‘হুয়াওয়ে’ কি নতুন কোনো সংঘাতের ইঙ্গিত?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

গৌতম দাস | 2023-08-25 10:03:39

চীনের হুয়াওয়ে ফোন এই নামটা বাংলাদেশে সুপরিচিত। যদিও হুয়াওয়ে শুধু স্মার্ট ফোন তৈরির না, ফোন টেকনোলজির বহু ব্যাক-এন্ড যন্ত্রপাতির নির্মাতা এমন অনেক কিছুর উৎপাদক কোম্পানি। এমনকি স্মর্ট ফোনের ৫জি বা নতুন জেনারেশন টেকনোলজি আসন্ন বলে কথা চলছে। চীন তার যেই প্রাইভেট কোম্পানির ওপর আশা ভরসা করে বসে আছে যে সে এবার ৫জি টেকনোলজির লিড করবে সেটা এই হুয়াওয়ে। দুনিয়ার ১৭০ দেশে হুয়াওয়ের ব্যবসা ছড়িয়ে আছে যার বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ৩৯ বিলিয়ন ডলার। এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মালিক হলেন রন ঝেংফাই। তিনি ১২তম চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসের এক নির্বাচিত সদস্য।

১৯৮৭ সালে জন্ম নেয়া এ কোম্পানির প্রধান বৈশিষ্ট হল এটা প্রাইভেট কোম্পানি হলেও রনের নিজস্ব মালিকানা মাত্র মোট শেয়ারের ১.৭%। আর জন্মের সময় থেকে এই কোম্পানির বাকি শেয়ারের মালিক কোম্পানির সব কর্মচারীরা। এই হুয়াওয়ের ‘প্রধান ফাইনান্স কর্মকর্তা’ হলেন সাবরিনা মেং ওয়ানঝু যিনি আসলে প্রতিষ্ঠাতা মালিক রন ঝেংফাই এর মেয়ে। সেই সাবরিনা মেঙ কোম্পানির কাজে হংকং থেকে মেক্সিকো যাচ্ছিলেন, পথে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার ছিল তার বিমান বদলের জন্য যাত্রা বিরতি। আর এই ভ্যাঙ্কুভার বিমানবন্দর থেকে কানাডিয়ান পুলিশ তাকে ১ ডিসেম্বর গ্রেফতার করেছে।

কানাডার অভিযোগ আমেরিকায় সাবরিনার নামে মামলা দায়ের আছে তাই আমেরিকার অনুরোধে সেই মামলার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কানাডা-আমেরিকার মধ্যে মামলা-খাওয়া যে কোনো লোককে পরস্পরের দেশে প্রত্যাবর্তন করে পাঠানোর চুক্তি আছে।

পরবর্তীতে সাবরিনার আটক মামলা আদালতে উঠলে জানা যায় আমেরিকার অভিযোগটা হল, ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত আমেরিকান অবরোধ - এই আইন ভঙ্গ করে ইরানের সাথে ব্যবসা করেছে হুয়াওয়ে। তবে আমেরিকার অভিযোগের আর একটু খুটিনাটি হল, ব্যবসাটা তারা ঠিক হুয়াওয়ের নামে করে নাই, এক বেনামি কোম্পানির নামে করেছে। ‘স্কাইকম’ নামে এক কোম্পানির মাধ্যমে হুয়াওয়ে ইরানের সাথে ব্যবসা করেছে। কিন্তু আইনত স্কাইকম হুয়াওয়ের কোনো অধীনস্ত বা সাবসিডিয়ারি কোম্পানি নয় বলে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে সাবরিনা সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর এরই বিপরীতে আমেরিকান অভিযোগ স্কাইকম হল মূলত হুয়াওয়ের অধীনস্ত এক কোম্পানি, যা বকলমে চলে। তাই তারা সাবরিনা ও তার কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবসায় প্রতারণার অভিযোগ এনেছে। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমেরিকান আইনে ৩০ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে।

এতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপারটা যতটুকু  সহজ বলে মনে হচ্ছে, প্রকৃত বিষয়টা তার চেয়ে জটিল। প্রথমত, এই ঘটনায় চীনা সরকারি প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। চীনে অবস্থিত কানাডা ও আমেরিকার রাষ্ট্রদূতদেরকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে এবিষয়ে চীন তার পালটা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কানাডাকে বলেছে তারা যদি সাবরিনাকে মুক্তি না দেয় তবে এটাকে তারা কানাডা-আমেরিকার যৌথ অপহরণের ততপরতা হিসবে দেখবে। এবং স্বভাবতই সে অনুযায়ী চীন পালটা ব্যবস্থা নেবে। ঘটনার পারদ-চড়তে শুরু করেছে এখান থেকে।

এমনিতেই চীন-আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধে চীনের অনেক কোম্পানির বিরুদ্ধেই  ট্রাম্প বিস্তর অভিযোগ তুলে আসছে। এর মধ্যে টেলিকম এর টেক কোম্পানি হুয়াওয়ে আর  অন্য আরেক সরকারি চীনা কোম্পানী জেডটিই, এই দুইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ চরমের। সাধারণ অভিযোগ হল চীনা কোম্পানিগুলো আমেরিকান টেকনোলজি বা পেটেন্ট চুরি করে গড়ে উঠছে, বেড়ে চলেছে। আর এই দুই কোম্পানির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হল এদের মাধ্যমে চীনা সরকার গোয়েন্দাগিরি চালায়। আমেরিকা তার এই অভিযোগের সিরিয়াসনেস বুঝাতে এক জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস করিয়েছে যা অনুসারে এই দুই কোম্পানির কোসো টেকনোলজি বা ফোন আমেরিকান সরকারি যেকোনো অফিসের জন্য কেনা ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। এই ঘটনা চীন-আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যেই নতুন মাত্রার উপাদান সন্দেহ নেই।  কিন্তু এই আলোচনায় মনে রাখতে হবে সাবরিনা মেঙ এর আটক মামলায় আমেরিকান অভিযোগ ঠিক বাণিজ্যযুদ্ধ বিষয়ক নয়। সোজাসাপ্টা বললে, আমেরিকান অভিযোগ হল ইরানের ওপর আরোপিত আমেরিকান অবরোধ ভঙ্গ করেছে সাবরিনা ও তার কোম্পানি হুয়াওয়ে।

ইংরাজিতে স্যাঙসান এর বাংলাদেশের চলিত ভাষায় যা অবরোধ এর আর এক সমতুল্য অর্থ হল - কাউকে সামাজিকভাবে এক ঘরে করা।  অর্থাৎ কেউ তার সাথে কোনো ধরণের লেনদেন করবে না, সমাজে এমন আদেশ জারি করা। কিন্তু আমেরিকার ‘ইরান অবরোধ’ কথার মানে হল এটা “কেবল মাত্র আমেরিকা-ইরানের সাথে লেনদেন” করবে না। খেয়াল রাখতে হবে এটা জাতিসংঘের কোনো সিদ্ধান্ত বা অবরোধ নয়। তাহলে প্রশ্ন হল আমেরিকার আরোপিত অবরোধ না মেনে চীন-ইরান কিংবা বাংলাদেশ-ইরান কোনো পণ্য বিনিময় লেনদেন করলে আমেরিকা তাতে আপত্তি কী, কী তার বলার আছে? আপাত দৃষ্টিতে আসলে নাই, কারণ আইনত আমেরিকান আরোপিত অবরোধ কেবল আমেরিকা-ইরানের মধ্যে যেকোনো বিনিময় লেনদেনের ওপরই প্রযোজ্য। এবং অন্য কোনো দুই রাষ্ট্রের লেনদেনে আমেরিকার তা দেখার বা তাতে নাক গলানোর কিছু নাই। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন।

ব্রেটনউড সিস্টেম – কথাটার মানে হল, ১৯৪৪ সালে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল আমেরিকার ব্রেটনউড শহরে টানা ২২ দিনের এক আলোচনার ফলাফলে। এর মাধ্যমে এই প্রথম পুজিতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় গ্লোবাল প্রাতিষ্ঠানিকতার নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করেছিল। ফলে তা থেকে এক আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য শুরু করার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল।

একমাত্র আমেরিকান ডলারকে দিয়েই আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য ব্যবস্থা যাত্রা শুরু করেছিল। আর তা বহু চড়াই উৎরাই পার হলেও আজও ৭০ ভাগ আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য ডলারেই হয়ে থাকে। আর চাইলেই এটাকে বদলানো যাচ্ছে না। তবে বদলাবে না তাও নয়। তবে এখন চীনা ইউয়ান কতটা বিকল্প হতে পারে তা দেখার বিষয়। তবে যতক্ষণ না অন্য মুদ্রায় ডলারের চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক বিনিময় বাণিজ্য ঘটবে তাতে কিছু হবে না।

এখনে আমাদের মূল আলোচনা আমেরিকান অবরোধে, চীন-ইরান এর নিজেদের মধ্যে কোনো বাণিজ্য লেনদেনে কেন আমেরিকার আপত্তি। আমেরিকান অবরোধ কথাটার ব্যবহারিক সোজা মানে হল, ইরানের সাথে বাণিজ্য পণ্য লেনদেনের দাম পরিশোধ কেউ আমেরিকান ডলারে করতে পারবে না। কারণ ডলারে লেনদেন মানেই আমেরিকান কোনো না কোনো ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া ফাইনালি লেনদেন পণ্যের মুল্য পরিশোধই হবে না। আর আমেরিকান অবরোধ মানেই আমেরিকান ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা ঘটানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা। এটা ভঙ্গ করাটাই আমেরিকান আইনে জেল জরিমানা শাস্তি (যেন আমেরিকান পবিত্রতা নষ্ট) হিসেবে ঘোষণা করে রাখার সুযোগ পেয়েছে বা নিচ্ছে আমেরিকা।

ব্রেটনহুড সিস্টেমে মুদ্রা ও বাণিজ্য ব্যবস্থা ১৯৪৪ সাল থেকে চালু হবার পর থেকে প্রায় সত্তর বছর পরে একালে এসে এই প্রথম আঁচ লাগার মত ডলার ও আমেরিকা চীনের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, তবে ধীরে ধীরে।  কিন্তু লক্ষ্যণীয় হল, ট্রাম্প প্রশাসন এখন নানা রাষ্ট্রের ওপর “অবরোধ” আরোপ করে বসছে। এক কথায় একালে আমেরিকার অবরোধ আরোপের হার অনেক বেশি। এটা আমেরিকা ও ডলারের প্রভাব ধরে রাখার একটা অক্ষম লক্ষণ।

ওদিকে চীনারা কমিউনিস্ট বলে ডলারের তুলনায় ইউয়ানের ওপর বাজারের বিশ্বাস-আস্থা কম। ইউয়ানকে ডলারের জায়গা নিতেই এ লড়াই।

ঠিক এই কারণে আমেরিকান অবরোধের কথা জেনেও বেনামে ইরানে পণ্য বিক্রির চেষ্টা হতে দেখা যাচ্ছে। আর একমাত্র একালেই ট্রাম্পকে অবরোধের নিয়ম কানুন কড়াকড়িভাবে প্রয়োগের চেষ্টাটা করতে দেখা যাচ্ছে। যার ফাঁদে পড়ে গিয়েছে হুয়াওয়ে কোম্পানি। আপাতত সাবরিনা মেঙ এর কঠিন শর্তে জামিন হয়েছে আর তিনি কানাডাতেই থাকবেন- এটাও সেখানে শর্ত ছিল।

অন্য একটা প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করি। আসলে হুয়াওয়ে প্রসঙ্গ শেষ হতে পারে একমাত্র আপোষ আলোচনায়। আমেরিকা-কানাডাকে টেবিলে আনতে চীন ইতোমধ্যে পালটা চাপ প্রয়োগ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে এক আমেরিকান প্রাক্তন ডিপ্লোমাট যিনি এখন এক আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারনাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ এর চীন বিষয়ক কর্তা। চীন তাকে গ্রেফতার করে, ডিটেনশন দিয়ে ফেলে রেখেছে। একইভাবে দ্বিতীয় আর এক জনকেও গ্রেফতার করেছে।

এছাড়াই, চীনে কাজ পেতে যাচ্ছিল এমন এক কানাডিয়ান কোম্পানির নিশ্চিত চুক্তি স্বাক্ষরের আগের দিন ঐ চীনা কোম্পানি জানায় যে চুক্তি আপাতত স্থগিত থাকবে। কারণ চীনা কোম্পানি বলছে ‘সময়টা ভাল না’।

এভাবে পাল্টাপাল্টি একশন শুরু হতে দেখা যাচ্ছে। এর কি শীঘ্রই কোনো আপোষ হবে? নাকি বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে তা অন্য কোনো দিকে মোড় নেবে?

গৌতম দাস : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর