নতুন প্রজন্মের ভোট ও বাংলাদেশের ভবিষ্যত উন্নয়ন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-08-26 14:33:53

এক.

দুয়ারে কড়া নাড়ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় ১ কোটি ২১ লাখ ৭৭ হাজার ২১৪ জন ভোটার জীবনে প্রথমবারের মত ভোট দিতে যাচ্ছেন। নতুন ভোটারদের বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে ২৬ বছর বয়সের ভোটার রয়েছেন ৪৭ লাখ, ২৩ বছরের ৭০ লাখ, ২১/২২ বছরের ৩৭ লাখ, ১৯/২০ বছরের ২৭ লাখ এবং ১৮ বছরের ৪৬ লাখ ভোটার রয়েছেন ।

ভাসমান ভোটার এবং নতুন ভোটার প্রতি নির্বাচনেই প্রভাব বিস্তার করে। আর তাই, রাজনৈতিক দলগুলোও তাদেরকে ঘিরে বিভিন্ন কৌশল আবলম্বন করে। কেননা এই সকল ভোটার নি:সন্দেহে হারজিতের নির্বাচনকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করে থাকে। কোটা সংস্কার আন্দোলন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর জন্য এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার হওয়া শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এক ধরণের কষ্ট এবং ক্ষত থেকে গেছে। একদিকে আন্দোলনগুলোকে বেগবান করতে সরকার বিরোধীদলগুলো আন্দোলনকারীদের সাথে মিশে তাদের অগোচরেই ‘আগুনে ঘি ঢেলে’ উত্তাল করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে; অন্যদিকে বদনাম কুড়িয়েছে ঐ সকল শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলন হওয়া উচিত ছিল অহিংস যা আন্দোলনকারী নেতারা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি। তারা নিজেরা যেমন স্বাধীনতায় পরাজিত, দুষ্টচক্র, সরকারি দলের প্রতিপক্ষ থাকা না থাকার ব্যাপারে সঠিক তথ্য জানত না, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাংচুর, উপাচার্যের ভবনে ভাংচুরের ঘটনা, লকার ভেঙে গয়না, টাকা-পয়সা চুরি করা, উপাচার্যের স্ত্রী, ছেলেমেয়ের ওপর আঘাত করা, পিতৃতুল্য শিক্ষকগণের গায়ে হাত তোলার ঘটনার দায়ও তারা এড়াতে পারে না।

 

দুই. 

প্রথমবারের মত ভোট দিতে যাওয়া নতুন ভোটারদের বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। উন্নয়নের এ বাংলাদেশ তাদের ভবিষ্যতের কথা বলে। আজকের বাংলাদেশের অবস্থা আগের অবস্থা থেকে নি:সন্দেহে অন্য রকম।

২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনা সরকার একটানা প্রায় দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে দেশের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন সম্পন্ন করেছে তা ছিল এক অসাধারণ সমৃদ্ধির যাত্রা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিকল্প হয়তবা আছে, কিন্তু উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনার বিকল্প যে নেই তা প্রমাণিত।

স্বাধীনতা ও স্বাধীন ভূখণ্ডের ‘বাংলাদেশ’ কে আবাসভূমি পাওয়া বেশ তাৎপর্যসংখ্যক বাঙালি জাতি অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিতে ভূল করে না বলেই সব হারানো শেখ হাসিনাকে বারবার রাষ্ট্রীয় প্ররোচনায় হত্যাচেষ্টা করা হয় যা ১৯৯১ সালের পর বাংলাদেশের আর কোনো দলীয় প্রধান রাজনীতিবিদের জীবনে ঘটেনি।

পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গা পানি চুক্তি, স্বল্প উন্নত দেশগুলোর দীর্ঘদিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব সম্পর্কিত পরিবেশ আন্দোলনের বলিষ্ঠ কণ্ঠ ও নেতৃত্ব, কমিউনিটি ক্লিনিকের বদৌলতে বাংলাদেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব, নারী শিক্ষার উন্নয়ন, সমুদ্র বিজয়সহ সর্বশেষ প্রায় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা দেশে ও বিশ্বে যে অনবদ্য নজির স্থাপন করেছেন, মহাকাশে বাংলাদেশের উপগ্রহ উৎক্ষেপনের যে মহৎ সাহস ও উদ্যোগ নিয়েছেন, তা এক কথায় বিশ্বের কাছে বিস্ময় হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

 

শেখ হাসিনার সরকার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সূচক-‘মাথাপিছু আয়’, ‘মানবসম্পদ’ ও ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা’য় প্রথমবারের মতো নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করেছে। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অগ্রগতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতা সাধন, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী শিক্ষার অগ্রগতি ও ক্ষমতায়নসহ দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নসূচকের প্রশংসা করেছে গোটা আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডল।

একটি স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন, সম্মানের এবং গৌরবের বিষয় হল উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জন করা। শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত ও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশকে এ স্বীকৃতি দিয়ে দেশের অগ্রযাত্রাকে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়ে সম্মানিত করেছে।

তিন.

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের ইতিহাসে ৫৭তম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে মার্কিন কোম্পানি স্পেসএক্স-এর সর্বাধুনিক রকেট ফ্যালকন-৯ এর মাধ্যমে ১১৯.১ দ্রাঘিমাংশে পৌঁছার জন্য গত ১১ মে ২০১৮ ইডিটি, বাংলাদেশ সময় ১২ মে ২০১৮, ভোর ০২:১৪ তে কক্ষপথের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। উৎক্ষেপণের পর এটি কক্ষপথে পৌঁছাতে ৩৩ মিনিট সময় নেয়। উৎক্ষেপনের ১০ দিন পর অর্থাৎ ২১ মে, ২০১৮ স্যাটেলাইটটি নিজস্ব অরবিট স্লটে পৌঁছে যায়। উৎক্ষেপণের পর প্রথমবারের মতো গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম থেকে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ ফুটবল প্রতিযোগিতা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ১২তম সাফ সুজুকি কাপের বাংলাদেশ-ভুটান ও নেপাল-পাকিস্তান ম্যাচ দুটি বাংলাদেশ টেলিভিশনের কারিগরি সহায়তায় পরীক্ষামূলক সরাসরি সম্প্রচারের কার্যক্রমেও সফল হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডাইরেক্ট টেলিভিশন টু হোম (ডিটিএইচ) টেকনোলজির ডিশ সার্ভিস চালু ও সক্ষমতা বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। স্যাটেলাইটের ব্যাণ্ডউইডথ ও কম্পাঙ্ক (ফ্রিকোয়েন্সি) ব্যবহার করে ইন্টারনেটবঞ্চিত অঞ্চলে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট, ব্যাংকিং সেবা, টেলিমেডিসিন ও দূরনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারে ব্যবহার সম্ভব হবে। বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল হয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে দুর্গত ও দুর্যোগ কবলিত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বজায় রাখা সম্ভব

চার.

রাজনীতি ও ভোটের ঐতিহ্যে বাংলাদেশের সামনে একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর শেখ হাসিনা সরকারের সামনে উন্নয়নের মাইলফলক স্থাপনের ইতিহাস তৈরির হাতছানি। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর সঙ্গে রেল সংযোগ বাস্তবায়ন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন রুটে চার লেনের মহাসড়ক ও দুই লেনের রেল লাইন বাস্তবায়ন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সুন্দরবনের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্বলিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও মংলা বন্দরকে গতিশীল করা, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা, কক্সবাজারের মহেশখালীতে লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল তৈরির উদ্যোগ, পায়রা সমুদ্রবন্দরকে চালু ও গতিশীল করা, দেশের প্রায় ৪৫৪৭টি ইউনিয়নে চালু হওয়া ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের (ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার) ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আগামি নির্বাচনের উপর।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় গ্রামপর্যায়ে স্থানীয় জনসাধারণের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ এখন সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যগত সেবার ‘বাংলাদেশ মডেল’ বড় সাফল্যের দৃষ্টান্ত। সারা দেশে এখন প্রায় ১৩ হাজার ৪৪২ টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। এসব ক্লিনিক থেকে মাসে গড়ে ৯৫ লাখ মানুষ বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নেন এবং ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত মানুষ ৩৫ কোটি বার সেবা গ্রহণ করেছেন। কমিউনিটি ক্লিনিকের সাথে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার সিএইচসিপি স্বাস্থ্যকর্মীদের রুটি ও রুজি। রাজস্ব খাতে না যাওয়ায় এখনো সরকার বিরোধীদের শকুনি দৃষ্টি কমিউনিটি ক্লিনিকের উপর।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার পরম মমতায় অসহায় রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখেছে শেখ হাসিনার মহানুভবতা, বাংলাদেশ সরকারের সংবেদনশীলতা এবং বাঙালি জাতির মানবপ্রেম ও জীবনদর্শনকে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে যে মানবতাবাদী ও উদারতার পরিচয় দিয়েছে তা ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

বাঙালির কাছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এবং মানবতা বড় ধর্ম। তাই, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সম্মানে আজকের তরুণ সমাজ এবং নতুন ভোটার আগামি নির্বাচনে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থ বিবেচনা করে পরম মমতায় নিশ্চয় শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াবেন।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান : পি.এইচ.ডি গবেষক, জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং  শিক্ষক  সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর