এই ইলিশ পুলিশও কিনছে স্যার!

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 22:38:23

এবছর বষার্কাল অনেকটা বৃষ্টিহীন কেটে যাচ্ছে। দেশের পূর্বের দু—একটি জেলা ছাড়া অন্যান্য জায়গায় অতি কম বৃষ্টিপাতের ফলে কৃষকরা রোপা আমন ধানের চারা লাগাতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। পানির অভাবে পাট ‘জাগ’ দিতে পারছে না। বড় বড় নদীতে পানি কমে গেছে। বঙ্গোপসাগরে নদীর মোহনায় ডুবোচর জেগে উঠেছে। তাই বষার্কালে সাগর থেকে ইলিশ মাছ উজানের নদীতে বিচরণ করতে আসার মুখে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। এজন্য ইলিশের মৌসুমে দেশজুড়ে ইলিশের আকাল দেখা দিয়েছে।

গত দীর্ঘ দু’মাস নদী—সাগরে ইলিশ ধরায় সরকারি নিশেধাজ্ঞা থাকায় জেলেরা ঘরে বসে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। শেষ জুলাইয়ে এই নিশেধাজ্ঞা পার হতেই জেলেরা অতি উৎসাহে নদী—সাগরে জাল নিয়ে নেমে গেছে। কিন্তু তারা পানিতে নামতে না নামতেই হঠাৎ বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে উপকূলে ফিরতে বাধ্য হয়েছে। পরবতীর্তে আবার জাল ফেলতে গেলে আশানুরুপ মাছ না পেয়ে হতাশ হয়ে ঘরে ফিরে আসছে। জেলেরা সামান্য পরিমাণ ইলিশ মাছ নিয়ে ঘাটে ফিরলে তার দাম খুব চড়া। স্থানীয় বাজারে সেসব মাছের চাহিদা থাকলেও সেগুলো বড় বড় শহরের পাইকাররা অগ্রীম কিনে নিয়ে আরো চড়া দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ এবছর ইলিশের স্বাদ নেয়া দুরে থাক, চেহারা দেখারও সুযোগ পাচ্ছে না। তবে অনেক জায়গায় ছোট ইলিশ বা জাটকা ইলিশের ক্রয়—বিক্রয় চোখে পড়ছে।

এবছর এখনও নদী—সাগরে বড় ইলিশের দেখা নেই। নিজেদের মাছ ধরার খরচ পুষিয়ে নিতে বাধ্য হয়ে জেলেরা জাটকা শিকার করছে। প্রতিবছর বষার্র শেষ দিকে ফেরিওয়ালারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বড় বড় ইলিশ ফেরী করে সস্তায় বিক্রি করতো। কিন্তু এবছর ইলিশের ফেরীওয়ালাদের কারো দেখা নেই। তবে তাদের কেউ কেউ জাটকা বিক্রি শুরু করেছে। কাঁচাবাজারের মাছ বিক্রেতাগণ অনেকেই প্রকাশ্যে জাটকা বিক্রি করছেন।

সেদিন নিউমার্কেট কাঁচা বাজারে মাছের দোকানে দেখা গেল কিছু দোকানী দীর্ঘদিন ফ্রিজে রাখা দু—একটি সামুদ্রিক বড় ইলিশ নিয়ে বিষন্ন মনে বসে আছেন। সেগুলোর দামও অনেক বেশি। কেজিপ্রতি হাঁকছেন আঠারশ’থেকে দু’হাজার টাকা। কারো কাছেই নদীতে আহরিত নতুন মৌসুমী ইলিশের যোগান নেই। তবে তাদের অনেকের কাছে ডালি ভর্তি জাটকা। কেউ জাটকা ভর্তি ডালির মুখ অর্ধেক খুলে রেখেছেন কেউ পুরোটাই খুলে, পলিথিনে বিছিয়ে রেখে হাঁকডাক করে বিক্রি করছেন!

বাজারে প্রকাশ্যে জাটকা বিক্রির হাঁডাক শুনে মনে হলো এর নিষেধাজ্ঞা বুঝি তুলে নেয়া হয়েছে। কৌতুহল বশত: একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম ইলিশের মৌসুমে জাটকা বিক্রি করছো কেন? এত জাটকা কোথায় পেলে? তার ঝটপট্ উত্তর। এবছর নদীতে ইলিশ নেই। জেলেরা নদী থেকে ফিরে আসার আগে ট্রলারের তেলের দাম ও মৎস্যশ্রমিকদের খরচ মেটানোর জন্য ঘানিজাল দিয়ে জাটকা শিকার করে এনে গোপনে বিক্রি করছে। কি করবে বলুন? উপায় নেই তো!
বললাম, তোমাদের তো খুব সাহস! এত বড় বাজারে খোলা জায়গায় বসে জাটকা বিক্রি করছো, কেউ বাধা দিচ্ছেনা? মৎস্যবিভাগ বা পুলিশের লোক তোমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে না?

তার উল্টো উত্তর এবার। বলল, ফ্রিজে রাখা একবছরের বাসি হওয়া সামুদ্রিক ইলিশের চেয়ে নদীতে ধরা এসব জাটকার স্বাদ বেশি, তাই চাহিদা বেশি। কত বড় বড় সাহেবরা গাড়ি চড়ে এসে এসব জাটকা ব্যাগ ভরে কিনে নিচ্ছে স্যার! কেউ কেউ আমার ফোন নম্বর নিয়ে বাসায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসতে বলছে। আমার পুলিশের ভয়—ডর লাগে না। তারাও আমার ক্রেতা। আমার কাছে এই ইলিশ পুলিশও কিনছে স্যার!

আমি বহুদিন ধরে বাজারে যাবার সুযোগ পাই না। নিউমার্কেটে একটি সফ্টওয়্যারের দোকানে কিছু কাজ ছিল। তাই সেখানে গিয়েছি। তবে তার আগের ঘটনা ছিল এরকম।

সেদিন সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা। সামান্য গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তবে বেশ গুমোট ভাব ও গরম পড়েছে। ঘরের ভেতরে সেটা অনুভব করতে পারিনি। নাস্তা সেরে দ্রুত অফিসে গিয়ে একটি সেমিনারে যাবার তাড়া রয়েছে। এর মধ্যে নাস্তার টেবিলে বললাম, বষার্কাল চলে যাচ্ছে, আজ আবহাওয়াটা মনে হয় খিচুড়ি খাবার মতো!

আমার কথাটা শেষ না হতেই ওনারও ঝটপট্ উত্তর শুনতে হলো। গৃহকর্ত্রী বললেন, আজ আমার অফিসেও ব্যস্ততা আছে। তুমি একটু আগেভাগে এসে খিঁচুড়িটা উঠিয়ে দিও। ফ্রিজ থেকে একটা ইলিশ বের করে কেটে লবণ—হলুদ মেখে ম্যারিনেট করে রাখিও। আমি রাতে খাবারের আগে ফ্রাই করে দেব’খন। আজ ডিনারে ইলিশ—খিঁচুড়ি হবে। বড় মেয়েকে জামাই সহ খেতে আসতে বলে দেব। কথাটা মনে রেখ কিন্তু! গৃহকর্ত্রী জানে আমি খিঁচুড়িটা ভাল রাঁধতে পারি। বিদেশে পড়াশুনা করার সময় আমরা দু’জন ভাগাভাগি করে রান্না করে খেতাম।

তখন ওই পর্যন্তই। দুপুরে অফিসে ফোন পেলাম। গৃহকর্ত্রী জানাল বাসার ফ্রিজে মনে হয় বড় ইলিশ নেই। তুমি নিউমার্কেটের কাজ সেরে ফেরার পথে দুটো ভাল ইলিশ নিয়ে এসো।

কিন্তু বাজারে গিয়ে মাছওয়ালা আমাকে জাটকা কেনার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো বুঝতে পেরে কি করবো তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। অগত্যা ফ্রোজেন সামুদ্রিক ইলিশ কিনে বাসায় ফিরলাম। মনে মনে ভাবলাম, কোন ভাল ইচ্ছে মনে জাগার পর তাৎক্ষণিক বলে ফেলে কি বিপদটাই না ডেকে আনলাম আমি।

দেশে ইলিশের বড় সংকট চলছে। কিন্তু একশ্রেণির মানুষের কাছে সেটা কোন সমস্যা নয়। সর্বসাধারণের কেনার জন্য আমাদের দেশে খোলা কাঁচাবাজারে সস্তা ইলিশ মাছ নেই। কিন্তু সুপার মার্কেটে বিত্তশালীদের জন্য উচ্চমূল্যে ইলিশ বিক্রির সুব্যবস্থা রয়েছে। এসব বিত্তশালীর ইশারায় সাগর—নদী থেকে বড় ইলিশ আহরণ করার আগেই অগ্রীম বেচা—কেনার নিয়ম চালু হয়েছে। বাংলাদেশে যখন ইলিশ আহরণে নিশেধাজ্ঞা চলে এবং দরিদ্র জেলেরা বাড়িতে অলস সময় পার করে শুধু ঘুমায় তখন আমাদের গভীর সাগরের মাছ বিদেশী বড় বড় মৎস্যধরার জাহাজ এসে ধরে নেয়। এছাড়া প্রতিবেশি দেশের জেলেরা তাদের ট্রলারে দুই দেশের পতাকা রাখে। দিনরাত আমাদের জলসীমায় লালসবুজ পতাকা ঝুলিয়ে ট্রলার ঢুকিয়ে অনায়াসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। তা—না হলে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ আমাদের দেশের কাঁচাবাজারের তুলনায় প্রতিবেশি দেশের বাজারে বা অলিগলিতে এত সস্তায় বিক্রি হতে দেখা যায় কীভাবে?

ইলিশ মাছ নিয়ে এত গবেষণা, সরকারি পরিকল্পনা ও বিধিনিশেধ বলবৎ থাকার পরেও খোলা বাজারে জাটকা বিক্রি হয় কীভাবে? বাজারের ক্ষুদ্র মৎস্য বিক্রেতার কথা যদি সঠিক ধরে নেয়া হয় তাহলে সরকারি লোকেরাও সরকারি নিষেধাজ্ঞা বা মটিভেশন অবজ্ঞা করে কেন?

একদিকে ভয়ংকর ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে গৃহীত মটিভেশন কর্মসূচি অবজ্ঞা করে এক শ্রেণির মানুষ আইন-শৃংখলার লোকেদের নিকট জরিমানা গুণছে অপরদিকে জাটকা বিক্রেতারা বলছে আরেক উল্টো কথা। আমাদের দেশে ছোট-বড়, উঁচু-নিচু, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অসহিষ্ণু ও কার্যত: বেপরোয়া হয়ে গেলে ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের বাহক ও ধারক হবে কে বা কারা? সর্বক্ষেত্রে এমন নেতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন ঘটতে থাকলে তার দায়ভার নিতে কে এগিয়ে আসবে? তা—না হলে বষার্কালে ইলিশ খিঁচুড়ি খাবার ইচ্ছের মতো সামান্য ‘শখ’ সর্বসাধারণের নিকট অধরাই থেকে যাবে।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর