর কথা শোনা গিয়েছিল। অভিযোগ, লু মাজিদকে বলেছিলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর (ইমরান) বিরুদ্ধে যদি একটা অনাস্থা ভোট সফল করা যায়, আমার মনে হয় ওয়াশিংটন সব মাফ করে দেবে। কারণ
রাশিয়া সফরের সিদ্ধান্ত উনিই নিয়েছিলেন। কিন্তু এটা না হলে ভবিষ্যতে একসঙ্গে হাঁটা কঠিন হবে।’’

আমেরিকান সংবাদ সংস্থাটির রিপোর্টে লেখা হয়েছে, এর এক মাস পরেই পাক পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোট হয়েছিল। যার জেরে ক্ষমতা থেকে সরতে হয়েছিল ইমরান খানকে। আমেরিকা কেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুূযোগ পেলো? তার অনেকগুলো কারণ আছে। তবে প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক বিভাজন ও দলগুলোর মধ্যকার তীব্র বিভেদ, যার ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগ পায় আমেরিকা।

রাজনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও সুসম্পর্ক থাকা অতীব জরুরি। গণতন্ত্রের ধারাবাহিক বিস্তারের জন্যেও দলগুলোকে চালিকা শক্তির ভূমিকা পালন করতে হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি বিভেদ ও আত্মকলহে আকীর্ণ থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের যেমন বিপদ হয়, তেমনি রাজনীতিতে বাইরের হস্তক্ষেপের সুযোগও সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান যার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

কোনো দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি নানা মতপার্থক্যের পরেও ঐক্যবদ্ধ ও পাশাপাশি থাকে, তাহলে বাইরের কারো পক্ষে হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয় না। কেবলমাত্র এরূপ সুযোগ পেলেই বিদেশি নাক গলিয়ে দেয়। আর বিদেশিরা নাক গলিয়ে দিলে পরিস্থিতিও চলে যায় তাদের কব্জায়। তারাই তখন কাউকে ক্ষমতায় বসায়, কাউকে নামায়। রাজনীতিবিদগণ পরিণত হন বিদেশিদের হাতের পুতুলে।

পাকিস্তানের ঘটনা উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনীতিবিদদের জন্য একটি বিরাট বড় শিক্ষণীয় বিষয়। রাজনীতিতে যখন বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করে, তখন যা হয়, তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে পাকিস্তান।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর