ব্রিকস: গ্লোবাল সাউথের আশার আলো

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 23:01:58

উদীয়মান দেশগুলোর একটি জোট হিসাবে ব্রিকস গঠন করা হয়েছিল। সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হবে মর্মে খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই গ্লোবাল সাউথের ৪০টি দেশ এতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যার মধ্যে কমপক্ষে ২২টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদনও করে ফেলেছে।

কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা ৫ থেকে বাড়িয়ে ১১, অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি করা হবে। মধ্যপ্রাচ্যের চারটি প্রভাবশালী দেশ মিশর, ইরান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ব্রিকসে জায়গা পেয়েছে ইথিওপিয়া ও আর্জেন্টিনা।

নতুন সংগঠনে যোগ দেওয়ার আগ্রহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তি নিয়ে তৈরি হওয়া উৎসাহও বোধগম্য। কারণ, ব্রিকস অনেক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে উঠেছে। তবে এই সংগঠনটি বিভিন্ন বিষয়ে পশ্চিমের নেতৃত্বাধীন জি-৭-এর বিকল্প নয়, বরং এটির একটি প্রায় সমকক্ষ সংগঠন হিসাবেই নিজের অবস্থান তৈরি করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অঙ্গীকার এবং রাষ্ট্রসংঘের সংস্কারের প্রসঙ্গ থেকে ইরান, রাশিয়া এবং ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে পশ্চিমের চাপানোর একতরফা নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ, সমস্ত ক্ষেত্রেই ব্রিকস নিজের মতামত তুলে ধরতে দ্বিধা বোধ করেনি। সংগঠনের তরফ থেকে ইতোমধ্যে উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজে সহায়তা প্রদান করার জন্য নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। এই ব্যাঙ্কটি এখনও পর্যন্ত প্রায় ১০০টি প্রকল্পে অর্থের জোগান দিয়েছে। এর পাশাপাশি একটি কন্টিনজেন্ট রিজার্ভ অ্যারেঞ্জমেন্ট এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি গঠন করার মাধ্যমে ব্রিকস সদস্য দেশগুলো দেখিয়ে দিয়েছে, বাস্তবিক উদ্যোগ বা কাজে তারা কাজ করতে সক্ষম।

সংগঠনটি হয়তো এখনও সম্পূর্ণভাবে জি-৭-কে টেক্কা দিতে পারবে না। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর এই সংগঠনটি গ্লোবাল জিডিপির (প্রতিটিতে প্রায় ৩০%) প্রেক্ষিতে প্রায় সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। জি-৭ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো যেখানে বিশ্বের মাত্র ১০% জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করে, সেখানে ব্রিকস অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের ৪০% দেশের প্রতিনিধিত্ব করা হয়।

নতুন সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেওয়ার পর, বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম ১০টি তেল সরবরাহকারী দেশের মধ্যে ছয়টিই হবে ব্রিকসের সদস্য, যা শক্তির ক্ষেত্রে ব্রিকসের পায়ের তলার মাটিকে আরও মজবুত করে তুলবে।

তবে ব্রিকসের সব দিকই যে উজ্জ্বল, এমনটা নয়। নিজেদের অস্তিত্বের তাৎপর্য প্রমাণ করতে সংগঠনটি সক্ষম হয়েছে ঠিকই। তবে সদস্য দেশগুলো এখনও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেদের সংগঠিত বা শক্তিশালী মনোভাব প্রকাশ করতে পারেনি। এছাড়া সংগঠনটির মধ্যে নানা স্ববিরোধীতাও রয়েছে।

ব্রিকস সদস্য দেশ ভারত এবং চীনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিঃসন্দেহে সংগঠনটির ঐক্যবদ্ধ চরিত্রের উপর আঘাত করেছে। চির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে পরিচিত ইরান এবং সৌদি আরব-সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এই দেশগুলোর সম্পর্কের মধ্যে সম্প্রতি তিক্ততা কিছুটা কমলেও, অতীতের মতো ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে যে ফের সম্পর্কের অবনতি হবে না, এমনটা হলফ করে বলা যাচ্ছে না।

এছাড়া ব্রিকস যদি প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক তথা পশ্চিমের দেশগুলোর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে, তাহলে মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ব্রাজিল সহ ভারতের জন্য তা একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তার কারণ হলো, এই দেশগুলো পশ্চিমের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সাথে একটি কৌশলগত ভারসাম্যের সম্পর্ক বজায় রেখে চলে।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ নিয়েও এরকম একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ব্রিকস সদস্য দেশগুলো এই ব্যাপারে রাষ্ট্রসংঘের কোনো ভোটেই ব্লক হিসাবে ভোট দেয়নি; আবার সংগঠনটির কোনো সদস্য দেশ রাশিয়ার কার্যকলাপকে সমর্থনও করেনি।

ব্রিকসের সাংগঠনিক লক্ষ্য হলো নিজের সদস্য দেশগুলোর কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে মজবুত করা। এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে হলে, চীন বা ভারত যদি কখনো নিজের কৌশলগত বা অর্থনৈতিক লক্ষ্যের আড়ালে সংগঠনের উপর অন্যায্যভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তাহলে সমস্যা দেখা দেবে।

তারপরেও যৌথভাবে সমৃদ্ধি লাভের প্রতিশ্রুতি এবং বিশ্ব শাসনের আরও অংশগ্রহণমূলক মডেলের জন্য সংগঠনটি নিয়ে গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশের মধ্যে আগ্রহ রয়েছে। এটিই ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে সংগঠনটির আকার আরও বড় করতে সাহায্য করবে।

গেলো সপ্তাহে জোহানেসবার্গে ব্রিকসের (ব্রাজিল-রাশিয়া-ভারত-চীন-দক্ষিণ আফ্রিকা) যে ১৫তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে এই গোষ্ঠীর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্যের জন্য এমন উদ্যোগ জরুরি ছিল। সম্মেলনের ফলাফল থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, বৈশ্বিক ক্ষমতার মেরুকরণ পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের একচেটিয়া কব্জা থেকে ক্রমেই দক্ষিণে সরে আসতে। ব্রিকস পরিণত হয়েছে গ্লোবাল সাউথের আশার আলোয়।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর