পাহাড়ের পাদদেশে কেন পুনঃ কান্না?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-05 14:30:43

আমরা ছোটকাল থেকে জানি চট্টগ্রাম আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ফুসফুস। এর উঁচু-নিচু পাহাড় ঘেরা সুন্দর শহর ও পাশেই কক্সবাজার জেলার দীর্ঘতম সৈকত পৃথিবী বিখ্যাত। এজন্য চট্টগ্রাম আমাদের সবার অহংকার। এই চট্টগ্রামকে ঘিরে বন্যা ও জলাবদ্ধতার ভয়ংকর সংবাদ শিরোনাম দেশ-বিদেশের সবাইকে হতবাক করে তুলছে। চট্টগ্রামের রাজপথে বার বার ময়লা, ঘোলা পানিতে জীব ও যানবাহনেরা প্রাণপণ সাঁতার কাটে। মানুষও চরমভাবে নাজেহাল হচ্ছে। বিয়ে করতে গিয়ে বরকে মাথায় নিয়ে পানি পার হতে হচ্ছে। চলতি এইচএসসি পরীক্ষাও মাঝে মাঝে বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

ক’দিন আগে বুক ফাটা কান্নার মধ্যে স্বজনেরা গলা সমান পানিতে দাঁড়িয়ে হাতের উপর ভর করে বাসা থেকে বের করে এনেছে একজন মৃত ব্যাক্তির মরদেহ। আশেপাশে দাফনের জন্য উঁচু জায়গা নেই। তাই তার মরদেহ কোনরকমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে উঁচু কোন কবরস্থানে দাফন করার উদ্দেশ্যে। টিভির পর্দায় দৃশ্য দেখে কষ্ট পাচ্ছেন দর্শকগণ। এই করুণ দৃশ্যের সাথে বুকফাটা কান্না ও আহাজারি সংবাদের শিরানাম হলে সারাদিন ভেসে এসেছে গণমাধ্যমে। বান্দরবানে বিদ্দু্ৎ ছিলনা সাতদিন। মোবাইল ফোনে চার্জ্জ হয়নি। সারা দেশের সাথে সকল মাধ্যমেই নেটওয়ার্ক ছিলনা, যোগাযোগ বন্ধ। বাড়িতে ডুবন্ত রান্নাঘরে চুলা বন্ধ। তাই খাওয়া বন্ধ ছিল। সেখানকার স্কুলে পাঁচদিন ধরে পানিবন্দী ৩৬ জন শিক্ষার্থীরে তাদের স্কুলের হোষ্টেল থেকে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনীর রেসকিউ টিম।

চট্টগ্রামে নগরের মেয়রের বাসায় পানি ছিল। তিনি রিক্সায় চড়ে উঠানের হাঁটু পানি ভেঙে বাড়িতে ঢুকেছেন। গোটা চট্টগ্রাম শহরে পানি জমে দাঁড়িয়ে ছিল। সেখানকার ৬৮ হাজার বসতবাড়ি পানির নিচে ছিল বলে সংবাদ হয়েছে। রাজপথ যেন থৈথৈ নদী হয়ে দুঃখের স্রোতের তোড়ে সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে উন্নত সভ্যতাকে উপহাস করেছে।

নগরের মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে বহু বছর ধরে। মেগা প্রকল্পের কাজ মেগা মেগা সংকট বয়ে এনেছে বলেও সংবাদ হয়েছে। চালুর আগেই নতুন রেললাইন ধ্বসে গেছে। এ সংকটের কারণ ও ব্যাপ্তি এক পুনঃপুনঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বন্যা, ভূমিধ্বস, পাহাড়ে অশান্তি ও মারামারি, মাদকের ব্যবসা ও প্রসারে রুট হিসেবে ব্যবহৃত হবার ঘটনা, পাহাড় কাটা, নদী-খাল দখল, রাজনৈতিক কোন্দল ইত্যাকার নানাবিধ খারাপ সংবাদ বর্তমানের চট্টগ্রামকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করার ইঙ্গিত শুরু করেছে।

দু’বছর আগে আরেক পাহাড়ি এলাকা সিলেটে ভয়াবহ বন্যার কথা দেশবাসী জানে। এবছর একই রূপ নিয়ে গোটা চট্টগ্রামকে আক্রান্ত করেছে ভয়াবহ বন্যা। সাগরের নোনা জলকে ছাড়িয়ে বৃষ্টি ও উজানের ঢলের ঘোলাজল মিলেমিশে একাকার হয়ে জনজীবনকে করে তুলেছ ভীষণ দুর্বিসহ। আর এর পিছনে কারণ হিসেবে উঠে এসেছে নানা কদাকার চিত্র।

ঐতিহাসিক কাল থেকে উজানের ঢল ও অতিবৃষ্টির পানি দ্রুত সাগরে নির্গমণের পথ ছিল চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ছোট-বড় সব নদী ও খাল। এসব পাহাড়ি নদী একযুগ আগেও বেশ সচল ছিল। এরপর থেকে নানা ধরণের মেগা প্রকল্প হাতে নেয়ায় এসব পাহাড়ি নদী ও খাল ভরাট করা হয়েছে অথবা উন্নয়ন কাজের অসাবধানতা বশতঃ ক্রমাগতভাবে নরম মাটি গড়িয়ে এসে এসবের তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়ে ফেলেছে।

প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট ও পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলে ভবন, মার্কেট, রাস্তা, অফিসভবন ইত্যাদি নির্মাণ হয়েছে পরিকল্পরা পাশ করে। কিন্তু সেসব পরিকল্পনা পাশের আড়ালে অন্যায়ভাবে পরিবেশ বিনাশকারী উপাদানকে পাশকেটে যাওয়া হয়েছে। কিছু মানুষের সীমাহীন লোভ ও দুনীর্তির আড়ালে চাপা পড়েছে গেছে গণমানুষের উপকার সাধনকারী আইন—কানুন, পরিবশে ভাবনা। নালা ভরাট ও সংকুচিত করে নির্মাণ করা হয়েছে গোটা চট্টগ্রাম এলাকা জুড়ে। ফলে প্রাকৃতিক জলাধার ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষের বর্জ্য বেড়েছে শতগুণ বেশি। এসব বর্জ্যের পরিমাণ এত বেশি তা নিয়মিত পরিস্কার করার অভাবে নদী ও খালগুলোর তলদেশের উচ্চতা বেড়ে দ্রুত পানি ও পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা মরে গেছে বহুদিন আগেই।

ভয়ংকর জলাবদ্ধতায় কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে উঠেছে। এখন তারা এসব ভরাট নদী-খাল খননেনর কথা বলছেন। কথা হলো- এতদিন এসব মজে যাওয়া খাল খনন করার চিন্তাও আসেনি কেন? এসব কাজে দায়িত্বরতগণ সারা বছর ঘুমিয়ে থাকেন। যখন মানুষ মহাবিপদের সন্মুখিন হয়ে পড়ে তখন চারদিকে হৈ হৈ রব উঠে যায়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য আগাম গবেষণা করে প্রস্তুতি নেয় সারা পৃথিবীর সভ্য মানুষ। অথচ, আমাদের দেশে আগাম চিন্তাভাবনার কথা জানা থাকলেও কাজের বেলা লাভের হিসাব মেলাতে গিয়ে সেধরণের আগাম প্রস্তুতির কথা ফাইলবন্দি করে রাখার প্রবণতা বেশ ভয়ংকর। কারণ সেখানে কর্মদাতা, অর্থদাতা, আমলা, নেতা, ঠিকাদার সবার পারসেন্টেজের বিষয়টা মুখ্য হিসেবে ভেসে এসে সুষ্টভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নকে প্রবল বাধার সন্মুখিন করে তোলে। আজকাল উন্নয়নকাজে মি: পার্সেন্টেটেজদের কারসাজি ও নেটটওয়ার্ক এতটাই ওপেন সিক্রেট হিসেবে আবিভূর্ত হয়েছে যা বলাই বাহুল্যে। এসব উন্নয়ন কাজে বাগড়া দেয়ার জন্য যিনি যত বেশি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারেন তার লাভের অনুপাত তত বেশি।

দেশের বর্তমান উন্নয়নকাজে মি: পার্সেন্টেটেজদের নেটওয়ার্ক দমন করতে না পারলে চট্টগ্রাম ডুবে থাকার মতো ঘটনা আরো অনেকবার ঘটতে থাকবে। সরকারী বিশাল বাজেট বার বার খরচ হয়ে হাওয়া হতে থাকবে কিন্তু মানুষের ভোগান্তি আরো বেশি চক্ষুস্মান হতে থাকবে।

এবারের বন্যার পানি দীর্ঘদিন জন্য প্রদান কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম কক্সবাজার নতুন রেললাইন ও মহাসড়কের অপর্যাপ্ত ব্রীজ ও কালভার্ট নিমার্ণের কথা বলা হচ্ছে। উজানের মাত্রাতিরিক্ত পানির চাপ সহ্য করতে না পেরে রেললাইনের নুড়ি, পাথর, মাটি ভেসে গিয়ে বাঁকা হয়ে গেছে। মহাসড়ক ও রেল লাইনে ১২০ কিঃ মিঃ পথে ২৪৫টি ব্রিজ—কালভার্ট নিমার্ণের দাবি কর্তৃপক্ষের। কিন্তু ভুক্তভোগী মানুষেরা বলছেন, সেগুলো অতি সংকীর্ণ ও বেশিরভাগ কালভার্ট বেজায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সাঙ্গু, টংকাবতী ও ডুলু নদীতে বালু উত্তোলন করে সেগুলো প্রবেশমুখ ভরাট করে রাখা হয়েছিল।

আরেকটি বড় বিষয় হলো- সীমান্তের ওপাড়ে হঠাৎ অতিবৃষ্টির তথ্য ও প্রবেশকৃত পানিপ্রবাহ বাংলাদেশের নিকট সবসময় অজানা থাকে। এজন্য প্রতিবেশিদের সহযোগিতা কম ও হালনাগাদ তথ্যভিত্তিক কোন গবেষণাও করা হয়না। উজানের অনিয়ন্ত্রিত অতিরিক্ত পানি তারা সামাল দিতে না পারলে হঠাৎ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এই ধরণের ফ্লাশফ্লাড উত্তরের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, পূর্বের টিপাইমুখ, সাঙ্গু, কর্ণফুলি সব সীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে আবিভূর্ত হচ্ছে। বৈশ্বিক পরিবেশ পরিবর্তনে ফলে অসময়ে উজানের ঢল ও নেমে আসা বিপুল পরিমাণ বালুমাটি অপসারনের জন্য আমাদেরকে প্রতিবছর নতুন করে গবেষণা ভিত্তিক তথ্য নিয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশী নদী গবেষকগণ এই হমুকির কথা প্রায়শইঃ বলে আসছেন। কিন্তু আমাদের দেশের নির্মাণ প্রকৌশলীগণ এসব বিষয় ঠিকভাবে আমলে নিতে চান না।

ফলে ফিবছর সীমান্ত নদীভিত্তিক অতিরিক্ত পানি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বর্তমানে আমরা বড় বড় বন্যা ও বিপর্যয়ের মুখে নিজেদেরকে ঠেলে দিচ্ছি।

সড়কে এত পানি এতদিন ধরে জলবদ্ধতা তৈরি করে কেন? সামান্য বৃষ্টিতেই দেশের মহানগরীগুলোর মহাসড়ক কেন নদীর মতো হয়ে যায়? উন্নয়নের স্তুতিতে কানভারী হলেও বাস্তব চিত্র বেশ অপ্রিয়। কারণ অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি হতেই পারে। কিন্তু এগুলো মোকাবেলা করে থেকে ভালভাবে বেচেঁ থাকার জন্য উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়ে থাকে। সেসব কর্মসূচিতে এত অর্থ ব্যয় করার পরেও কোন ‘বরকত’ নেই কেন- সেটাই চিন্তার বিষয়!

দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতা বড় অসহ্য। বিপর্যয় মোকাবিলা করতে না পারলে সেসব উন্নয়ন কর্মসূচি প্রহসন মনে হয় জনগণের কাছে। কারণ, তারা এসবের পিছনের অদৃশ্য ও কদকার চিত্রগুলোর কথা জানে ও বুঝতে চেষ্টা করে।

আজকাল কোন বিষয়কে ছোট ভেবে অবহেলা করার উপায় নেই। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ভেবে বাস্তবতার নিরীখে হালনাগাদ তথ্যভিত্তিক গবেষণা ব্যাতিরেকে শুধু খামখেয়ালীভাবে হঠাৎ মেগা প্রকল্প নেয়া হয়। ফলে আমাদের আর্থিক, পারিবেশিক, সামাজিক ও মানসিক ক্ষয়—ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হতে না পারলে প্রতিবছর দেশের সকল পাহাড়ের পাদদেশে পুনঃপুনঃ কান্না থামানোর উপায় খুঁজে পেতে অহেতুক আরো বেশি হয়রান হতে হবে বৈ-কি?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর